ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সাবেক জাতীয় শূটার নদীর রেফারি হওয়ার অভিলাষ

প্রকাশিত: ০৭:২৮, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

  সাবেক জাতীয় শূটার নদীর রেফারি হওয়ার অভিলাষ

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ পথে চলার পথে নানা বাঁক পেরুতে হয়। তেমনি জীবনপথে চলার পথেও মানুষকে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতে হয়। নার্গিস জাহান ওহাব নদীর গল্পটাও অনেকটা সেরকম। ৩২ বছর বয়সী এই সুর্দশনা তার জীবনে আবিভূর্ত হয়েছেন নানা রূপে। কখনও তিনি নৃত্যশিল্পী, কখনও আবৃত্তিকার, কখনও আবার উপস্থাপিকা, কখনও বা সাঁতারু, কখনও শূটার, কখনও শাটলার, কখনও ম্যারাথনার, কখনও আবার ইয়োগা ও এ্যারোবিক্স প্রশিক্ষক, কখনও পর্যটক। ঢাকার খিলক্ষেতের লেক সিটির বাসিন্দা নদী এখন চেষ্টা করছেন ফুটবল রেফারি হওয়ার। নদীর জন্ম ১৯৮৭ সালের ২৯ জুন। জন্মস্থান সিলেট শহরে। বেড়ে ওঠা সেখানেই। ১ ভাই (নাম বিন্দু), ১ বোনের মধ্যে তিনি ছোটজন। বাবা আবদুল ওহাব সরকারী কর্মকর্তা। মা নুরজাহান বেগম সরকারী স্কুলের শিক্ষিকা। সিলেট জেলা স্কুলে পড়ার সময় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড় ও দড়ি লাফে নিয়মিত ফার্স্ট হওয়া নদী শৈশব থেকেই যেমন লম্বা, তেমনি সংস্কৃতিমনা। দেশীয় নাচে পারঙ্গম। স্কুলে এবং কর্মজীবনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার নাচের অভিজ্ঞতা বেশ ভালই। খেলাধুলায় আসার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অবদান নদীর বড় খালার। তিনি স্বর্ণপদকধারী সাবেক জাতীয় সাঁতারু লায়লা নুর বেগম। নদীর ভাষ্য, ‘তার পরামর্শেই বাবা আমাকে বিকেএসপিতে ভর্তি করিয়ে দেন ১৯৯৮ সালে। বিকেএসপির এই জীবনটা দারুণ উপভোগ করেছি।’ ওখানে প্রথম দু’বছর ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইল ও ব্রেস্টস্ট্রোক সাঁতারের ওপর ট্রেনিং করেন নদী। তখন সবুরা ও ডলি ছিলেন তারকা সাঁতারু। ২০০০ সালে শূটিং ইভেন্ট চালু হলে কাজী সেলিম স্যারের মাধ্যমে খেলাটির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন নদী। সাতাঁরু থেকে বন্দুকবাজ হওয়ার গল্পটাও জনকণ্ঠকে শোনান সুদর্শনা নদী, ‘তবে সাঁতার ভীষণ পরিশ্রমের খেলা হওয়াতে পড়াশোনা করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। ভীষণ ঘুম পেত। ফলে ঠিকমতো পড়তে পারতাম না। এতে পরীক্ষায় ফলও খারাপ হতো। সাতপাঁচ ভেবে পড়াশোনার চাপ কমানোর জন্য শূটিংই বেছে নেই।’ এজন্য সাঁতার কোচ শাহজাহান আলীকে অনেক কষ্টে রাজী করাতে হয়েছিল নদীর। পরিবারও আপত্তি করেনি। এমনকি নদীর খালামনিও। অবশেষে ২০০২ সালে সাঁতার ছেড়ে শূটিংয়ে চলে আসেন নদী। বিকেএসপিতে শূটিংয়ের প্রথম ব্যাচ ছিলেন নদীরাই। এই খেলায় সফলতা পেতে নিজের সেরাটাই দেন। ফলও পান। দুই বছর পরেই শূটিংয়ে জাতীয় পর্যায়ে অভিষেকেই (বাংলাদেশ গেমস) অনুর্ধ-২১ বিভাগে স্বর্ণপদক লাভ করেন। তার ইভেন্ট ছিল ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে। আতিক, নিনি, আসিফ, সাবরিনা, শাহানাদের মতো তারকা শূটারদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ২০১০ এসএ গেমসে অংশ নিতে পারেননি পড়াশোনার নিয়ে ব্যস্ততার কারণে। তবে ক্যাম্পে ছিলেন। বিকেএসপি ছাড়ার পর খেলেছেন গুলশান শূটিং ক্লাব এবং নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবে। ভবিষ্যতে স্কুল-শূটিং নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে তার। বাংলাদেশে প্রথম নারী ম্যারাথনে অংশ নিয়ে নদী ৩৪তম হয়েছিলেন ২০১৬ সালে। এছাড়া ব্যাডমিন্টনে ২০১৪ সালে কর্পোরেট লিগে মিশ্র দ্বৈতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সিনিয়র ও জুনিয়র ‘ইউনেক্স সানরাইজ আন্তজার্তিক ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট’-এ উপস্থাপিকার দায়িত্বও পালন করেছেন। এতে একটি সম্মাননা এ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন। আবৃত্তিও করেছেন এক সময়। কণ্ঠশীলন থেকে কোর্স করেছেন। খুব ইচ্ছে ছিল মিডিয়াতে সংবাদ পাঠিকার ক্যারিয়ার গড়ার। চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু নানা কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আবুল্লাহ আবু সাঈদের প্রিয় ছাত্রদের একজন নদী। নদী স্বাবলম্বী। স্বাধীনচেতা। বিদেশ ঘোরার প্রচণ্ড শখ। চাকরির টাকা জমিয়ে এ পর্যন্ত ৮টি দেশে গিয়েছেন। নেশা আছে সাহিত্য পাঠেরও। রাশিয়ান কালচার সেন্টার থেকে এ্যারোবিক্সের ওপর এবং ইন্ডিয়ান হাই কমিশন থেকে ইয়োগার ওপর কোচেস কোর্স করেছেন। ২০১১ সাল থেকে সপ্তাহে তিন দিন এই দুটো বিষয় নিয়ে বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন পেশার নারীদের বাসায় গিয়ে তাদের উপযুক্ত অর্থের বিনিময়ে ক্লাসও করান। এছাড়া যাদের বাসায় সুইমিং পুল আছে, তাদেরকে সাঁতারও শেখান। গত ১৩ জুন বাফুফে ভবনে ওম্যান রেফারিং রিফ্রেশার্স কোর্স চলছিল। ৩০ মহিলা প্রশিক্ষণার্থী। নদীর সঙ্গে প্রথম দেখা সেখানেই। ফিজিক্যাল এডুকেশন এবং ইকোনমিক্সে ডাবল মাস্টার্স করা নদীর অভিলাষ এক দক্ষ-নামকরা ফুটবল রেফারি হওয়া। এ প্রসঙ্গে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন মহিলা ফুটবলের অবস্থা খুবই ভাল। এজন্যই মহিলা ফুটবলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চাই রেফারি হিসেবে।’ একদিন এক বন্ধুর মাধ্যমে নদী খবর পান বাফুফেতে ফুটবল রেফারিংয়ের ওপর ফ্রি কোর্স হচ্ছে। আগে থেকেই ফুটবলের প্রতি দুর্বলতা। সেটাকে কাজে লাগিয়ে গত দুই বছরে বেশকিছু রেফারিং কোর্স করেছেন। বসুন্ধরার হার্ডকো ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে বছরখানেক ধরে সিনিয়র ফিজিক্যাল এডুকেশন টিচার হিসেবে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ফুটবল প্রশিক্ষণ দেবার চেষ্টা করছেন নদী। ঢাকা শহরের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের মেয়ে স্টুডেন্টরা দিন দিন খেলাবিমুখ হয়ে পড়ছে। নদীর লক্ষ্য শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটাতে তাদের ফুটবলমুখী করা। ২০১৭ সালে প্রথম ফুটবল রেফারিং কোর্স করেন নদী। এখন আছেন ‘সি’ লেভেলে। ওই বছরই পাইওনিয়ার ফুটবল লিগে চতুর্থ অফিসিয়াল রেফারি হিসেবে কাজ করেন ৭টি ম্যাচে। এরপর ২০১৮ সালে জেএফএ কাপ অ-১৪ বালিকা কাপে যশোরে আঞ্চলিক পর্বের ৪টি ম্যাচে সহকারী রেফারি হিসেবে কাজ করেন। ভাল করার সুবাদে চূড়ান্ত পর্বের ফাইনাল ম্যাচে তাকে ম্যাচ অফিসিয়ালের দায়িত্ব দেয়া হয়। ২০১৮ সালে নীলফামারীতে গিয়ে জেএফএ কাপ, বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল, ঢাকার ধানমণ্ডি আন্তঃবিভাগীয় মহিলা ফুটবল এবং ২০১৯ সালে বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবলে সহকারী রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সবমিলিয়ে ৩০টি ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। এখন স্বপ্ন দেখেন মূল রেফারি হিসেবে খেলা পরিচালনার। আজাদ রহমানকে রেফারি হিসেবে দারুণ লাগে নদীর। রেফারি হবার আগে তিনি বিকেএসপিতে একসময় বাস্কেটবলের কোচ ছিলেন! মহিলা ফুটবলারদের মধ্যে সাবিনা খাতুনের খেলা পছন্দ নদীর। পুরুষদের মধ্যে পছন্দ ডিয়েগো ম্যারাডোনা এবং লিওনেল মেসিকে। এ বছরই দীর্ঘ বিরতির আবারও মহিলা ফুটবল লিগ হওয়ার কথা। সেখানে প্রথমবারের মতো কাজ করার ব্যাপারে আশাবাদী নদী। বাংলাদেশের নারী ফুটবল নিয়েও সমান মনোভাব তার, ‘যেভাবে নারী ফুটবলাররা উন্নতি করছে, সফলতা পাচ্ছে, ভাল সুযোগ-সুবিধা পেলে একদিন তারা ফিফা বিশ্বকাপ জিতবে।’ তবে রেফারিং একটি ‘থ্যাংকলেস’ জব। ভুল করলে দর্শক তো বটেই, দু’দলের খেলোয়াড়দের কাছ থেকে গালি খাওয়া বা মার খাওয়ার একটা আশঙ্কা থাকে। এসব জেনেশুনে কেন রেফারিংয়ে এলেন? নদীর উত্তর, ‘আমি বরাবরই চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করি।’ নদীর নামকরণের গল্পটা বেশ মজার। নার্গিস ফুলের জন্ম জলে। আর জল থেকেই নদীর জন্ম। বাংলা সাহিত্যের অনুরাগী বাবা তার একমাত্র আদরের মেয়ের ভাল নাম রাখলেন নার্গিস, আর ডাকনাম রাখলেন নদী। নদীর সঙ্গে তো সাঁতারেরও নিবিড় সম্পর্ক। কি আশ্চর্য! বড় হয়ে সেই মেয়ে হলে গেল জাতীয় সাঁতারু! এ প্রসঙ্গে নদী বলেন, ‘নদী নামটা নিয়ে ছোটবেলায় অনেক বিব্রত হতাম। সহপাঠীরা আমাকে ক্ষেপাত ... ও নদীরে ... গান গেয়ে। অনেকে বলতো কোন নদী? আবার অনেকে বলতো তুমি দেখছি নদীর মতোই লম্বু!’ মেঘে মেঘে তো বেলা অনেক হলো। বিয়ের কি খবর? কেমন পাত্র পছন্দ? লাজুককণ্ঠে নদীর উত্তর, ‘স্পোর্টিং মাইন্ডের, ভ্রমণপিপাসু, ভাল উচ্চতার অধিকারী (নদীর হাইট ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি), ভাল মেন্টালিটি আছে, আমাকে ও আমার পেশাকে শ্রদ্ধা করবে, আমাকে বুঝবে ... এমন ছেলেই আমার পছন্দ। এখানে এডুকেশন, চেহারা, অর্থবিত্ত ... এগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ জীবন এক বহতা নদী ... সেই নদীর মতোই নিরন্তর নানা বাঁক নিয়ে পথ চলা আগামীতে ফুটবল রেফারি হিসেবেই ক্যারিয়ার গড়ে থিতু হবেন কি না, সেটা বলে দেবে সময়।
×