ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দখল দূষণ রোধে আদালতের অধিকাংশ রায়ই উপেক্ষিত

প্রকাশিত: ১০:২৪, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

  দখল দূষণ রোধে আদালতের অধিকাংশ রায়ই উপেক্ষিত

বিকাশ দত্ত ॥ নদী-খাল দখল-দূষণ রোধে উচ্চ আদালতের আদেশ কিছু বাস্তবায়িত হলেও অধিকাংশই উপেক্ষিত। দখল দূষণ রোধে উচ্চ আদালত গত দশ বছরে ৫৬ আদেশ দিয়েছে। যার কিছু আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকিগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলছে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ৪০৫ নদী অবৈধ দখলদারদের কবলে। নদীখেকোদের কারণে আজ দেশের নদ-নদীগুলো তাদের মানচিত্র হারাতে বসেছে। ভরাটের কারণে পানি প্রবাহ কমে গেছে। ¯্রােতস্বিনী নদী আজ সরু নালায় পরিণত হয়েছে। ছোট বড় তিন শতাধিক নদী বিলীন হতে বসেছে। যদিও রিটকারী আইনজীবীর মতে, আদালতের আদেশের পর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ৭০ ভাগই কার্যকর হয়েছে। এ ছাড়া বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর রায়গুলোর কিছু কাজ বাকি আছে। বাস্তবায়ন হতে কিছু সময় লাগবে। নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী নদী রক্ষার চ্যালেঞ্জ প্রতিহত করতে নানামুখী তৎপরতারোধে সতর্ক থাকার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। নদী দিবস উপলক্ষে শনিবার এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী একথা বলেন। নদী রক্ষায় আদালতের এক রায়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে ১৩শ’ নদীর দেশ বলা হলেও বর্তমানে তা নেই। দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৭১০। এর মধ্যে ৩শ’ বড় নদী ও ৪শ’ শাখা-উপনদী রয়েছে। আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে পরিচিত ৫৭ নদী। এর মধ্যে ভারত থেকে প্রবাহিত ৫৩ নদী, বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবাহিত ১ ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত ৩। যারা দখল-দূষণে নদীকে আক্রান্ত করেছে তারা মানবতার শত্রু। এদের বিরুদ্ধে আপোসহীনভাবে অভিযান চালানো উচিত। আদালত এ পর্যন্ত ৫৬ মামলার অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ ও রায় প্রদান করেছে। যার মধ্যে ৩০ নদী, ১৩ খাল ও ১৩ পুকুর রয়েছে। রায়ের পর নদী-খাল ও পুকুর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি আদি বুড়িগঙ্গার চ্যানেল। সম্প্রতি রায়ে তুরাগ নদীকে লিগ্যাল বা জুরিসটিক পার্সন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু যে তুরাগ নদী আক্রান্ত তা নয়, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ৪০৫ নদী অবৈধ দখলদারদের দ্বারা আক্রান্ত। এ ছাড়া প্রতি বছরই দুই একটি করে নদী মরে যাচ্ছে বা শুকিয়ে যাচ্ছে। নদী শুকিয়ে যাবার কারণে তার প্রভাব হাওড় বিলেও পড়েছে। ফলে বর্ষার সময়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পাশাপাশি নদী ভাঙনের মাত্রাও বেড়ে গেছে। অন্যদিকে নদনদী ও মিঠা পানির অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নদী দখলের প্রভাব প্রাণিকুলেও পড়েছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এরই মধ্যে দেড় ডজন প্রজাতির প্রাণী হারিয়েছে। সুন্দরবনেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সুন্দরী গাছ, কেওড়া, গোলপাতাসহ মূল্যবান সম্পদ ধ্বংসের সম্মুখীন। একইসঙ্গে অনেক পাখি, বন্যপ্রাণী, বনজ উদ্ভিদ ও পোকামাকড়ের বহু প্রজাতিও বিলুপ্তির পথে। সব কিছুরই প্রভাব পড়েছে নদী দখলের কারণে। সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনানুযায়ী ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে তার জীবন হতে বঞ্চিত করা যাবে না। প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, সকল