ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কিছু জানা কিছু অজানা

প্রকাশিত: ০৯:০০, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে  কিছু জানা কিছু অজানা

অতলান্তিক সমুদ্রের খোলা হাওয়া পালে লাগিয়ে এই লেখাটি যখন লিখতে বসেছিলাম তখন স্বভাবতই মনে পড়ছিল ‘রবি কবির গান’ কি গাব আমি কি শোনাব, আজি আনন্দধামে! জাতিসংঘের এবারের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে বাংলা দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুনিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানদের অন্যতম হয়ে বিশ্বের এমন শীর্ষ ফোরামে যোগ দিতে আসছেন আমাদের নগরে। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সাল থেকে দেশের তিন তিনবারের নির্বাচিত সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা রেকর্ড সংখ্যক সময়ে এসেছেন ইস্ট রিভার ঘেঁষা বিশ্বভবনটিতে। এছাড়াও প্রবাসী বাঙালী অধ্যুষিত এই বিশ্ব বাণিজ্য রাজধানীতে বহুবারই হয়েছে তাঁর আগমন এবং সেই উপলক্ষে কমিউনিটিতে বয়ে গেছে আনন্দলহরী। কথা ছিল প্রধানমন্ত্রীর এবারের আগমনটিতে পরিচিত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে মিশবে রংধনুর বর্ণাঢ্যতাও। সাম্প্রতিক আমরা প্রবাসীরাও অভিভূত-বিশ্বের নারী সরকারপ্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন দেশ পরিচালনায় ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচার ও শ্রীলঙ্কার চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার মতো অসাধারণ জনপ্রিয় নেতাদের রেকর্ড টুকরো করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে নিয়েছেন অনন্য সাধারণ উচ্চতার আসনে। উপরন্তু নগরে অবস্থানকালীন পালিত হতে যাচ্ছে তাঁর জন্মদিন। বরাবরের চাইতে আরও বৃহৎ আকারে শেখ হাসিনাকে সম্ভাষণ জানানোর জন্য সংবর্ধনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রবাসী সমাজে চলছে সাজসাজ রব। কিছু বাংলা সাপ্তাহিকে প্রধানমন্ত্রীকে উপলক্ষ করে সংযোজিত হচ্ছে বিশেষ সংখ্যা। প্রতিবার প্রধানমন্ত্রীর বিরোধিতাকারী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও তার আগমন উপলক্ষে রুটিন মাফিক বিরুদ্ধ মিছিল থেকে প্রতিবাদী স্লোগানও ওঠে। কিন্তু কমিউনিটির সাপ্তাহিক মিডিয়াগুলোতে অদ্যাবধি সেরকম বড়সড় উদ্যোগ কিংবা আয়োজনের তৎপরতা চোখে পড়ল না। হয়ত ঘরেই যখন বিভীষণের বসবাস তখন বাইরের শত্রুতা অনাবশ্যক বৈকি। প্রধামন্ত্রীকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য আওয়ামী লীগ দল বিভক্ত হয়ে গেছে দুটি শাখায় এবং দুঃখজনকভাবে চলছে পরস্পরের বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতির কাদা ছোড়াছুড়ি। অথচ প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলকক্ষে নিয়ে একটা লেখা শুরু করার ইচ্ছায় এক সুদূরে ভেসে যাচ্ছে যে আমার কলম! আমি কোনকালেই রাজনীতির কেউ নই; কিন্তু