ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

‘আমাকে স্বাধীনতা না হয় মৃত্যু দাও’

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

‘আমাকে স্বাধীনতা না হয় মৃত্যু দাও’

১৯৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল সোমবার। ক্যাপ্টেন গাফফার একটি শক্তিশালী রেইডিং পার্টি নিয়ে কায়েমপুরে পাকসেনাদের অবস্থানের পিছনে অনুপ্রবেশ করে। পরদিন ভোরে রেকি করার পর সকাল ১০টায় পাকসেনাদের পেছন দিকের অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। রেইডিং পার্টির গুলিতে ৩২ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনাদের অপর একটি দল কায়েমপুরে তাদের অবস্থানের দিকে নৌকাযোগে অগ্রসর হবার পথে মুক্তিফৌজের এ্যামবুশ পার্টি তাদের উপরও অতর্কিত আক্রমণ চালায়। দুটি নৌকা আক্রমণের ফলে ধ্বংস হয়ে যায় এবং এতে ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা তাদের বিপর্যস্ত অবস্থানগুলো বাঁচানোর জন্য ভারি তোপের সাহায্য মুক্তিফৌজের মন্দভাগ কোনাবন এবং শালদা নদীর অবস্থানের ওপর প্রচ- গোলাবর্ষণ করে। ১নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর সুবেদার রহমান আলীর নেতৃত্বে পাকবাহিনীর চম্পকনগর বিওপি আক্রমণ করে। অল্পক্ষণের এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩ জন সৈন্য হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল চট্টগ্রাম-কুমিল্লা সড়কে জগন্নাথদীঘির কাছে বাজানকারা সেতুটি উড়িয়ে দিয়ে সেতুর উত্তরে ১০ জন গেরিলা ও একটি নিয়মিত বাহিনী পাকসেনাদের অপেক্ষায় এ্যামবুশ পাতে। বাজানকারা সেতু ধ্বংসের সংবাদ পেয়ে ফেনী থেকে পাকবাহিনীর একটি শক্তিশালী দল সেতুর দিকে অগ্রসর হয়। পাকসেনারা এ্যামবুশের আওতায় এলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর প্রচ- আক্রমণ চালায়। এতে পাকবাহিনীর একজন অফিসারসহ ২৫ সৈন্য নিহত হয়। ২নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর নেতৃত্বে পাকসেনা ও রাজাকারদের রামগঞ্জ অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ১৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। ‘দাবানল’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মালিকনগর এলাকায় প্রায় দুই কোম্পানি পাকসৈন্যের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর গোলাবিনিময়ে ২ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়: রংপুর জেলার ডিমলা থানার অন্তর্গত সুটিবাড়ি হাটের পশ্চিমে জোড়জিগা গ্রামে মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ৯ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং কয়েকজন কোন প্রকারে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে প্রাণ বাঁচায়। ঐ থানার বালাপাড়া গ্রামে মুক্তিবাহিনীর পেতে রাখা মাইনে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। পরে বর্বর পাকসৈন্যরা বালাপাড়া গ্রাম সম্পূর্ণভাবে জ্বালিয়ে দেয়। ‘মুক্ত বাংলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধ ‘অভ্যুদয়’: মুক্তবাংলার প্রথম সম্পাদকীয় নিবন্ধটা লিখতে বসে সহসাই মনে পড়ে গেল একদা একটি কিশোর বালকের জিজ্ঞাসা: বাঙালী জাতির কি কোন ইতিহাস নেই? এই যেমন গ্রীকদের রয়েছে, মিসরীয়দের রয়েছে, ফরাসীদের, এমন কি ইংরেজদেরও। সময়টা ছিল নির্বাচন প্রস্তুতি কাল। জনৈক রাজনৈতিক বন্ধুর বৈঠকখানায় বসেছিলাম। আমাদের আলোচ্য বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দু ছিল-বাঙালী জাতি। কিন্তু তবুও কিশোরটির জিজ্ঞাস্যকে সঠিক মীমাংসায় নিষ্পত্তি করতে পারেনি কেউ। কারণ বাংলার ইতিহাস ও বাঙালী জাতি খুব স্পষ্ট ছিল না তখনও। অথচ ভাবতেও পারেনি বাঙালী জাতির সত্যিকার ইতিহাস রচনার মালমসলা তৈরি হতে যাচ্ছে-শীঘ্রই তার সূচনা হবে। ইয়াহিয়া খান তার পাঞ্জাবী দস্যু বাহিনীর দ্বারা বাংলার বুকে নজিরবিহীন গণহত্যা ও পৈশাচিক বর্বরতা চালিয়ে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইবে বাংলাদেশের সত্তাকে। কিন্তু রক্তস্নাত হয়ে জেগে উঠবে বাংলাদেশের জনগণ। দৈনিক হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, মানবাধিকার কমিশন এর প্রতিনিধিদের সুপারিশ কর্তৃক পরিচালিত জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক প্রচারণায়, বাংলাদেশের পরিস্থিতি দূরিকরনে বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন আজ। ২০ সেপ্টেম্বর, গান্ধীবাদী সংগঠন কর্তৃক আহূত এই ননঅফিসিয়াল সম্মেলনের বিদেশী প্রতিনিধিরা, পূর্ব সীমান্তের শরণার্থী ক্যাম্পের পরিস্থিতি দেখতে কলকাতার উদ্দেশে একটি ‘ফিল্ড ট্রিপ’ এ যাচ্ছে। একটি প্রস্তাবনা তৈরি হয়েছিল যে উনারা পূর্ববাংলার ভেতর দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের স্বীকৃতি’ দেখতে যাবেন। অপর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আজ এখানে