ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

‘জাতিসংঘের অগ্নিপরীক্ষা’ ॥ ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:০১, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

‘জাতিসংঘের অগ্নিপরীক্ষা’ ॥ ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল মঙ্গলবার। আজ বহুল আলোচিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়েছে। বিশ্বের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিগণ প্রতিবারের মতই এবারও বিশ্ব সম্মেলনে যোগদান করেছেন। কিন্তু এবারে জাতিসংঘ সম্মেলনে আরও একটি নতুন স্বাধীন দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছেন। এ দেশটি হলো স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। যদিও জাতিসংঘের সদস্যপদ তার অর্জিত হয়নি। পৃথিবীর কোন দেশের কাছ থেকে এখনও রাজনৈতিক স্বীকৃতি পায়নি, তবুও বিশ্ব প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশ তার নিজস্ব গণতান্ত্রিক অধিকারেই হাজির হয়েছে। এ দিন সকাল ৯ টায় ময়মনসিংহের ভালুকা ঘাঁটি থেকে প্রায় চার শতাধিক রাজাকার পাকবাহিনীর একটি দল ৪ ভাগ হয়ে বড়াইদ এলাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বড়াইদ গ্রামে আফছার ব্যাটালিয়নের কোম্পানি হেডকোয়ার্টার ছিল। পাক বাহিনীর আসার খবর পেয়ে কোম্পানি কমান্ডার মোমতাজউদ্দিন খান, প্লাটুন কমান্ডার সামছুদ্দিন, মনির উদ্দিন, মোঃ মোতালিব মাস্টার ও হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে পাক বাহিনীর ৪টি রাস্তা প্রতিরোধ করে। দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা গুলিবিনিময়ের পর পাকবাহিনী ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে ১৪ জন পাক সেনা নিহত হয়। ২নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর ২-৩শ’ গেরিলার একটি দল পালং থানায় অবস্থানরত পাকবাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই যুদ্ধে ৫০ জন পাকসেনা, রাজাকার ও পাক পুলিশ নিহত হয়। মেজর দূররানির নেতৃত্বে হানাদার পাকবাহিনী ৩৩ বেলুচের রেজিমেন্টের ‘বি’ এবং ‘ডি’ কোম্পানি চাঁদলা থেকে চারটি নৌকায় করে মন্দভাগ আসছিল। মুক্তিফৌজের বাছাই করা একটি প্লাটুন সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে মন্দভাগ শালদা নদী এলাকায় অবস্থান নেয়। আর একটি সেকশন গ্রামের এক পাশে ডানদিকে এবং অপর একটি সেকশন বাম পাশে অবস্থান নেয়। রাত একটার সময় শত্রুরা মেজর দূরবানির নেতৃত্বে মুক্তিফৌজের অবস্থানের দিকে নৌকাযোগে এগুতে থাকে। যখন হানাদাররা মুক্তিফৌজের প্রতিরক্ষা ব্যূহের ২০-২৫ গজের মধ্যে এসে গেছে, তখন ক্যাপ্টেন গাফফারের দল তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এ গুলিবর্ষণের ফলে প্রথম সারির সবাই আহত-নিহত পড়ে যায় এবং পিছনেরও অনেকে হতাহত হয়। ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে মুক্তিফৌজ ৬টি এমজিআই-এ-৩ ৩৭ /৩৮ টি জি-৩ রাইফেল, ৫টা পিস্তল, চাইনিজ স্টেনগান ৮টা, ৩.৫ ইঞ্চি রকেট লাঞ্চার, ১টা ক্যমেরা, ১টা বাইনোকুলার, ২টা ক্যাম্পাস, ম্যাপ ও ৫-৬ হাজার গোলাবারুদ দখল করে নেয়। পাকহানাদার বাহিনী হরিরামপুর থানার বল্লা গ্রামে লুটপাট করতে এলে মুক্তিবাহিনীর বীরযোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করে। এতে দুজন পাকসেনা নিহত হয়। হানাদার বর্বররা কাপুরুষের মতো নিরস্ত্র গ্রামবাসীর ওপর এর প্রতিশোধ নেয়। পাকহানাদারদের পৈশাচিক নির্যাতনে ১৬ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী বরগুনা জেলার পাথরঘাটা অঞ্চলে পাক হানাদারদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিফৌজের সি’ কোম্পানির একটি প্লাটুন লেফটেন্যান্ট কাইয়ূম চৌধুরীর নেতৃত্বে রৌমারীর চর কোদালকাটিতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। হানাদার বাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য মর্টারের সাহায্যে মুক্তিফৌজের চরকোদাল ঘাঁটি আক্রমণ করে। মুক্তিফৌজের সৈন্যরা অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে তাদের আক্রমণকে ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়। এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের প্রায় ৩৫ জন সৈন্য নিহত হয়। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ সভায় উপস্থিত বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিনিধিবৃন্দ তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী আর্মির নৃশংসতার ফলে সৃষ্ট বাঙালী শরণার্থী সমস্যা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আজ (২১ সেপ্টেম্বর) শুরু হওয়া ১৩০ সদস্যবিশিষ্ট সাধারণ সভা চলবে ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত। যে সকল প্রতিনিধি ইতোমধ্যে বক্তব্য দিয়েছেন, তারা পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন যেন নব্বই লাখ বাংলাদেশী শরণার্থীর জন্য তাদের বাড়ি ফেরার উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। আমেরিকার স্বরাষ্ট্রসচিব, উইলিয়াম পি. রজারস বাংলাদেশে চলমান সমস্যার ‘একটি কার্যকর রাজনৈতিক নিষ্পত্তির প্রচেষ্টা’ চালানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরিস সুমান বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত সমাধানের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, পাকিস্তান যে অন্যায় করেছে, তা শুরুতেই শুধরানো না হলে বাংলাদেশীদের দেশত্যাগ বন্ধ হবে না। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং জাতিসংঘের প্রতি ইসলামাবাদের সামরিক শাসকদের ওপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, শক্তির প্রয়োগ সফল হবে না, তাই সামরিক শাসক ও ইতোমধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি আবশ্যক। কানাডার প্রতিনিধি দলের প্রধান প্রশ্ন করেছেন, ‘কোন পর্যায়ে পৌঁছালে একটি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এতগুলো জাতিকে এত বেশি প্রভাবিত করে যে তাকে আর ঘরোয়া ব্যাপার বলা যায় না?’ জাপান বিশ্বের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এছাড়াও পোল্যান্ড, হল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, নরওয়ে, সুইডেন, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, নেপাল, জাম্বিয়া, ইতালি, নিউজিল্যান্ড এবং লুক্সেমবার্গ বাংলাদেশ সমস্যার একটি যথোপযুক্ত রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে পৌঁছার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়ার সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। রেডিও পাকিস্তান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রহসনমূলক বিচার বিষয়ে আরও একটি নির্লজ্জ মিথ্যা বক্তব্য প্রদান করেছে। গতকাল প্রচারিত সংবাদে দাবি করা হয়েছে যে, শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর বিচার করার এখতিয়ারবিহীন আদালতে যিনি এর আগে আত্মপক্ষ সমর্থনে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন বলে এক সূত্রে প্রকাশ করা হয়েছিল, সেই একই সূত্রে প্রকাশ পেয়েছে যে তিনি তার মামলায় লড়ার জন্য তিনজন আইনজীবীর একটি প্যানেল দাবি করেছেন। রেডিওতে আরও দাবি করা হয়েছে যে, শেখ সাহেবের কথিত পছন্দের তিনজন আইনজীবীর একজন এ কে ব্রোহী তার পূর্বের অঙ্গীকারবদ্ধ মামলাগুলোর ব্রিফিং নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। স্বাধীনবাংলা বেতারে প্রচারিত কথিকায় বলা হয়, সামরিক ডিক্টেটর আইয়ূব খানকে তাড়িয়ে নাঙ্গা তলোয়ার হাতে তারই প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চের রাতে যখন পি-ির সিংহাসনে বসলেন, সে সময় এই মিথ্যাশ্রয়ী জেনারেল বিক্ষুব্ধ জনসাধারণকে শান্ত করার জন্য সভ্য জগতের শাসকদের অনুকরণে কোমল ভাষায় দর্শনসম্মত বাণী উচ্চারণ করতে শুরু করেন। গণতান্ত্রিক নির্বাচন, জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত শাসনতন্ত্র ও ন্যায়নীতির শাসন প্রতিষ্ঠার কথা তিনি অহরহ প্রচার করতেন। বাংলার বাণী পত্রিকায় ‘জাতিসংঘের অগ্নিপরীক্ষা’ শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে বলা হয়, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ আজ বৈঠকে মিলিত হয়েই সর্ব্রাগ্রে যে জটিল রাজনৈতিক ইস্যুটির জ্বলন্ত সূর্যের মুখোমুখি হবে তা হলো স্বাধীন বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। বাংলার বাণী পত্রিকায় ‘বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় কি দেখিলাম’ শিরোনামে প্রকাশিত অপর প্রতিবেদনে আরও বলা হয় : অতি সম্প্রতি ‘বাংলার বাণী’-র একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা সফর করে ফিরে এসেছেন। সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধি যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন তারই শেষ অংশ এখানে ছাপা হল। অধিকৃত এলাকায় পাকসেনারা যথেচ্ছাভাবে স্থানীয় অবাঙ্গালী কুলি-কামিন এবং চোর-ডাকাত, গুন্ডা-বদমায়েশদের নিয়ে বদর, রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনী গঠন করছে । তাদের সাথে কিছু মুসলিম লীগ ও জামায়াতের গুন্ডা-পান্ডাও যুক্ত হয়েছে। তারা পাকবাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় যে ঘৃণ্য কেলেঙ্কারির ইতিহাস সৃষ্টি করছে তা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় ‘বিশ্বের প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় : বাংলাদেশকে নিয়ে করা আন্তর্জাতিক সম্মেলনের পক্ষ থেকে বিশ্বের সব দেশের সরকারকে আজ আহ্বান জানানো হয়েছে বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে এবং পশ্চিম পাকিস্তানী জান্তার প্রতি সব ধরনের সামরিক সাহায্য বন্ধ করতে। এই সম্মেলনের এক প্রস্তাবে ঘোষণা করা হয় যে- বাংলাদেশের মানুষের এই রাজনৈতিক আন্দোলন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখতে হবে একটি জাতির মুক্তির আন্দোলন হিসেবে। বিশ্বের সকল সরকার ও জনগণের কাছে উদাত্ত আহ্বান জানানো হয় বাংলাদেশ তাৎক্ষণিক এবং কার্যকরী সহায়তা প্রদানের জন্য। উক্ত প্রস্তাবে বর্ণিত এই সাহায্য বলতে কোনো রাষ্ট্র বা ব্যক্তির জন্য এটা সামরিক সাহায্য হতে পারে আবার কারও জন্য হতে পারে অর্থনৈতিক এবং অহিংস সাহায্য। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×