তাঁর আসন আমার হৃদয়ের অন্তস্তলে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে একবার কমিউনিটিময় হাওয়া থেকে পাওয়া একটি সংবাদ দিয়েই বরং লিখতে শুরু করি। এই শহরে অন্তত জাতিসংঘে যোগ দিতে আসা দেশ-বিদেশের কোন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি এমন কোন জম্পেশ খবরের জন্ম দিয়েছেন বলে জানি না। সেটা হলো, শনি কিংবা রবিবারের এক ছুটির দিনে হঠাৎ করে মুখে মুখে কমিউনিটিতে চাউর হয়ে গেল নিউইয়র্কের যে অভিজাত হোটেলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা উঠেছেন সেখানে তিনি রান্না করার উদ্যোগ নিচ্ছেন নিজ হাতে। সেই উপলক্ষে সবজি, চাল, তেল, মসলা, লবণ, মাংস ইত্যাদিসহ প্রয়োজনীয় সকল উপকরণ কেনা হয়েছে। ছুরি দিয়ে নিজ হাতে পেঁয়াজ কেটে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে চামচ-খুন্তি হাতে প্রধানমন্ত্রীর রান্না করার বিস্তারিত খবর নিয়ে কমিউনিটিজুড়ে শুরু হলো হৈ হৈ রৈ রৈ উত্তেজনা। অতঃপর সে রান্না সাঙ্গ করে তিনি একাকী তো নন খেয়েছিলেন সকল সফরসঙ্গী এবং দলের প্রবাসী হেন-তেনরা পর্যন্ত। প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়েছিল এর বহুদিন আগে সত্তর দশকের শুরুতে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ এলাকার ছোট গ্রাম ফতেপুর থেকে এসেছিল এক দারুণ উত্তেজনাকর সংবাদ। রংপুর জেলার গর্ব ড. এমএ ওয়াজেদের হাঁড়ির খবর রাখা আত্মীয়বর্গ তারা কেউ কেউ মিঞাবাড়ির সে ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বিশেষত মেয়েরা কেউ কেউ দম পর্যন্ত ফেলার ফুরসত পায়নি। সেরকম একজনের কাছে খবর মিলল শেখ মুজিবুরের মেয়ে- যে সুধা ভাইয়ের নতুন বউ, শ্বশুরবাড়িতে পা রেখে কোমরে আঁচল বেঁধে প্রথমে ঢুকে পড়েছে পাকশালে। ফতেপুরের লোকজন তো তখন জানত না ধানম-ি বত্রিশ নম্বর রাস্তার যে বাড়িটিতে শুধু মিঞার বউ বড় হয়ে উঠেছেন সে বাড়ির হেঁশেলটির দায়িত্ব আজীবন বহন করে গেছেন তাঁর মাতা বেগম মুজিব। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু যখন সম্ভবত সরকারপ্রধান কিংবদন্তির সেই বাড়িতে ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সাক্ষাতকার গ্রহণ করতে এসেছিলেন তদানীন্তন বিশ্বের খ্যাতিমান নারী সাংবাদিক ওরিয়ানা ফ্যালাসি। সমালোচনার সঙ্গে তিনি লিখেছিলেন- বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের স্ত্রী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আঁচলে হলুদের দাগ মুছতে মুছতে সাক্ষাতকার দিতে এসেছিলেন ওরিয়ানার কাছে। ভারতের প্রবাসী জীবন থেকে যখন দলের অনুরোধে দেশে ফিরে এসেছিলেন তখন নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বী আঁতেলরা বঙ্গবন্ধুকন্যার দৃঢ়তা দেখে বিভিন্ন সময় বলতেন ‘সি হ্যাজ টু গো ব্যাক হার কিচেন।’ অবশ্য পরবর্তীকালে তাদের অনেকেই শিং ভেঙ্গে হয়ে গিয়েছিলেন হাসিনা সরকারের কিচেন ক্যাবিনেটের সদস্য। সরকারের শীর্ষ আসনে যাওয়ার পরও শেখ হাসিনা কিচেন যে কদাপি ছাড়েননি সেটা ১/১১-এর বন্দী জীবনে কর্তৃপক্ষের কাছে একটি রান্নাঘর চাওয়ার মধ্য দিয়ে লোকজন বুঝেছে। তবে রাঁধুনি হিসেবে নয় ছাত্রনেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার বিষয়ে শুনেছিলাম রংপুরের জীবনে। সময়টা ছিল ষাটের দশকের মধ্যভাগ শুরু হওয়ার আগে আগে। আমাদের শহরের মেয়েরা মুষ্টিমেয় হলেও তখন শুধু মেডিক্যাল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া নয়, স্কুলের পর্ব শেষ করেই কলেজে ভর্তি হতে ঢাকায় পাড়ি দেয়া শুরু করেছে। পাশের বাড়ি থেকে বেবি, রুবি নামে দুই বোন একই সঙ্গে এসএসসি পাস করে মেয়েদের স্বনামখ্যাত মহিলা কলেজ ইডেনে পড়তে ঢাকা শহরে চলে গেল। আমি ও আমার স্কুল পড়ুয়া একগুচ্ছ বন্ধু হাসিনা শেখ নামের ইডেন কলেজে অধ্যয়নরত একটি তরুণীর কথা প্রথম শুনি ওদেরই কাছে। বেবি, রুবিরা ছুটিতে বাড়ি এলে যে রাজধানীর বুকের ভাষা আমাদের অজানা, যে অবাক করা শহর আমরা দেখিনি, খাইনি তার ইগলু আইসক্রিম, চড়িনি যার বেবিট্যাক্সি- কত কিছুরই গল্প শোনায় তারা। সেইসঙ্গে আরও উত্তেজিত কণ্ঠে শোনায় তাদের কলেজ জীবনের নানা কথা। আমরা যারা ছোট সেই মফস্বল শহর রংপুরের স্কুলছাত্রী তারা ওদের মুখ থেকে পরম আগ্রহে ইডেন নামের এক স্বপ্নময় কলেজের নানা গল্প শুনি। একবার ওরা শোনাল তদানীন্তন সময়ে অনুষ্ঠিত কলেজ ইলেকশনের গল্প। পড়াশোনা করতে গিয়ে আবার নেতা-নেত্রী নির্বাচিত হয় নাকি! সেটা তো আমাদের জ্ঞানের ভাণ্ডারে ছিল না। ওরা সংবাদ দিয়েছিল হাসিনা শেখ নামে এক দুর্দান্ত তরুণী নেত্রী অগ্নিপুরুষ শেখ মুজিব যার পিতা, ইডেন কলেজের ভিপি হিসেবে ছাত্রলীগ থেকে সেবারের নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছে। সময়টিতে আমাদের বাড়িতে দৈনিক খবরের কাগজের সঙ্গে রাখা হতো ‘ললনা’ বলে একটি অতি জনপ্রিয় মহিলা পত্রিকা। ললনাতেও এ বিষয়ে একটি সংবাদ দেখলাম। সঙ্গে দেখলাম একগুচ্ছ মেয়েকে আশপাশে নিয়ে ক্ষীণাঙ্গিনী বড়সড় চশমা পরা ইডেনের নির্বাচিত ভিপি হাসিনা শেখের পাতাজোড়া ছবি। এর পরপরই শুরু হলো দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশাল ঝড়োহাওয়া তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর ওই বেবি, রুবিরা এর পরপরই পরিবারসুদ্ধ পাকাপাকিভাবে চলে গিয়েছিল ঢাকায়। দোর্দ- প্রতাপ রাজনীতিবিদ জেলবন্দী পিতার কন্যা ইডেন ছাত্র নেত্রী হাসিনা শেখের খবর তখনকার মতো সেখানেই হয়েছিল সমাপ্ত। কোনরকম খবর দেয়ার জন্য আশপাশে আর কেউ ছিল না রংপুরে। শেখ হাসিনার সেই রাজনৈতিক জীবনের শুরুর কথা জানলেও সেটির শেষের কথাটুকু বহু বছর পর জানলাম ১৯৯১ সালে মুদ্রিত তাঁর স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী এমএ ওয়াজেদের সুবিখ্যাত বইটিতে। যেখানে তিনি লিখেছেন, যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো বিয়ের জন্য কেমন মেয়ে তার পছন্দ তখন তরুণ বিজ্ঞানীর উত্তর ছিল ‘মেয়েকে আনস্মার্ট কিংবা কোটিপতির কন্যা হওয়া চলবে না। পাত্রকে সেইরকম এক কন্যাকে দেখানো হলো একদিন। কলেজ ফেরত পাত্রী, এ ঘটনাটির কিছুই অবগত নয়। সে ঘরে ঢুকেই নানাজনের মাঝে খাবার টেবিলে ধপ করে বসে পড়ে বলেছিল ‘বা বা কিছুক্ষণ আগে কলেজ সংসদের সহসভাপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করে আমি মুক্ত হলাম!’ শুধু কলেজ ইউনিয়নের নয়, সে সময়েই ঘটল সে যাবত রাজনৈতিক জীবনের ইতি ঘটিয়ে সংসার জীবনে প্রবেশ। তারপর রংপুর শহরে আচমকা একদিন লোকমুখে খবর এসেছিল জেলার পীরগঞ্জ নামে এলাকাটির ফতেপুর নাম গ্রাম হাসিনা শেখের অন্যতম ঠিকানা হয়ে গেছে। আমার নানা-নানির দেশের বাড়ি পীরগঞ্জেই এবং শহরের কাজে এসে এই খবর নিয়ে বাড়ি এসেছিলেন এক আত্মীয়। যিনি বললেন- আমাদের কাদের মিঞার তুখোড় মেধাবী ছেলে ড. ওয়াজেদের সঙ্গে শেখ মুজিবুরের বড় মেয়ে হাসিনার বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে ঢাকায়। বিয়ের আদি-অন্ত জানা সংবাদ বাহক আরও বললেন, সুধা মিঞা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফএইচ হলের ভিপি তখন থেকেই শেখ সাহেব তাকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। তারপর শেখ যখন জেলখানায় তখন ছাত্র রাজনীতি করার অপরাধে সুধাকেও জেলে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল। তখন মুজিব ওয়াজেদকে আরও আপন ভাবতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু সম্বন্ধটা ঠিক করেছেন পীরগঞ্জের জাপানী মতিয়ার সাহেব। উল্লেখ্য, সে সময় ঢাকা চেম্বার্স অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আওয়ামী লীগ দলের একজন প্রভাবশালী সদস্য পীরগঞ্জের মতিয়ার রহমান- দেশ স্বাধীনের পর হয়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। জাপানের সঙ্গে তার ব্যবসা থাকা এবং জাপান ভ্রমণ নিয়ে এলাকায় লোকমুখে তিনি এই নামে পরিচিত ছিলেন। কারণ গ্রামে ছিলেন আরও কয়েক মতিয়ার রহমান। পীরগঞ্জের মানুষ ধনী-মানি জোতদার মিঞাবাড়ির কাদের মিঞার বংশকে চেনেন-জানেন দীর্ঘদিন ধরে। সেইসঙ্গে তারা শিক্ষিত ঘর বলে সুপরিচিত। বাড়ির ছেলে ওয়াজেদ সাহেব পাকিস্তানী তীব্র অসহযোগিতার মুখেও লন্ডন থেকে পিএইচডি করেছেন। ঢাকার এ্যাটমিক এনার্জিতে তিনি তখন সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য আত্মীয়ের কাছ থেকে আরও জানা গেল সুধার বউকে বিবাহের সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি আনা সম্ভব হয়নি। কারণ, মেয়ের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান জেলে থাকার প্রেক্ষিতে মেয়ে সম্প্রদান হয় কিভাবে? দেশজোড়া সবাই জানেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেলবন্দী করে মুজিবকে পাকিস্তানীরা চড়াতে চেয়েছিল ফাঁসির দড়িতে। কিন্তু দুর্বার গণআন্দোলের মাধ্যমে মুজিবের মুক্তি আনল দেশবাসী। এর পরই নানা হৈচৈয়ের মধ্য দিয়ে বধূবরণের জন্য