উন্মুক্ত জলাভূমি, সমুদ্র, নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, ঝিল, সমুদ্র, সৈকত, নদীর পাড়, পাহাড়, পর্বত, টিলা বন এবং পাবলিক ট্রাস্ট। সম্পত্তি ধ্বংসের কারণে প্রতিনিয়ত নাগরিকের তথা মানুষের জীবনহানি ঘটে চলছে। সুতরাং স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। সূত্র মতে ২০০৯ সালে সম্পূরক আবেদনের পরেও এখনও উদ্ধার হয়নি আদি বুড়িগঙ্গার চ্যানেল। নদীর জমিতে হয়েছে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। নদীর জমি দখল করে বানানো হয়েছে শতাধিক ঘর-বাড়ি -দোকানপার্ট। এ কারণে ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে আদি বুড়িগঙ্গার চ্যানেলটি অস্তিত্ব কোনমতে টিকে আছে এক কিলোমিটার। ঢাকার কামরাঙ্গীরচর মাঝখানে বুড়িগঙ্গা নদী দুইভাগ হয়েছে। যার একটি প্রবাহমান বুড়িগঙ্গা, আরেকটি চ্যানেলকে সবাই চেনে আদি বুড়িগঙ্গা নামে। ২০০৯ সালে জরিপকালে বুড়িগঙ্গার সীমানা নির্ধারণ হলেও আদি বুড়িগঙ্গা নামে পরিচিত নদীর সীমানা নির্ধারণ হয়নি। যার ফলে পরবর্তীতে এই হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরশেদ আদালতে এক সম্পূরক আবেদনে উক্ত বুড়িগঙ্গা সীমানা জরিপের জন্য আদালতে আবেদন জানান। আদালত তা মঞ্জুর করে জরিপ করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়। কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি গঠন করে জরিপ সম্পাদন করে রেজিস্ট্রার বরাবরে জরিপ প্রতিবেদন দাখিল করেছে। রিপোর্ট অনুসারে লোহারপুল হয়ে কালুনগরের দিকে চ্যানেলটির একটি অংশের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যার দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার। এদিকে আদালতের আদেশে যে সমস্ত নদী ও খালের দু’পাড়ে অবৈধ স্থাপনাসহ অন্য আদেশ মানা হয়েছে যেগুলোর মধ্যে রয়েছে, ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদী, বরিশালের জেল খাল, ঝাউতলা পুকুর, কালীগঞ্জের সিংখলি খাল, কপোতাক্ষ নদ, পুটিয়া খাল, সন্ধ্যা নদী, কীর্তনখোলা নদী, রাজশাহী শহরে কয়েকটি পুকুরসহ বেশ কিছু নদী ও খাল দখলমুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু নদী ও খাল দখলমুক্ত করার আদেশ দেয়া হলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়নি। এ প্রসঙ্গে হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচ আরপিবি) প্রেসিডেন্ট এ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ জনকণ্ঠকে বলেন, নদীগুলোর বর্তমান যে অবস্থা তা ভয়াবহ। যদিও আদালত প্রায়ক্ষেত্রেই বিভিন্ন প্রতিকারমূলক আদেশ দিচ্ছেন। সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই বেগ পেতে হয়। এমনও ঘটনা ঘটে যে পুকুর দখল করার জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করা হয়। চার নদী রক্ষার বিষয়ে অনেক সময় পদক্ষেপ নিয়েছি। সহজ হয়েছে। বেশ কিছু কাজ এখনও বাকি রয়েছে। নদীর প্রবাহ কমে গেলে নদীতে অনেক প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। প্রবাহ কমার অন্যতম কারণ ভারত থেকে যে সমস্ত নদীর পানি প্রবাহ আসে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ। বুড়িগঙ্গাসহ চার নদীকে রক্ষা করে ঢাকার ভেনিস হিসেবে পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, দূষণ ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য যে সমস্ত অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ ও রায় দেয়া হয়েছে তার ৭০ ভাগই কার্যকর হয়েছে। এ ছাড়া বড় রায়গুলো বিশেষ করে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর রায়গুলোর কিছু কাজ বাকি আছে। বর্তমানে বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধে কাজ চলছে। আশা করা হচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ দূর করে লন্ডনের টেমস নদীর মতো করা হবে। উল্লেখ্য, টেমস নদীও উদ্ধার (দূষণমুক্ত) করতে এক যুগের বেশি সময় লেগেছিল। বুড়িগঙ্গার নদীর দূষণ ও দখল দুটিই আগামীতে বন্ধ হলে নদী তার পূর্বের বৈশিষ্ট্য ফিরে পাবে। পরিবেশ সচেতন আইনজীবীরা বলেছেন, হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে পদক্ষেপ নেয়া হলে বুড়িগঙ্গাসহ চার নদী রক্ষা করে রাজধানী ঢাকাকে ভেনিস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। নদী খাল পুকুর জলাধার ভরাট বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবশালীদের কারণে এগুলো ভরাট হচ্ছে। নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ায় কারণে অনেক জলজপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ডেপুটি এ্যার্টনি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক জনকণ্ঠকে বলেন, নদী রক্ষায় আদালত এ যাবত বেশ কিছু অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ ও রায় প্রদান করেছে। এতে করে নদীর অভ্যন্তরে ও পাড়ে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়েছে। আশা করছি যেগুলো এখনও বাস্তবায়ন হয়নি তা অচিরেই বাস্তবায়ন হবে। নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে বন্যা জলোচ্ছ্বস হবে না। দূষণের মাত্রাও কমে যাবে। আদালত যে ৫৬ মামলায় আদেশ ও রায প্রদান করেছে সেগুলো এইচআরপিবির দায়েরকৃত মামলা। এর বাইরে আরও কিছু বেসরকারী সংগঠন এগিয়ে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সহ অন্যান্য সংগঠন। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী রক্ষায় হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচ আরবিপি) একটি রিট দায়ের করে। রিট দায়েরের ফলে ২০০৯ সালের ২৫ জুন হাইকোর্ট ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে একটি মাইল ফলক রায় প্রদান করেন। ঢাকার পাশে চার নদীকে বাঁচাতে বংশী নদী ও ধলেশ্বরী নদী এবং পুলঙ্গী, টঙ্গী ও কর্ণপাড় খালের যথাযথ সংরক্ষণ এবং নদীগুলোর সঙ্গে খালগুলোর সংযোগের বিষয়েও কার্যক্রম গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয় আপীল বিভাগ। এর আগে দখল ও দূষণে জর্জরিত বুড়িগঙ্গাকে রক্ষার জন্য বেলা ১৯৯৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগে রিট দায়ের করে। আদালতের রায়ের পর অবৈধ উচ্ছেদ হয়েছে দীর্ঘ আইনী প্রক্রিয়ায়। রায়ের পর নদীর পারে ওয়াকওয়ে কিছুটা হয়েছে। এ ছাড়া বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ বন্ধে কার্যকর ভূমিকার জন্য জনস্বার্থে একটি মামলা করা হয়। সেটারও রায় হয়েছে। ওই রায়ে ৬ মাসের মধ্যে ওয়াসাকে নদীর মধ্যে বর্জ্য ফেলার সমস্ত লাইন বন্ধে করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এ ছাড়া সিটি কর্পোরেশন ও পুলিশ বিভাগকেও অনেকগুলো নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এই রায় পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। রিটকারী আইনজীবী বলেন, রায় বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ২/৩ বছর আগে শ্যামপুর শিল্পএলাকার বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলার জন্য দায়ী শিল্পগুলোকে বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন করতে গেলে স্থানীয় সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে কয়েক হাজার সমর্থক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরিবেশ প্রতিমন্ত্রীকে ঘেরাও করে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন এ রায় অবশ্যই কার্যকর হবে। বুড়িগঙ্গা দূষণে দায়ী হাজারীবাগের শিল্প সরিয়ে নেয়ার জন্য আদালত অবমাননার মামলা করা হয়। আপীল বিভাগের দৃঢ় অবস্থানের কারণে ট্যানারি সরাতে বাধ্য হয়। হাজারীবাগের বর্জ্য বন্ধ হয়েছে। পাশাপাশি নদীর পাশে থেকে আগের মতো বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে না। কর্ণফুলী নদীর পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে হাইকোর্টের আদেশ বহাল ॥ কর্ণফুলী নদীর পাশে অবৈধভাবে গড়ে তোলা স্থাপনা উচ্ছেদে হাইকোর্টের আদেশ বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ। ফলে কর্ণফুলীর যে অংশে অবৈধ স্থাপনা আছে সেটুকু অপসারণ করতে আর কোন বাধা নেই বলে জানিয়েছেন রিটকারী আইনজীবী। চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের দায়ের করা আবেদন খারিজ করে এ আদেশ দেয় আপীল বিভাগ। আদেশের পর আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি রিট দায়ের করা হয়েছিল। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন থেকে একটি জরিপ প্রতিবেদন দিয়েছিল। সেখানে প্রায় ২১শ’ অবৈধ স্থাপনা ছিল। এরপর ২০১৬ সালে একটি রায় হয় যেখানে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। ওই রায়ের আলোকে গত ৪ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। এ সময় কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান গত ৬ ফেব্রুয়রি চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করে স্থগিতাদেশ নিয়ে যায়। এরপর তাদের ওই আবেদনটি আপীল বিভাগে শুনানি হয়। আদালত শুনানি শেষে তাদের আবেদন ডিসমিস (খারিজ) করে দিয়েছে। এর ফলে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের যতটুকু জায়গায় নদীর অংশে পড়েছে সেটুকু ভাঙতে আর কোন বাধা নেই। ৪৫০ নদী অবৈধ দখলদারদের দ্বারা আক্রান্ত ॥ নদী দখলকারীকে সব ধরনের নির্বাচন ও ঋণ গ্রহণে অযোগ্য ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। তুরাগ নদী রক্ষাসংক্রান্ত রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিহ হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ নদীরক্ষায় যুগান্তকারী নির্দেশনা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাসহ মামলার রায় ঘোষণা করেন। পাশাপাশি নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে। ২৮৩ পৃষ্ঠার রায়টি বিচারপতিদের স্বাক্ষরের পর ১ জুলাই সুপ্রীমকোর্টের ওয়েবসাইটে এই রায় প্রকাশ করা হয়। এর আগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে উল্লেখ করে রায় প্রদান করে হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়, নদীসমূহ বাঁচা-মরার ওপর বাংলাদেশের অস্তিত্ব জড়িত। নদীগুলো চলুক নিরবধি। জোয়ার-ভাটার নদীগুলো তার ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখতে থাকুক। মাঝি-মাল্লারা মনের সুখে আবার নদীতে প্রাণ খুলে ভাটিয়ালি গান গেয়ে উঠুক। বাংলার দামাল ছেলেরা নদীতে মনের সুখে আবার দাপাদাপি করুক। মৎস্যজীবীদের মুখের হাসি আবার ফিরে আসুক। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দে নৌকার মাঝিরা নিশ্চিন্তে ঘুমাক। প্রচুর অর্থের বিনিময়ে দেশ বিদেশে হাওয়াই জাহাজে ঘুরে না বেড়িয়ে বাংলার জনগণ আবার পাল তোলার নৌকায় রূপালি বাংলা দেখতে ঘুরে বেড়াক। রায়ে ১৮ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- নদী দখলকারীরা বাংলাদেশের সকল ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পরিষদ এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীর অযোগ্যতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে ৬ মাসের মধ্যে অত্র বিভাগকে হলফনামা সম্পাদনের মাধ্যমে অবহিত করা। রায়ে আদালত বলেছে, মানুষের জীবন-জীবিকা নদীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানবজাতির টিকে থাকার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে নদী। নাব্যসঙ্কট ও বেদখলের হাত থেকে নদীরক্ষা করা না গেলে বাংলাদেশ তথা মানবজাতি সঙ্কটে পড়তে বাধ্য। নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সরকার