ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাথমিক শিক্ষা ॥ জাতি গঠনের প্রথম ধাপ

প্রকাশিত: ০৯:০১, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

প্রাথমিক শিক্ষা ॥ জাতি  গঠনের প্রথম ধাপ

প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে, একটি জাতি গঠনের প্রথম ধাপ। এই শিক্ষা কেন্দ্রের একজন শিক্ষক/শিক্ষিকা হচ্ছেন- একজন রিসোর্স পারসন বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যার শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে মানুষ দেশের এবং সমাজের উচ্চতরে অধিষ্ঠিত হন। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে যারা প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছিলেন, সেই ১৯৬২-৬৩ সালের দিকের কথা বলছি, তখন মনে মনে একটু পেছনে ফিরে দেখুন- তখনকার শিক্ষকরা কি প্রতিকূল অবস্থায় আমাদের লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। আমি যে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি সেই স্কুল ঘরটি ছিল ওপরে টিনের ছাদ আর চতুর্দিকে বাঁশের তরজার বেড়া। ভেতরে শ্রেণীকক্ষ আলাদা করা ছিল না। একেক শ্রেণীর জন্য ছাত্র সংখ্যা অনুপাতে বেঞ্চ স্থায়ীভাবে বসানো থাকত, বেঞ্চগুলো ছিল স্থানীয় প্রযুক্তি এবং স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থাৎ মুলিবাঁশ দিয়ে তৈরি করা। শুধু একপাশে যেখানে ৫ম শ্রেণীর ছাত্ররা বসত সেই ছাত্রদের সামনে একটি টেবিল ও একটি চেয়ার থাকত শিক্ষকের পড়ানোর জন্য। অন্য শ্রেণীর ছাত্রদের সামনে শুধু চেয়ার থাকত শিক্ষকের জন্য। স্কুলের মেঝে ছিল মাটি আর বালির। স্কুলের সীমানার মধ্যে কোন নলকূপ বা পানির উৎস ছিল না। অবশ্য তখন অত্র অঞ্চলে পুকুরের পানি ছাড়া পানি পান করার কোন ব্যবস্থা ছিল না তাই স্কুলের পাশের বাড়িতে গিয়ে পানি পান করতে হতো। স্কুলে ছিল না কোন বাথরুম। বুঝতেই পারছেন কি পরিস্থিতিতে শিক্ষকগণ ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দিতেন। তাছাড়া রাস্তা-ঘাট না থাকায় শিক্ষকরাও হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতেন। অরক্ষিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর এমন অবস্থা ছিল যে- কখনও আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলে শিক্ষকরা ক্লাস শেষ হওয়ার পূর্বেই স্কুল ছুটি দিয়ে দিতেন- যাতে করে ছাত্র-ছাত্রীরা নিরাপদে বাড়ি যেতে পারে। এখনকার মা-বাবার মতো স্কুলে গিয়ে কোন অভিভাবক তাঁর ছেলে-মেয়েকে নিয়ে স্কুলে উপস্থিত হতে দেখা যেত না। তারা স্কুলের শিক্ষকদের ওপর ছেলে-মেয়েদের দেখাশোনার দায়িত্ব ছেড়ে দিতেন, তখন শিক্ষকদের দায়িত্বশীলতার কারণে দেশের লাখ লাখ মানুষ শিক্ষিত হতে পেরেছে। দেশে মোট ৬৩০৪১টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক/শিক্ষিকা যারা দেশের আগামী দিনে বাংলাদেশের উন্নয়নে নিজেদের মেধার স্বাক্ষর রাখবে এবং দেশকে একটি সুন্দর পরিবেশসহ একটি উন্নয়নমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করবেন, নাগরিককে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য নিজেদের জীবনবাজি রেখে বছরের পর বছর কাটাচ্ছেন; তাদের জীবনে একটু স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসুকÑ তা সকলেই প্রত্যাশা করে। প্রাথমিক শিক্ষক/শিক্ষিকারা সমাজে একেবারে ক্লিন ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাদৃত। তারা কেউ কোন রকম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নয়, প্রাইভেট টিউশনি করার জন্য বাড়িতে স্কুল খুলে ব্যবসার সুযোগও তাদের নেই। শিক্ষকতা করতে গিয়ে বিশেষ করে গ্রামের শিক্ষকরা নিজের কৃষি কাজও ঠিক মতো করতে পারেন না। তাই তাদের পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়ার খরচসহ সকল খরচ এই বেতন দিয়েই চালাতে হয়। এতে অনেকেরই অভাব আর যায় না। অভাব থেকে মুক্তি পেতে তারা দাবি জানিয়ে আসছে বেতন স্কেল বাড়ানোর। সম্প্রতি পত্রিকায় দেখলাম, বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তার পদমর্যাদা ঘোষণা দিলেও তারা এখনও জাতীয় বেতন স্কেলের ১১তম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্যান্য সরকারী দফতরের কর্মকর্তারা বেতন পান দশম গ্রেডে এবং সহকারী শিক্ষকরা বেতন পান ১৪তম গ্রেডে । এই অসঙ্গতি দূর করার জন্য তাদের যথাক্রমে ১০ম এবং ১২তম গ্রেডে উন্নতি করার প্রস্তাব করা হয়। কারণ, সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকের বেতনের ব্যবধান কয়েক গ্রেড। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকের অনেকেই স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। সম্প্রতি শিক্ষক সমিতির সভাপতিসহ ৪৫ জন শিক্ষক হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১০ম গ্রেডসহ গেজেটেড পদমর্যাদা দেয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। রায়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণবিহীন উভয় প্রধান শিক্ষকদের প্রবেশ পদে বেতন স্কেল ১০ম গ্রেডসহ গেজেটেড পদমর্যাদা ২০১৪ সালের ৯ মার্চ থেকে কার্যকর করতে নির্দেশ দেয়া হয়। আদালতের রায়ের আলোকে এবং শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২৯ জুলাই, ২০১৯ বেতন বৈষম্য দূর করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। যতদূর জানি, এখনও বিষয়টি সুরাহা হয়নি। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। যথোপযুক্ত বেতন পাওয়া তাদের ন্যায্য দাবি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য তাই পৃথিবীর অনেক দেশেই সকল বিভাগের চেয়ে বাজেট বেশি করে রাখা হয়। বর্তমানে প্রধান শিক্ষক/শিক্ষিকাকে আগের চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয় যা পূর্বে ছিল না। আমরা মনে করি, বিষয়টির দিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দৃষ্টি দেবেন। এতে শিক্ষক সমাজের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি বাড়বে। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী
×