পরলোকগত কাদের মিঞার ঘরবাড়ি নতুন করে সাজানো-গোছানো শুরু হলো। সেটা তো ডিজিটাল এজ ছিল না। তারপরেও গ্রামের মানুষের মুখে মুখে শেখের মেয়ের শ্বশুরবাড়ি আগমনের নানা খবর তার আচার-আচরণ ভদ্রতার কথা এখনকার ভাষায় ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে যায় সারা গ্রামে। সেখান থেকে ভেসে আসে রংপুরের পীরগঞ্জ নিবাসী লোকজনদের বাড়িতে বাড়িতে। লোকে তো জানে এক সময়ের সম্পন্ন ওই জোতদার পরিবারে অন্যান্য বউঝির মধ্যে কখনও উনুনের আগুনের পাশে যাওয়ার রীতি ছিল না তখনও। এক-দুই করে কারও কারও কাছে আশ্চর্যভাবে শহরে আরও জানা গেল শুধু তাই নয়, অন্যান্য বউঝির রন্ধনশালায় না ঢোকাকে অগ্রাহ্য করে শেখের মেয়ে নাকি খড়ির চুলার কালি ধোঁয়া উপেক্ষা করে কেবল রান্না করা নয়, বাড়িসুদ্ধ লোককে পর্যন্ত খাওয়াচ্ছে তার সেই অপূর্ব স্বাদের রান্না। আরও অবাক কা-ের কথা যেদিন সকালে বাসে করে সুধার বউ বাপের বাড়ি ঢাকায় রওনা দেয় সেদিনও কি বাদ থাকে? কাকডাকা ভোরে উঠে রান্নাবান্না শেষ করে তবেই তার রেডি হওয়া এবং বাসে করে বিদায় নেয়া। মনে রাখা ভাল শেখ মুজিব তখন বাংলার জনমানুষের রাজাধিরাজ- তিনি বঙ্গবন্ধু। অবশ্য ফতেপুর গ্রামের সাধারণ মানুষের সেইসব জানার কথা নয় যে, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাদের আসা-যাওয়া ছিল তাদের সবারই মুখে মুখে বত্রিশ নম্বর রোডের বাড়ির খাবার টেবিলের অসংখ্য বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার কত যে কথা আছে। পরিবার ও দলের দুঃসময়ে নির্মিত সে বাড়ির মাত্র ২৫/৩০ ফুট বসার ঘরের লাগোয়া খাবার ঘরের রয়েছে অসংখ্য ইতিহাস। হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস জোছনা ও জননীর গল্প উপন্যাসে মজার এক কাহিনী আছে। সময়টা ছিল একাত্তর সালের উত্তাল মার্চ মাস। পাকিস্তানীরা ওই বাড়িতে গুপ্তচর হিসেবে পাঠিয়েছে ডিআইবির একজন বাঙালী পুলিশকে। মুজিব অনেক সকালে তাকে দেখতে পেয়ে তখন জিজ্ঞেস করলেন তার পরিচয়। সত্য জবাব দেয়ার পর সে বলল- কিন্তু স্যার আমি আপনার হুকুমে কাজ করি, যা নির্দেশ করবেন তাই করব। খুব গম্ভীর হয়ে মার্চের মহানায়ক বললেন- আমি যদি এ বাড়ির তিনতলা থেকে লাফ দিতে বলি? ডিআইবি বললেন- তাই দেব স্যার। মুজিব তাকে লাফ দেয়ার জন্য সঙ্গে নিয়ে তিনতলার দিকে যেতে যেতে দোতলার ঘরে ঢুকে খাবার টেবিলে বসতে বসতে বললেন- কামালের মা এ আমার একটা ভাই, আমাদের দুজনকে নাশতা দাও। শুধু কি সেই আমলে? হাসিনা আমলেও বঙ্গবন্ধুর ওই বাড়িতে আপামর মানুষের সঙ্গে সাধারণ পুলিশকে খাওয়ানোর ঐতিহ্যের বিষয়টি পুলিশের এক বড় কর্তা কথায় কথায় জানিয়েছিলেন আমার তদানীন্তন অফিসে। এরশাদ আমলে সে সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রধান দু’জনেই ছিলেন গৃহবন্দী। তাদের নিরাপত্তায় দুটি পৃথক দল নিয়োজিত ছিল ৩২ নম্বরে এবং ক্যান্টনমেন্টে। তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন পুলিশ দলের মধ্যে যাদের ধানম-িতে ডিউটি হতো তাদের উৎসাহের কমতি ছিল না। এর অন্যতম কারণ হলো সেটা ছিল রমজান মাস এবং ইফতারির পবিত্র সময় আসার আগে শেখ হাসিনা নিচে নেমে নিজেই তদারকি করতেন পুলিশ দলের ইফতারির ব্যবস্থাকে। তারপর তিনি যেতেন আপন ইফতারিতে। সেই কর্মকর্তার বক্তব্য অনুসারে বিপরীত প্রান্তে লাট-বেলাটসম ওপর বাড়িটিতে ইফতারিকালীন চাকর-নফরদের হাতে পুলিশ দলের হেনস্তার যে বিবরণ তিনি দিয়েছিলেন আজ এখানে তা লিখতে চাই না। সেই কর্মকর্তা শেখ হাসিনা সম্পর্কে পুলিশী অভিজ্ঞতায় আরও বলেছিলেন- নিজ বাড়িতে শুধু নয়, গৃহবন্দী হওয়ার আগে যখন জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে তিনি সভা করতে যেতেন তখনও পৌঁছেই প্রথমেই পুলিশ দলকে দেখিয়ে আয়োজকদের বলতেন ‘আগে এদের খাবার ব্যবস্থা করুন।’ অগণিত মানুষের নবাব ভাই একবার আমন্ত্রিত হয়ে আমাদের নিউইয়র্ক বাড়িতে এসে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সম্পর্কে বলেছিলেন তার অনেক স্মৃতিকথা। বলেছিলেন ৩২ নম্বর রোডে ওই ঐতিহাসিক বাড়িটিতে তার বাল্য-কৈশোরের আহার-বিহারের গল্প। -বঙ্গবন্ধুর লাগোয়া বাড়িটি ছিল আমার মামার। বাল্যকালে মামাবাড়িতে আমরা বাদশা, নবাব দুই ভাই যখন যেতাম তখন খেলতে খেলতে বেশিরভাগ সময় ঠিক পাশের বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েও খেলা হতো। ও বাড়ির দুয়ার তো যেন সর্বক্ষণ এক রকম হাট করে খোলা থাকত সবার জন্য। তারপর তিনি ছিলেন মামার বন্ধু। দুপুরে খাবার সময় হয়ে যায়, খেলা শেষ হয় না। এক সময় বঙ্গবন্ধু নিজে এসে হাত ধরে খাবার টেবিলে নিয়ে যেতে যেতে ঠাট্টা করে বলতেন- আয় আয় তোর মামা তো একজন কিপ্টে মানুষ, তার বাড়িতে আজ ভাল রান্না নিশ্চয়ই হয়নি। এখানে স্মরণ করিয়ে দেয়া ভাল, এই বাদশা হলেন পরবর্তীকালে দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর প্রথম প্রেস সেক্রেটারি। বর্তমানে প্রয়াত আমিনুল হক বাদশা। আর খন্দকার রাশিদুল হক নবাব ভাই অবসর নিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে। -কিন্তু কেমন রাঁধেন বিশ্বসেরা নারী নেত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা? আমাদের নিউইয়র্ক আবাসেই সাগ্রহে এই প্রশ্ন তুলেছিলাম শ্রদ্ধেয় শেখ শহীদুল ইসলামের কাছে। যিনি বেগম মুজিবের বোনের ছেলে এবং লেখাপড়া ও রাজনীতি সবই করেছেন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে থেকে। আমার গৃহকর্তা আব্দুল মালেক শেখ শহীদের স্নেহধন্য হওয়ার সুযোগ পেয়েছে নিজের সেই ছাত্রত্বকালের রাজনৈতিক দিনগুলো থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত। প্রশ্নের উত্তরে এরশাদ সরকারের প্রাক্তন এই মন্ত্রী বলেছিলেন ‘হাসিনা আপার রান্না হলো অসাধারণ, একবার খেলে কেউ ভুলতে পারে না। কিন্তু আমার খালা বেগম মুজিবের হাতের রান্না ছিল প্রবাদের মতো অতুলনীয়। লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী
×