ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় কাউন্সিলে আগ্রহ নেই বিএনপি নেতাদের

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

  জাতীয় কাউন্সিলে আগ্রহ নেই বিএনপি নেতাদের

শরীফুল ইসলাম ॥ দলকে গতিশীল করতে সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা জাতীয় কাউন্সিলের দাবি করলেও এ বিষয়ে আগ্রহ নেই বিএনপি হাইকমান্ডের। বিশেষ করে লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চান না এখন দলের কাউন্সিল হোক। এ পরিস্থিতিতে অতীতে পদবঞ্চিত যেসব নেতা জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি হলে পদ পাওয়ার আশা করেছিল তারা এখন চরম হতাশ। বিএনপির ঢাউস নির্বাহী কমিটির অধিকাংশ নেতাই এখন দলে নিষ্ক্রিয়। দলের বিভিন্ন কর্মকা-ে অংশ না নিয়ে তারা এখন নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে বেশি ব্যস্ত। এ কারণে বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচীতে আগের মতো আর দলের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। যে কারণে কর্মসূচীগুলো সফল হয় না। এ জন্যই দলের জন্য নিবেদিত নেতাকর্মীরা চান যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নির্বাহী কমিটি করা হোক। কিন্তু দলীয় হাইকমান্ড তাদের এ চাওয়া-পাওয়াকে আমলে নিচ্ছে না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর থেকেই বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা জাতীয় কাউন্সিলের বিষয়টি সামনে আনে। ক’জন সিনিয়র নেতাসহ একটি বড় অংশ জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দল পুনর্গঠনের দাবিও জানায়। খবর পেয়ে সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও এ দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী থাকায় এবং লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাজি না থাকায় জাতীয় কাউন্সিল করতে পারছে না বিএনপি। এ নিয়ে দলের একটি বড় অংশের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করলেও হাইকমান্ডের রোষানলে পড়ার ভয়ে কেউ এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চায় না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এ পর্যন্ত বেশ ক’বার বিএনপির সিনিয়র নেতারা জাতীয় কাউন্সিলের বিষয়ে আশ্বাস দেন। কিন্তু সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমান দলের সিনিয়র নেতাদের এ ভূমিকায় নাখোশ হন। এ পরিস্থিতিতে দলের ক’জন সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বলে তারেক রহমান এখন জাতীয় কাউন্সিল না করে পরে সুবিধাজনক সময়ে করার নির্দেশ দেন। সে নির্দেশের কারণেই অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে গেছে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল। দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে তিনবছর পর পর বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল করে নতুন নির্বাহী কমিটি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলের পর ৫৯২ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করে বিএনপি। এ কমিটির মেয়াদ ৬ মাস আগেই শেষ হয়ে গেছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশেও (আরপিও) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে তিনবছর পর পর জাতীয় কাউন্সিল করার বিধান রয়েছে। তবে সে ক্ষেত্রে তিনবছরের মধ্যে কাউন্সিল করতে না পারলে বিশেষ অসুবিধার কথা বলে সময় বাড়িয়ে নেয়ার সুযোগ আছে। আর সে সুযোগটিই নিচ্ছে বিএনপি। এ ছাড়া দলের একটি অংশ চান যখন খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন তখনই দলের জাতীয় কাউন্সিল করতে। সূত্রমতে, বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মীই চান জাতীয় কাউন্সিল করে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের নিয়ে নতুন নির্বাহী কমিটি গঠন করা হোক। বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও এমনটিই চায়। বিশেষ করে সংস্কারপন্থী বলে পরিচিত যেসব নেতারা এখনও কমিটিতে স্থান পাননি, তারা চান নতুন কাউন্সিলের পর কমিটি পুনর্গঠন করা হোক। কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখন কাউন্সিল করতে নারাজ। কারণ, তারেক রহমান মনে করেন খালেদা জিয়া কারাগারে এবং তিনি নিজে বিদেশে অবস্থান করায় জাতীয় কাউন্সিলের নেতৃত্ব দেয়া নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে একাধিক গ্রুপ থাকায় কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে বড় রকমের সমস্যা হতে পারে। এমনকি কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে দলে ভাঙ্গনও দেখা দিতে পারে। আর এমন আশঙ্কার কারণেই তারেক রহমান বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলে সায় দিচ্ছেন না। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিভিন্ন স্তরে দল গোছানোর কাজ এগিয়ে চলছে। জাতীয় কাউন্সিলও সুবিধাজনক সময়ে অনুষ্ঠিত হবে। তবে বিএনপি যাতে কাউন্সিল করতে না পারে এ জন্য সরকার বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপি অবশ্যই জাতীয় কাউন্সিল করে নতুন নির্বাহী কমিটি গঠন করবে। তবে এখনও জাতীয় কাউন্সিল করার বিষয়ে কোন আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, দলকে শক্তিশালী করতে জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে ত্যাগী, মেধাবী ও পরীক্ষিত নেতাদের নিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। দলের দুর্দিনে কাদের কি ভূমিকা ছিল কমিটি গঠনের সময় সে বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। একদিকে জাতীয় কাউন্সিল না করা এবং অপর দিকে তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্তে দলীয় কর্মকা- পরিচালিত হতে থাকায় ভেতরে ভেতরে অনেক নেতাকর্মীর মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। মাঝেমধ্যে এই চাপা ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটেছে। তবে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ ক’জন নেতা এমন চাপা ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে দলীয় হাইকমান্ডের তোপের মুখে পড়েছেন। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ জাঁকজমকভাবে জাতীয় কাউন্সিল করেও এর সুফল পায়নি বিএনপি। বরং জাতীয় কাউন্সিলের পর নতুন নির্বাহী কমিটি গঠন নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রুপিং-কোন্দল বেড়ে যায়। এ নিয়ে দলের হাইকমান্ডও বিব্রত হয়। একপর্যায়ে যারা কমিটিতে স্থান পেতে আগ্রহী ছিল তাদের সবাইকে গণহারে স্থান দিয়ে ৫৯২ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। তবে এ কমিটি করা হয় ৫ ধাপে। এর ফলে জেলা-উপজেলা কমিটিতে স্থান পাওয়ার যোগ্য নয় এমন নেতারাও কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পান। কিন্তু কমিটিতে পদ বাগিয়ে নেয়ার পর অনেকেই আর দলের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখেনি। এ নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। আর এ কারণেই এখন বিএনপির কেন্দ্র থেকে কোন কর্মসূচী ঘোষণা করলে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা তা পালনে অনীহা প্রকাশ করেন। জানা যায়, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যেও একটি অংশ এখন জাতীয় কাউন্সিলের বিপক্ষে। কারণ, বিগত সাড়ে ৩ বছরের কর্মকা-ের কারণে তারা ত্যাগী নেতাদের তোপের মুখে পড়তে পারেন এবং নতুন কমিটিতে নিজেদের নাম লেখাতে ব্যর্থ হতে পারেন এমন আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণেই এখন তারা দলের তারেক রহমান অনুসারী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে জাতীয় কাউন্সিল না করার বিষয়ে দল ভারি করার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে দলে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির সিনিয়র নেতারাও গ্রুপিং-কোন্দলে লিপ্ত। সিনিয়র নেতাদের মধ্যে একটি অংশ চায় মির্জা ফখরুলকে মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে দিতে।
×