আইন প্রণয়ন করে নদীকে বেদখলের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করছে। নদী রক্ষায় আন্তর্জাতিকভাবে জাগরণ শুরু হয়েছে। এখন সবারই ভাবনা- পরিবেশের জন্য নদীরক্ষা করতে হবে। রায়ে তুরাগ নদকে লিগ্যাল পার্সন (আইনগত ব্যক্তি) ঘোষণা করে বলেন, অবৈধ দখলদাররা প্রতিনিয়তই কমবেশি নদী দখল করছে। অবৈধ স্থাপনা তৈরি করায় সংকুচিত হয়ে পড়ছে নদী। এসব বিষয় বিবেচনা করে তুরাগ নদকে লিগ্যাল/জুরিসটিক পার্সন হিসেবে ঘোষণা করা হলো। অবৈধ স্থাপনা তৈরি করায় সংকুচিত হয়ে পড়ছে নদী। নদী রক্ষায় আদেশ ও রায় ॥ যে ৩০ নদীর ওপর দূষণ ও দখলের ওপর অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ ও রায় দেয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, পটুয়াখালী কলাপাড়ার টিয়াখালী নদী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদী, নাটোরের তুলশী গংগা নদী, বরিশালের সন্ধ্যা নদী, কীর্তনখোলা নদী, কেরানীগজ্ঞের ধলেশ্বরী নদী, ঢকার চার নদী অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও দখলমুক্ত, বুুুড়িগঙ্গার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণ বন্ধ করা, শ্যামপুর কদমতলী এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদী দখলমুক্ত করা, মিরেরবাগ এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদী দখল করে লবণ কারখানা স্থাপন বন্ধ করা, মানিকগঞ্জের কালীগঙ্গা নদী ভরাট বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, যশোরের মুক্তেশ্বরী নদী ভরাট বন্ধ , মুন্সীগঞ্জের মাদবরের হাট নদী দখল বন্ধ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঢালভাঙ্গা নদী ভরাট বন্ধ, আশুগঞ্জে মেঘনার বুকে অবৈধ জেটি স্থাপন বন্ধ করা, শীতলক্ষ্যা নদী ভরাট বন্ধ করা, সাতক্ষীরার কপোতাক্ষ নদীর অভ্যন্তরে বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করা, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে মেঘনা নদীরক্ষা, কুমিল্লার গোমতী নদীরক্ষা, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, গোমতী নদী রক্ষায় ও অবৈধ দখল উচ্ছেদের, মাগুরার ধলেশ্বর নদীরক্ষা, খুলায় ময়ূর নদী দখল করে লিনিয়া পার্ক নির্মাণ বন্ধ করা, বুড়িগঙ্গা নদীর ভেতরে রিক্রিয়েশন সেন্টার স্থাপন বন্ধ করা, ঢাকার তুরাগ নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, মানিকগজ্ঞের ধলেশ্বরী নদী ভরাট বন্ধ, পাবনার ইছামতি নদী ভরাট বন্ধ খাল ভরাট ও দখলের বিরুদ্ধে আদেশ ॥ আদালত ১৩ খাল ভরাট ও দখলের বন্ধে অন্তর্বর্তী আদেশ ও রায় দিয়েছে। যার মধ্যে আছে খুলনার তিতুখালি খাল ভরাট বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ, ঢাকা আগারগাঁও ওয়াশা খাল, চট্টগ্রামের চাকতাই খাল, সিরাজগঞ্জের বেলকুচি ওয়াপদা খাল, আখাউড়ার কালান্দী খাল, কেরানীগঞ্জের সিংহ খাল, টঙ্গীবাড়ির কামাড়খারা বাজার খাল, যাত্রবাড়ীর কবরস্থান খাল, বরিশালের পুটিয়া খাল পুকুর ভরাট বন্ধে নির্দেশনা ॥ আদালত নদী ও খাল ভরাট বন্ধে নির্দেশনা ছাড়াও প্রায় ১৩ পুকুর ভরাট বন্ধে নির্দেশনা প্রদান করেছে। যার মধ্যে রয়েছে, মাদারীপুর শহরের পুকুর, রংপুর শহরে পুকুর ভরাট করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স তৈরি বন্ধ করা, বরিশালে দিঘী ভরাট করে খাদ্য গুদাম নির্মাণ বন্ধে ব্যাবস্থা গ্রহণ, পিরোজপুরের নাজিরপুরে পুকুর ভরাট বন্ধ, নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে পুকুর ভরাট বন্ধ, রাজশাহী শহরে পুকুর ভরাট বন্ধ, ভোলা লালমোহন পুকুর ভরাট বন্ধ, বরিশাল ঝাউতলা পুকুর ভরাট বন্ধ, আদালত পাড়ায় পুকুর ভরাট বন্ধ, ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয় পুকুর, এবং চট্টগ্রাম শহরে মুন্সীপুকুর ভরাট বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
×