ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

শহুরে সংস্কৃতিতে ঠাঁই হয়নি বাঙালীর চিরায়ত লোকজ ধারার

প্রকাশিত: ১১:১৩, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯

শহুরে সংস্কৃতিতে ঠাঁই হয়নি বাঙালীর চিরায়ত লোকজ ধারার

সমুদ্র হক ॥ বাঙালীর লোকজ রূপ ছন্দায়িত নাচে-গানে-গম্ভীরায়। গাঁওগেরামের বটতলা, হাটখোলায় যে বাঁশির সুর, জারি সারি ভাটিয়ালি সবই আমাদের বাঙালীর হাজার বছরের আকর। অঘ্রানে যে সুরে ধান কাটে চাষী সেই চিরায়ত ছন্দ শহুরে অর্কেস্ট্রার ধামাল সুরে বেশিদূর এগোতে পারেনি। রয়ে গেছে গ্রামের চাষীর গান হয়ে। শহুরে সংস্কৃতিতে ঠাঁই হয়নি। চৈত্রসংক্রান্তি কিংবা বর্ষবরণে ঢাকের বাদ্যি এখনও উৎসবকেন্দ্রিক এক/দুদিনের জন্য শহুরে। তা বলে হারিয়ে যায়নি বাঙালীর লোকজ ধারা। দাড়িমুখে সারিগান লাÑশরীকাল্লাহ, দুই হাতে কালের মন্দিরা যে সদাই বাজে কিংবা একতারার বাউলগান এখনও শহুরে সাহেবদের আদর পায়নি। উল্টো হেভি মেটালের উচ্চগ্রামের আওয়াজে খাবি খাচ্ছে। গাঁয়ের মাটির সানকিতে পান্তাভাত, মেলার মুড়ি-মুড়কি, খাজা-বাতাসা, বধূদের মাটির হাঁড়ি, শিশুদের ঘোড়া-হাতি, গাঁয়ের যাত্রাপালা, কবিগান, পালাগান শহুরে সংস্কৃতিতে জায়গা পায়নিÑ গ্রামের ধ্রুপদ হয়েই রয়ে গেছে। শহুরে লোকজন মাঝেমধ্যে উৎসবকেন্দ্রিক কীর্তন-ঝুমুর-গম্ভীরা তুলে আনে উৎসব-পার্বণে। ব্যস! ওটুকুই। প্রস্তরযুগে পাথরের ঘর্ষণে আগুন উদ্ভাবন হয়ে নৃত্য উল্লাসে পশু-পাখি পুড়িয়ে খাওয়ার অভ্যাসে সূচিত হয় সভ্যতার ধারা। রচিত হয় লোকজ ধারা। প্রতœযুগ বহন করে লোকজ ধারা। কালের আবর্তে খাওয়াদাওয়ার রীতি এখন চিকেন গ্রিলে (মুরগি তাপে পোড়ানো) ঠেকেছে। গাছের ছাল-বাকর দিয়ে শরীর ঢাকার লোকজ রূপান্তরে তাঁত উদ্ভাবনে শাড়ি-লুঙ্গির যাত্রা শুরু। এই ধারাতেই এসেছে নারী-পুরুষের বৈচিত্র্যের পোশাক। বাঙালী সংস্কৃতিতে জীবনাচরণ এসেছে লোকজ ধারা থেকে। ইংরেজীতে ‘ফোকলোর’-সহজ কথায় আমাদের অরিজিন, শিকড়, বাঙালীর আকর। লোকজ বিবর্তনে বাঙালীর পথচলা ও সংস্কৃতি কয়েক হাজার বছরের। সামাজিক আচার-আচরণে পারিবারিক অবস্থানে, কর্মে সর্বোপরি বাঙালী জীবনসংস্কৃতি সবকিছুতেই আছে লোকজ ধারা। প্রতœতাত্ত্বিকরা মাটির নিচের অনুসন্ধানে ধ্বংস হওয়া অবকাঠামো স্থাপনা, মৃৎশিল্প ও অনেক নিদর্শন খুঁজে পাচ্ছেন। গবেষণায় প্রমাণ মিলছে এমন লোকজ ধারার। বাঙালী নববধূ লালশাড়ি পরে সমুখপানে দৃষ্টি মেলে এগিয়ে যায় লোকজ ধারা সঙ্গে নিয়ে। বাঙালীর দুয়ারে লোক উৎসব নিয়ে আসে বাংলা মাস। চৈত্র সংক্রান্তিতে যাত্রা শুরু নববর্ষ বরণের। গ্রামের ঘরদোর পরিষ্কার করে মাটি পানিতে গলিয়ে কাপড়ের টুকরো দিয়ে