ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দরিদ্র শিশুদের শিক্ষার জন্য স্কুল নির্মাণ করে দিয়েছেন লোকমান

প্রকাশিত: ০১:৪৬, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

দরিদ্র শিশুদের শিক্ষার জন্য স্কুল নির্মাণ করে দিয়েছেন লোকমান

নিজস্ব সংবাদদাতা, লালমনিরহাট ॥ শিশু শিক্ষার্থীরা কেউ লোকমানকে দাদু, কেউ চাচা আবার কেউ ভাইয়া ডাকে। লেখার ব্ল্যাকবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করেন ঘরের কাঠের দরজা। এভাবেই শিক্ষা দিচ্ছেন তিস্তা চরের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের। শুধু পড়াচ্ছে তা কিন্তু নয়। নিজের সাধ্যমত গরিব ছেলে-মেয়েদের খাতা, কলম, শিশুদের মুখরোচক খাবার ও কখনো পোশাকও কিনে দিচ্ছেন নিজের টাকায়। স্বল্প শিক্ষিত লোকমান আলীর এমন শিক্ষানুরাগী আচরণে মুগ্ধ ও অভিভূত তিস্তা চরাঞ্চলের মানুষ। সর্বজন শ্রদ্ধেয় লোকমান আলী এখন গ্রামটির একজন শিক্ষা নামক ‘আলোর বাতিঘরে পরিনিত হয়েছেন। লোকমান আলী একবার দুইবার নয়, তিস্তার গ্রাসে পাঁচবার বসতভিটা হারিয়েছেন। বারবার হয়েছেন, নিঃস্ব রিক্ত ও ভূমিহীন। এরপরও মনোবল হারাননি। মাদুর বিছিয়ে চার ছেলে-মেয়েকে আলোকিত মানুষ করেছেন। পাশাপাশি অন্যের সন্তানদের শিক্ষা দিতে চরাঞ্চলের ছেলে-মেয়েদের বিনামূল্যে নিজের কোচিংয়ে পড়িয়ে ভালো মানুষ গড়ার কাজে সহায়তা করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছেন। লোকমান আলী লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীর বারঘড়িয়া আদর্শপাড়া গ্রামের আবদার আলীর একমাত্র ছেলে। প্রাচুর্যের মাঝে বড় হয় লোকমান আলী। যৌবন বয়নে অভাব নামক দানবটি তাকে ছুঁতে পারেনি। হঠাৎ ১৯৯২ সালে তিস্তার হিংস্র থাবায় নদী গর্ভে বিলিন হয় য়ায় লোকমানের বাবার রেখে যাওয়া বসতভিটাসহ সব সম্পত্তি। ভূমিহীন হয়ে পড়েন তিনি। তাকে আশ্রয় নিতে হয় অন্যের জমিতে। এববার নয় কয়েক বছরের মধ্যে টানা পাঁচবার ভিটেবাড়ি সড়াতে হয় তিনিসহ অনেককে। শেষ পর্যন্ত বারঘড়িয়া আদর্শপাড়ায় মামার দেয়া মাত্র চার শতাংশ জমিতে বসবাস শুরু করেন। সম্পদহানীর দুঃচিন্তায় কয়েক বছর পর হঠাৎ তার বাবার মৃত্যু হয়। পুরো সংসারের দায়িত্ব পড়ে লোকমান আলীর কাঁধে। ১৯৯৬ সালে অভাবের তাড়নায় স্ত্রী নুরনাহার লোকমান আলীকে ও তার ৪ সন্তানকে একা ফেলে ১৪দিনের এক ছেলেসহ অন্যের ঘরে চলে গিয়ে নতুন সংসার করেন। সেই থেকে চার সন্তান ও মা নবিয়ন নেছাকে নিয়ে লোকমান আলীর নতুন জীবন সংগ্রাম শুরু হয়। এক বেলা চা ও এক বেলা ডাল-ভাত খেয়ে অভাবের সঙ্গে লড়াই করে চার সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নিজে না খেয়ে থাকলেও প্রতিবেশীদের মুখে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। দীর্ঘ সংগ্রামের এ জীবনে এখন তার একমাত্র মেয়ে কলেজের অধ্যাপিকা, বড় ছেলে এমবিবিএস চিকিৎসক। সদ্য বিসিএস স্বাস্থ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন। সরকারি হাসপাতালে মানব সেবায় যোগদানের অপেক্ষায়। মেঝ ছেলে রাজশাহী বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে সদস্য স্নাতকোত্তর সমাপ্ত করেছে। সে বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছোট ছেলে স্নাতক শাখায় অধ্যায়ন করছেন।কষ্টেভরা জীবনে নিজের সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এতেই খান্ত হননি লোকমান আলী। অন্যের ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করে মানুষ করতে তিস্তার চরে বিনামূল্যে মিক্ষা দিতে স্কুল খুজে বসেছেন। সেখানে চরাঞ্চলের শিশুদের বিনামূল্যে সকাল বিকেল পড়াচ্ছেন তিনি। এজন্য বাড়ির একটি ঘরকে পাঠশালা বানিয়ে মাদুর বা চাটাই বিছিয়ে পরম যতেœ পড়াচ্ছেন তিনি। ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৭০ জন। চার সন্তানকে আলোকিত মানুষ করার পাশাপাশি গ্রামের শিশুদের শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করে গ্রামজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। সমাজের শিক্ষিত ও বিত্তবানরা যা করতে পারেননি, অর্ধশিক্ষিত ও ভূমিহীন এ লোকমান আলী তা সম্ভব করে উচ্চ শিক্ষিত ও বৃত্তবানদের অবাক করে দিয়েছেন। দক্ষিণ বালাপাড়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মোঃ আব্দুল বাতেন ফারুক বলেন, না খেয়ে থাকলেও লোকমান আলী কারো সাহায্য গ্রহণ করেন না। তবে পুরস্কার স্বরূপ তার মেধাবী চার সন্তানকে ফরম পূরণসহ সব বিষয়ে ছাড় দেয়া হত। অন্যের জমিতে আশ্রিত থেকে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে অন্যের সন্তানকে বিনা বেতনে পাঠদান করিয়ে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন লোকমান আলী। মহিষখোচা স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ শরওয়ার আলম জানান, লোকমান আলী একজন সহজ সরল সাদা মনের মানুষ। চরাঞ্চলে শিক্ষা আলার বাতিঘর জ্বালিয়েছেন। সমাজ এর সুফল একদিন পাবে। মহিষখোচা ইউপি চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরী জানান, মাঝে মধ্যে না খেয়ে থাকত লোকমান আলী। সাহায্যের জন্য সরকারি সহায়তা পাঠানো হতো। তিনি গ্রহণ না করে পাশের দুঃস্থ প্রতিবেশীকে দিতে বলতেন। এমন স্বার্থহীন ও সাদা মনের মানুষ এ এলাকায় বিরল।
×