ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কমলাপুরে খালেদের টর্চার সেলে চলত রোমহর্ষক নির্যাতন

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 কমলাপুরে খালেদের  টর্চার সেলে চলত রোমহর্ষক নির্যাতন

আজাদ সুলায়মান ॥ মতিঝিলের একটি হোটেলে চাঁদা চাইতে গিয়ে মার খেয়ে ফিরে আসে খালেদের দুই ক্যাডার। এই অপরাধে দুজনকে আরেক দফা পেটায় খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। ঘণ্টাখানেক পর খালেদের লোকজন ওই হোটেলের এক ম্যানেজারকে তুলে নিয়ে কমলাপুরের ইস্টার্ন কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সের ৪০২ নম্বর রুমে আটকে রেখে চলে জিজ্ঞাসাবাদ। ‘চাঁদাও দিসনি, আবার মারও দিলি’- বলেই মুখে বাঁধা হয় গামছা। দেয়া হয় ইলেক্ট্রিক শক, হিটারের কানেকশন। এ অবস্থায় বোবার মতো ইশারা-ইঙ্গিতে বাঁচার আকুতি মিনতি চিৎকার। কিন্তু মুখ বেঁধে থাকায় সে চিৎকারের শব্দ দরজা ভেদ করে বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। এভাবে তাকে বন্দী রেখে টর্চার করার পর আবার ওই দু ক্যাডারকে পাঠানো হয় হোটেলে। বাধ্য হয়ে পাঁচ লাখ টাকা পাঠানোর পর ম্যানেজারকে মুক্তি দেয়া হয়। ওই ম্যানেজার হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর শুধু চাকরি নয়- জীবনের জন্য ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। এই ম্যানেজারের মতো শত শত লোক খালেদের টর্চার সেলে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ডিবিতে সাতদিনের রিমান্ডে থাকার প্রথম দিনেই যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া এ ধরনের লোমহর্ষক তথ্য ফাঁস করেছে। ডিবি সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ এমন কিছু বিষয়ে মুখ খুলেছে যা অবিশ্বাস্য। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মতোই মানুষকে নির্যাতনের জন্য এমন সব অত্যাধুনিক কিটস সে ব্যবহার করত যা পুলিশের কাছেও নেই। ইলেক্ট্রিক শক দেয়ার কিটে রয়েছে ব্যারোমিটার। কত তাপমাত্রায় সুইচ দেয়া হলে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায় সেই কারিগরি জ্ঞানও রয়েছে খালেদের প্রশিক্ষিত ক্যাডারদের। কমলাপুরের ইস্টার্ন কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সের আশপাশের লোকজন এখন মুখ খুলছে খালেদের এই টর্চার সেল সম্পর্কে। দু‘একদিন পর পরই ওই সেলে মানুষকে নিয়ে কখনও ডেকে, কখনও ধরে আবার কখনও অপহরণ করে নিয়ে আসা হতো। খালেদের টর্চার সেলে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন লোকজন এখন ডিবিতেও গোপনে গোপনে যোগাযোগ করছেন টর্চার সেলের ভয়ঙ্কর সব নির্যাতনের চিত্র। ডিবি সূত্র মতে- শুধু চাঁদার জন্যই এখানে টর্চার করা হতো না। জায়গা সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য কলহ, ফুটপাথের মাসোহারা তোলা নিয়ে ঝগড়া, দরপত্রের কার্যাদেশ পাওয়া না পাওয়ার দুই পক্ষ, নতুন ব্যবসা চালুর সেলামি, ও বিরোধপূর্ণ জমির নিয়ে প্রতিপক্ষকে ডেকে এনে নিষ্পত্তির কাজ চলত খালেদের এই টর্চার সেলে। মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে গেলেও তার পক্ষের হয়ে সত্যবাদীদের ওপর চলত নির্যাতন। এমন সব অভিযোগ এখন ফাঁস করছেন ভুক্তভোগীরা। ডিবি পুলিশ সবই খতিয়ে দেখছে। বড় ধরনের বা চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলো সম্পর্কে বিশেষ জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রথমে মুখ কুলুপ আটলেও পরে মুখ খুলতে বাধ্য হয় খালেদ হোসেন ভূঁইয়া। টর্চার সেল ছাড়াও রাজধানীতে নতুন গজিয়ে ওঠা ক্যাসিনো বাণিজ্যের মূল হোতা, পুলিশ প্রশানের কারা কারা সেখান থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেতেন, কোন প্রভাবশালী নেতারা প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্যাসিনোকে শেল্টার দিতেন- সে সব সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করছে খালেদ। ভুক্তভোগী মানুষের পাশাপাশি খালেদ নিজেও গলগল করে বলে দিচ্ছে ক্লাব পাড়ার অপরাধজগতের সব কাহিনী। প্রকাশ করছে- কিভাবে ক্যািসনোতে জুয়ায় মানুষ আসক্ত হয়- কিভাবে কোথায় জুয়ার আসর বসে। কিভাবে বিত্তবান মানুষগুলো ক্যাসিনোর ছোবলে পড়ে সর্বস্ব হারা হয় সেই কাহিনীও জানছেন ডিবির তদন্তকারীরা। উল্লেখ্য, বুধবার সন্ধ্যায় গুলশান-২ এর নিজ বাসা থেকে খালেদ মাহমুদকে আটক করা হয়। অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে তাকে অস্ত্রসহ আটক করে র‌্যাব। তার বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র ও মানি লন্ডারিং আইনে তিনটি মামলা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে র‌্যাবের পক্ষ থেকে গুলশান থানায় মামলাগুলো করা হয়। রাতে তাকে আদালতে তুলে অস্ত্র ও মাদকের পৃথক দুই মামলায় সাতদিন করে ১৪ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গুলশান পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম। অন্যদিকে খালেদের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে অস্ত্র মামলায় ঢাকা মহানগর হাকিম বেগম মাহমুদা চারদিন ও মাদক মামলায় ঢাকা মহানগর হাকিম শাহিনুর রহমান তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিকে ওই এলাকা পরিদর্শন করে দেখা যায়-ফকিরেরপুলের ইয়ংমেন্স ক্লাব, আরামবাগ ক্লাব ও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সামনে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গত বুধবার র‌্যাবের অবৈধ ক্যাসিনো উচ্ছেদ অভিযানের পর ওই এলাকায় সকাল থেকে উৎসুক মানুষ ভিড় করলেও পুরো পরিবেশটা থমথমে। বেশিরভাগ ক্লাবেই দায়িত্বশীল কেউ নেই। স্টাফরা দায়িত্ব পালন করলেও তাদের মধ্যে আতঙ্ক। কখন আবার নতুন করে অভিযান শুরু হয়। বিশেষ করে ঘন ঘন পুলিশের টহল দেখে সাধারণ মানুষজনও ভীত সন্ত্রস্ত। ফকিরেরপুল, আরামবাগ ও মতিঝিলের ক্লাব পাড়া ঘুরে দেখা গেছে শুধু উৎসুক মানুষ। যাদের বেশিরভাগেরই অভিযোগ ক্লাবগুলোর এ জুয়ার আসরের কারণে নিঃস্ব হাজার মানুষ। বিভিন্ন ক্লাবের সামনে মানুষ জড়ো হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম দেখছেন। শুক্রবার বেলা দশটার সময় দেখা যায়- ইয়ংমেন্স ক্লাব ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সামনে র‌্যাবের গাড়ি। দুই ক্লাবের মধ্যেই র‌্যাব সদস্যরা অবস্থান করছেন। সাংবাদিকরা ইয়ংমেন্স ক্লাবে ঢুকতে গেলে এক র‌্যাব সদস্য জানান, ভেতরে সিলগালার কাজ চলছে। এখন ঢোকা যাবে না। একই ধরনের উত্তর পাওয়া গেছে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ঢুকতে চাইলেও। তারপরও নিজের প্রয়োজনে ঢুকতে হলে পারমিশন লাগবে বলে জানান এক র‌্যাব সদস্য। র‌্যাব জানিয়েছে- এ এলাকায় বেশকিছু ক্লাবের কার্যালয় থাকলেও অবৈধভাবে ক্যাসিনো চলছে ছয়টিতে। এর মধ্যে দুটিতে অভিযান হওয়ার পর বাকি চারটি নিজেদের উদ্যোগেই তালা মেরে রাখা হয়েছে। ডিবির একটি সূত্র জানায়- জিজ্ঞাসাবাদে মতিঝিলের ক্যাসিনো পরিচালনার বিষয়টি মতিঝিল থানা পুলিশ, মতিঝিল জোন, পুলিশ সদর দফতর ও ডিএমপি সদর দফতরের কর্মকর্তারা জানতেন বলে দাবি