ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মালিক-শ্রমিকরা বড় বাধা

এক বছরেও সড়ক পরিবহন আইনের বিধিমালা হয়নি

প্রকাশিত: ১০:১৫, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 এক বছরেও সড়ক পরিবহন আইনের বিধিমালা হয়নি

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পাস হওয়ার এক বছর পূর্ণ হতে চললেও তা বাস্তবায়নে বিধিমালা তৈরি হয়নি এখনও। এর নেপথ্যে রয়েছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর তীব্র বিরোধিতা। ফলে যাত্রী নাকি শ্রমিক সংগঠনগুলোর স্বার্থ রক্ষা হবে এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। তবে শেষ পর্যন্ত আইনের কিছু ধারা সংশোধন করার ইঙ্গিত মিলেছে। তা চূড়ান্ত হবে আইন-স্বরাষ্ট্র ও রেল মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত সুপারিশের পর। তবে চাপের মুখে আইনের যেসব ধারা সংশোধন করার চিন্তা করা হচ্ছে এতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর স্বার্থ রক্ষা হবে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের দাবির প্রেক্ষিতে গত চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আইন বিশ্লেষণ করে তা বাস্তবায়নের সুপারিশের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি উচ্চপর্যায় কমিটি গঠন করা হয়। অন্য সদস্যরা হলেন আইন ও রেলমন্ত্রী। কিন্তু ৬ মাসের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত কোন প্রতিবেদন জমা দেয়নি ওই কমিটি। তাই এখন আইন বাস্তবায়ন না করে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সুপারিশ বাস্তবায়নের দিকে নজর দিচ্ছে সরকার। এর ফলে বিশৃঙ্খলা সড়ক ও পরিবহন সেক্টরকে শৃঙ্খলা ফিরানোর কাজ আরও দীর্ঘায়িত হবে। তবে আইন সংশোধনের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে বসার কথা সরকারী কমিটির। সকলের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মতামত নেয়া হবে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি বৈঠকও হয়েছে বলে জানা গেছে। অনেকের অভিমত আইনটি বাস্তবায়নে বাধা পরিবহন মালিক শ্রমিকদের দেয়া সুপারিশ। যা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এসব সুপারিশের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়া সময় সাপেক্ষ। বর্তমান সরকার তৃতীয়বার ক্ষমতার আসার পরও গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যর্থ হলে এর দায় সরকারকেই নিতে হবে। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের কাছে সরকারের অসহায়ত্ব প্রকাশ পাবে। তাছাড়া বিধামালা চূড়ান্ত না হওয়ার কারণে আইন কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও কঠিন। এই প্রেক্ষাপটে সড়ক ও পরিবহন খাতে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় বলে জানান পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, শীঘ্রই সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করা হবে। আইনটি কতটা যথোপযুক্ত করে প্রণয়ন করা যায় তা নিয়ে কাজ চলছে বলেও জানান তিনি। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ২৬তম সভায় তিনি আরও বলেন, এ আইন বাস্তবায়ন হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে, শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সবার মতামত নিয়েই আইনটি হচ্ছে। সড়ক পরিবহন আইনের কিছু ধারা নিয়ে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের আপত্তি ছিল, এগুলো পরিবর্তন হবে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, আইন ঠিক রেখে সমন্বয় করার চেষ্টা করা হবে। তবে বিষয়টি যেহেতু আইন প্রণয়নের, তাই আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেখবেন। তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন। এ বিষয়ে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামছুল হক বলেন, সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সুপারিশে কোন কাজ হয় না। একই সুপারিশ বারবার ঘুরে ফিরে আসে। বাস্তবায়ন হয় না। সুপারিশের ভারে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কুঁজো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। সড়ক নিরাপত্তার জন্য এ পর্যন্ত যতগুলো সুপারিশ করা হয়েছে। এর কিছু অংশ বাস্তবায়ন করা হলেও কিছুটা সুবিধা পাওয়া যেত। এক্ষেত্রে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ থেকেও একাধিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তাও বাস্তবায়ন হয়নি। