ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলার বাড়িটি রাজাকারের দখলে

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯

   ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলার বাড়িটি রাজাকারের দখলে

নিজস্ব সংবাদদাতা, মৌলভীবাজার ॥ মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও শিক্ষা ও সাংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। বৃটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তি যুদ্ধে এ গ্রামের মানুষের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামের জন্ম গ্রহন কারী কৃতি সন্তান লীলা নাগ ১৯৩১ সালের মে মাসে মাসিক ”জয়শ্রী” পত্রিকার সম্পাদনার মাধ্যমে মহিলা সাংবাদিকতায় ইতিহাসে স্থান করে নেন। জয়শ্রী পত্রিকার নাম করন করেছিলেন বিশ্বকবি কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। লীলা নাগ মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯১৭ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ইডেন হাই স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। পরে কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন। বেথুন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে ১৯২১ সালে মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করে বিএ পাশ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। লীলা নাগ নব প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ তে ভর্তি জন্য আবেদন করেন। সহ শিক্ষার প্রচলন না থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তপক্ষ তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। কিন্তু দৃঢ়চেতা লীলা নাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেনই বলে সংকল্প বদ্ধ হন। এ বিষয়ে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও চ্যান্সেলর (বাংলার গভর্ণর) উভয়ের সাথে দেখা করেন এবং অবস্থা ব্যাখ্যা করে কেইস প্লীড করেন। বিশ্ববিদ্যায় কর্তৃপক্ষ তাঁকে ভর্তির অনুমতি দেন। লীলা নাগই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী। ১৯২৩ সালে লীলা নাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে কৃতিত্বের সাথে এমএ পাশ করেন। এমএ পাশ করার পর তিনি সরকারী চাকরী প্রত্যাখান করে দেশ ও মানবতার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেন। নারী শিক্ষার বিস্তারের জন্য লীলা নাগ সর্বপ্রথম ”দীপালী সংঘ” নামের মহিলা সংস্থা স্থাপন করেন। এই সংঘের প্রচেষ্টায় অনেক গুলো প্রামিক বিদ্যালয় ও ইংরেজী উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। লীলা নাগ ঢাকায় ১৯২৬ সালে ”দীপালী” ছাত্রী সংঘ গঠন করেন। উপমহাদেশে এটাই প্রথম ছাত্রী সংগঠন। কিছুদিন সমাজ সেবা করার পর তিনি আস্তে আস্তে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। লীলা নাগ ১৯২৮ সালে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে সক্রীয় অংশগ্রহন করেন। কিছু দিন কংগ্রেসে কাজ করার পর তাঁর মনে হল অহিংস আন্দোলনের অপর নাম হচ্ছে বৃটিশ তোষন ও নতজানু রাজনীতি। তাই তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে অনিল রায় পরিচালিত বিপ্লবী দল শ্রীসংঘের সদস্য হন। ১৯৩০ সালে অনিল রায় বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন্য গ্রেফতার হন। তখন লীলা নাগ শ্রীসংঘের নেতৃত্ব গ্রহন করেন। বেঙ্গল অর্ডিনেন্স আইনে ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর তিঁনি গ্রেফতার হন। লীলা নাগই উপমহাদের প্রথম মহিলা যিনি বিনা বিচারে প্রায় ৭ বছর কারা ভোগের পর ১৯৩৮ সালে তিনি মুক্তি লাভ করেন। মুক্তি লাভের কিছু দিনের মধ্যে তিনি বিপ্লবী অনিল রায়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এর পরই লীলা নাগ হন লীলা রায়। লীলা রায় কুখ্যাত ”হলওয়েল মনুমেন্ট” অপসারণের আন্দোলনে নেতাজী সুভাষ বসুর সাথে এ আন্দেলনে জড়িয়ে পরেন। ফলে ১৯৪০ সালে ১৭ জুলাই তিঁনি আবার কারাবরন করেন। ১৯৪১ সালে নেতাজী সুভাষ বসুর অন্তধানের পর লীলা রায় ও তাঁর স্বামী অনিল রায় ফরওয়ার্ড ব্লক সংগঠনের দায়িত্ব গ্রহন করেন। লীলা রায় ১৯৪২ সালে ক্রীপস মিশনের বিরোধীতা করেন। ক্রীপস মিশনের ব্যর্থ হলে ১৯৪২ সালের ১১ এপ্রিল তিনি আবার কারারুদ্ধ হন। প্রায় ৩ বছর কারা ভোগের পর ১৯৪৬ সালে তিঁনি আবার মুক্তি পান। লীলা রায় দেশ বিভাগের ঘোর বিরোধী ছিলেন। স্বচ্ছল পরিবারের সন্তার হয়েও তিনি দেশ সেবার কঠিন পথ বেছে নেন। প্রতিদানে তিঁনি মন্ত্রিত্ব বা রাষ্ট্রদূতের পদ পেয়েও তা প্রত্যাখান করেন। লীলা রায় ১৯১৩ সালে তাঁর পৃত্রিক বাড়ির সামনে নিজের ভ’মিতে তাঁর মায়ের নামে কুঞ্জলতা প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্টিত করেন। ১৯৭০ সালের ১২ জুন ৭০ বছর বয়সে তিঁনি পরলোকগমন করেন। তাঁর নিঃস্বার্থ আতœত্যাগের জন্য ইতিহাসের পাতায় তিঁনি অমর হয়ে থাকবেন। রাজনগরের কুখ্যাত রাজাকার একাত্তরের ঘাতক আলা উদ্দিন চৌধুরী যার নেতৃত্বে পাঁচগাঁও এর ৬৯ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হাত-পা বেঁধে দীঘির পারে নির্বিচারে গুলি করে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। সেই আলাউদ্দিন চৌধুরী লীলা রায়ের পৈত্রিক বাড়িটি দখল দখল করে রেখেছে। লীলা নাগের শেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বাড়ির বৈঠকখানাটি জরাজীর্ণ ভংগুর অবস্থায় এখনো টিকে আছে। তাঁর জন্ম স্থান ও ভিটে মাটি রাজাকারদের হাত থেকে দখলমুক্ত করা সর্বসাধারণের দাবি।
×