করেন খালেদ। তবে পুলিশের সঙ্গে ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য কোন আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলেননি তিনি। তার ক্যাসিনোর বিষয়ে পুলিশ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সংস্থা এবং রাজনীতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জানতেন। তাদের ‘ম্যানেজ করে’ ক্যাসিনো চালাত বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারও করে সে। এদিকে চাঞ্চল্যকর ক্যাসিনো সম্পর্কে পুলিশ সম্পর্কেও বেরিয়ে আসছে চমকপ্রদ তথ্য। পুলিশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ ছাড়া রাজধানীতে এ ধরনের নিষিদ্ধ ব্যবসা চালানো সম্ভব নয় বলে ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে। কমেন্টের পর কমেন্টসে খালেদ আর স¤্রাট চৌধুরির সব অপকর্মের দায় চাপানো হয়েছে পুুলিশ আর প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার ওপর। একজন লিখেছে- থানা পুলিশের নাকের ডগায়- স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে আশপাশের ব্যবসায়ীদের সবাই জানত এই ক্যাসিনোগুলোর জুয়া মদ ও নারী বাণিজ্যের খবর। আর এগুলো চালাত যুবলীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। অপর একজন লিখেছেন- ক্যাসিনো চক্র এতটাই বেপরোয়া ছিল যে- প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা না পেলে এখনও থাকত ধরাছোঁয়ার বাইরে। চার চারটি ক্যাসিনো নাকের ডগায় চললেও এবং দীর্ঘদিন ধরে এলাকাজুড়ে চাঁদাবাজি চললেও কোন ধরনের হাঁচি-কাশি দেয়নি মতিঝিল থানা পুলিশ। বরং জুয়ার টাকার বখরা পকেটে পুরে চোখ বন্ধ করে থাকত তারা, এমন অভিযোগ রয়েছে এই থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এলাকাবাসী জানিয়েছে- মতিঝিল থানার পাশেই ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ও দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব। বাইরে ক্রীড়াঙ্গনের মূলধারার ক্লাব হিসেবে পরিচিতি থাকলেও গত পাঁচ-সাত বছর ধরে এসব ক্লাবের মূল কর্মকা-ই ছিল ক্যাসিনো পরিচালনা ও জুয়া খেলা পরিচালনা। পাশাপাশি বিক্রি হতো বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। এর মধ্যে দুটি ক্লাবে ২৪ ঘণ্টাই ক্যাসিনো চলতো বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। ক্লাবের সঙ্গে জড়িতরা এখন বলছে- পুলিশকে ম্যানেজ করেই সব চলেছে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর যুবলীগের কয়েক নেতাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভ প্রকাশের চারদিনের মাথায় ১৮ এপ্রিল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চারটি ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় র‌্যাব। এর মধ্যে ফকিরাপুলের দুটি ক্যাসিনো সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। ক্লাবের আড়ালে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব ও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব দুটিকে র‌্যাব সিলগালা করলেও বাকি দুটি ক্লাবের কর্তৃপক্ষ নিজেরাই ক্লাব বন্ধ রেখেছে। তবে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ও দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব নামের এই দুটি ক্লাবেও ২৪ ঘণ্টা ক্যাসিনো চালানো বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। ক্লাবগুলোয় প্রতিদিন শত শত লোক আসত। কোটি কোটি টাকার জুয়া খেলত, মদ খেতো। এসবের নিয়ন্ত্রক ছিল খালেদ ও সম্রাট।
×