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, যেমন ২২টি মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিক্সা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তা কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ৫ ঘণ্টার বেশি কোন চালক গাড়ি চালাবে না। তা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে? সড়ক আইন বাস্তবায়নে অনিহা ও আইন না মেনে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা যায় এসব কারণে শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না। দুর্ঘটনাও কমানো যাচ্ছে না। তাই এখন সুপারিশের থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাস্তবায়ন। বর্তমান সরকার একধারে তিনবার ক্ষমতায় আছে এখন একটি পর্যালোচনা করা দরকার। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য প্রথমবার কাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, দ্বিতীয়বার কে দায়িত্ব পালন করেছে। এখন তৃতীয়বার এ্যাকশনে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখনও যদি দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশ গ্রহণ করা হয় তাহলে তা বাস্তবায়ন হবে কবে? এর আগেও একাধিক সুপারিশ গ্রহণ হয়ে কিন্তু কার্যকর হয়নি। এর আগে ‘মোটর ভেহিকল অর্ডিনেন্স-১৯৮৩’ একাধিক বিধিমালা ছিল তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। তাই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য আইন বাস্তবায়ন আগ্রহী না। তাহলে ১০টি আইন করে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না। তাই এ ক্ষেত্রে সরকার প্রধানের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া পরিবহন সেক্টরের বড় বড় মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। জানা গেছে, গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’। কিন্তু ১২ মাস অতিক্রম হতে চললেও আইন বাস্তবায়নের বিধিমালা এখনও তৈরি করা হয়নি। আইন বাস্তবায়নে সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে চাপ থাকার কারণে বিধিমালা এখনও তৈরি করা হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। এছাড়া নতুন সড়ক পরিবহন আইনের বিভিন্ন ধারার বিরোধিতা করে আসছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। তারা আইনের বিভিন্ন ধারা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনেও নামেন। মালিক-শ্রমিকদের দাবির মধ্যে রয়েছে সড়ক পরিবহন আইনের সব ধারা জামিনযোগ্য করা, সড়ক দুর্ঘটনায় শ্রমিকের অর্থদ- পাঁচ লাখ টাকার বিধান বাতিল করা, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণী করা প্রভৃতি। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সচিবালয়ে এক বৈঠকে সাংবাদিকদের বলেন, সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নে আইনমন্ত্রী, আমি ও রেলমন্ত্রীকে নিয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়েছিল। আমরা বসেছিলাম। আইনটির যেসব বিষয়ে তারা (পরিবহন মালিক-শ্রমিক) আপত্তির কথা বলেছেন সব ধারা আমরা দেখেছি। আমাদের মনে হলো আমরা এটাকে আরেকটু ভাল করে দেখে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসে আমাদের মতামত প্রকাশ করব। (দাবিগুলো) আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছি, সব পয়েন্টই আলাপ করেছি। সবার কথা শুনে আমাদের মতামতটাও বলব। আইনে যদি কোন কিছু যোগ-বিয়োগ করতে হয় সেটা আমরা দেখছি। সেজন্য আইনমন্ত্রী মহোদয় আছেন মতামত দেবেন। আমরা তাদের দাবিগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি, দাবিগুলোর যৌক্তিকতা আছে কিনা দেখা হচ্ছে। আইন হয়ে যাওয়ার পর এভাবে বসার কোন সুযোগ আছে কিনা? এ বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আইন আইনের গতিতে চলছে। এটা গেজেট হয়ে যেখানে চলে যাওয়ার চলে যাচ্ছে। আইন বাস্তবায়নে কোন বাধা নেই। আমরা দেখছি, তারা যে আপত্তি করেছে সেটার কোন যৌক্তিকতা আছে কিনা। নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, আইন চূড়ান্ত হলেও বাস্তবায়নে বিধিমালা না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। যারা বাস্তবায়নে যাবেন তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন। তাই বিষয়টি রাজনৈতিক বিবেচনায় না দেখে প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিতে হবে। এতে যারা দুর্ঘটনার শিকার তারা উপকৃত হবেন। জানতে চাইলে সড়ক সপরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, আমরা আইনের বিরুদ্ধে নই। মানুষের বিরুদ্ধেও নই। আমরা চাই সকলের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হবে এমন আইনের বাস্তবায়ন। আমরা যেসব বিষয়গুলোতে সংস্কার প্রয়োজন মনে করেছি সেগুলোতে সংশোধনী চেয়েছি। এখন বিবেচনার দায়িত্ব সরকারের।
×