বাংলাদেশের ব্যাপারে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে বিবদমান মতামত উপস্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের প্রতি ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’-এর বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে একটি সেশন নির্দিষ্ট ছিল যা পরিবর্তন করা হয় এবং চেয়ারপার্সন সেনারাতা গুনাবর্ধনে বারবার অংশগ্রহণকারীদের ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য বলছিলেন। বাংলাদেশের স্বীকৃতি বিবেচনাধীন আছে- এ ব্যাপারে রাজি করানোর জন্য দিল্লীতে অবস্থিত কিছু বিদেশী মিশনে পরিদর্শনের প্রস্তাব করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কিছু অংশগ্রহণকারী তালিকায় ভারত সরকারের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেছিল। আরেকপক্ষ এই সম্মেলন ‘ভারত সরকারকে যাতে অস্বস্তিতে না ফেলে’ এই যুক্তিতে বিরোধিতা করেছিল। একজন অংশগ্রহণকারী প্রস্তাব করেন যে, এর বিপরীতে তাদের অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত এবং বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য এ পর্যন্ত যত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তার জন্য প্রশংসা করা উচিত। একটি সেশনে বিদেশী প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশ অভিমুখে স্বাধীনতা মিছিলের নেতৃত্ব দেয়ার প্রস্তাবনা বিবেচনা করার সময় জনাব পিয়েরে দ্বিতীয়বারের মতো ভারত সরকারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। আরেকজন মনে করেন যে, এই পদক্ষেপে অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের আশীর্বাদ থাকা উচিত না হলে এটা তার উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে। আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গঠনের পরামর্শে বলা হয়, আমাদের নিজেদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করলে এটি স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের মতো জটিলতাই ডেকে আনবে। অধিবেশনটি একমত হয় যে, শেখ মুজিবরের মুক্তির জিজ্ঞাসার জন্য নয়াদিল্লীতে পাকিস্তান হাই কমিশনের কাছে তাদের সমাধানের একটি কপি প্রেরণ করবে। অধিবেশনটি নয়াদিল্লী বা কাবুল থেকে ইসলামাবাদ অভিমুখে পশ্চিম পাকিস্তানকে তাদের দেশের পূর্ব ভাগে প্রকৃতপক্ষে কি ঘটছে সে ব্যাপারে অবহিত করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক শোভাযাত্রার আয়োজন করার ব্যাপারে বিবেচনা করছে। একজন অংশগ্রহণকারীর মতে, যাত্রা শুরু করার সম্ভাব্য স্থান হিসেবে তেহরানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইনস্যাশিয়েট (রহংধঃরধঃব) ফর ডিফেন্স স্টাডিজ এ্যান্ড এনালাইসিস-এর পরিচালক কে সুব্রমানাম বলেন, ভারতের উচিত ইয়াহিয়া ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের দৃষ্টি বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সরানোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ তৈরির অবস্থা সৃষ্টি করার ব্যাপারটি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা। বাংলাদেশের জনগণকে অবাধে হত্যা সত্ত্বেও পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য বৃদ্ধিতে আমেরিকার উদ্দেশ্যের ব্যাখ্যায় সুব্রমানাম বলেন, পাকিস্তানকে ভারতের বিপক্ষে সমশক্তির দেশ ও আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক চুক্তির সদস্য দেশ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্রিটিশ এমপি উইলিয়াম মলয়ের সভাপতিত্বে অধিবেশনে অন্যান্য বক্তারা অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উত্থানের প্রচারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। অস্ট্রেলিয়ার মিসেস স্যালি রায় বলেন, যদিও পূর্ব বাংলায় অবিশ্বাস্য রকমের জীবন ও সম্পদের অবাধ ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে, তবুও বাংলাদেশ এরকম প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে ভিয়েতনাম ও বায়াফ্রা এর মতন অস্ট্রেলিয়ার কাছে আসেনি। এর কারণে অস্ট্রেলিয়ার জনগণ এই সমস্যার ব্যাপারে কিছুই জানে না। প্রতিনিধি দলকে অবশ্যই সেখানে পাঠানো দরকার। জনশ্রুতি আছে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, ইরান, তুর্কি এবং অন্যান্য আরব রাষ্ট্রসমূহ প্রচুর পরিমাণে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য প্রদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব সবচেয়ে বেশি আপত্তিজনক ছিল। যেই দেশ স্বাধীনতার বাতিঘরকে শূন্যে উঠিয়ে রেখেছে এবং বিশ্বকে ‘আমাকে স্বাধীনতা না হয় মৃত্যু দাও’ এরূপ স্লোগান দিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মানবাধিকার জঘন্য পর্যায়ে চলে এসেছে-এর অস্বীকৃতিকারীর দলে আমার নাম এখনই লেখা উচিত। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×