লেপে দেয়া হয়। ঢুলিরা ঢোল বাজিয়ে, বধূরা গীত গেয়ে-নেচে, পুরুষরা নৌকায় মাঝনদীতে গিয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। গাঁয়ের তরুণ গাঙে কাদা- পানিতে পলো বেয়ে মাছ ধরে। কৃষক অঘ্রানে ফসলের মাঠে আপন সুরে গান গেয়ে ধান কাটে লোকজ ছন্দে। ঘরে ফেরে ক্লান্ত দেহে। উঠানে বসে কিষানীর আদরে পায় মধুময় প্রশান্তি। শীতের রাতে চাঁদের আলোয় উঠানে বসে কিষান-কিষানীর স্বপ্নের আলাপন লোকজ প্রেমের উপাখ্যান। যদিও এসেছে কৃষির আধুনিকায়নে যন্ত্রশৈলী, এই শৈলীতে কর্ম দ্রুত এগিয়েছে তবে ফুরিয়ে যায়নি লোকজ ধারা। লোকজ সম্প্রীতির বন্ধন এসেছে বাংলা নববর্ষে। সব ধর্মবর্ণের মানুষ মিলিত হয়ে উৎসবে মাতে চিরাচরিত লোকজে। মেলায় প্রতœযুগ-নব্যযুগের লোকজ অনুষঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায়। গভীরের রূপটি অপরূপে রূপাতীত হয়ে ওঠে। শিশুকাল, গ্রামের পথঘাট, বটতলার বাঁশির সুর, ঢাকের বাদ্য, মাটির থালায় পান্তাভাত, জিলাপি, বাতাসা, দই-মুড়ি-খাগরাই, মাটির হাঁড়িপাতিল, কবিগান, পালাগান, গীতের সঙ্গে নাচ...এসবই শিকড় থেকে উঠে আসা লোকজসংস্কৃতি। লোকজ রূপ ছন্দায়িত হয়। কথা বলছে, নাচছে আবার গাইছে। অদ্বৈত রূপকে ইতিহাসের পাতায় কেউ বলেছেন ‘কথার ত্রয়ী’। টানা সংলাপনির্ভর যাত্রাকে অতীতে লোকজন বলত ‘যাত্রাগান।’ চর্যাপদে বাঙালীর আবেগ, অনুভূতি প্রকাশের বাহন লোকজ। অঞ্চলভেদে ভিন্ন রূপ। চর্যাপদের শীর্ষে রাগ-রাগিনীর (ধ্রুপদ) সঙ্গে বাঙালীর নিবিড় পরিচয় ঘটে লোকসংস্কৃতিতে। সে সময়েই শুরু বাঙালীর নিজস্ব সুরের। যার প্রভাবে কীর্তন, ঝুমুর, বাউল গানে আমাদের লোকসঙ্গীত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউলগান ও কীর্তনকে বাঙালীর নিজস্ব পরিচয়জ্ঞাপক সঙ্গীত হিসেবে উল্লেখ করেন। এভাবেই হাজার বছরের ধারায় গড়ে উঠেছে আমাদের লোকজ, কাব্য, সাহিত্য। যার শাখা-প্রশাখায় রচিত হয়েছে নানা উপাখ্যান। কাব্য, গীত, লোকগীতি, লোকনাট্য, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য। সঙ্গে অনু উপাখ্যানও আছে। সবই এক সুতোয় গাঁথা। আমাদের জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাবগান, নৌকা বাইচের গান, মুর্শিদী, আলকাপ (এই আলকাপ থেকেই গম্ভীরার সূচনা), যোগীগান, মনসার গান, লীলা, রামায়ণী, পালাগান, পটগানের সঙ্গে প্রাচীন গীত ও নাচের বলয় তৈরি হয়ে আছে। যা নানা বর্ণে পাখনা মেলে জানান দেয় বাঙালীর লোকজ ধারায় গভীরতা! ঋতু বৈচিত্র্যে বর্ষার ফুলের পরিচিতি কদম। শরতের পরিচিতি শিউলি (শেফালী)। পদ্ম, শাপলা, শালুক নিয়েও আছে কিংবদন্তি। লোকজ উপাদান নিয়েই সাজানো গ্রামবাংলার ঘর গেরস্থালি, ফসলের মাঠ। মাছ ধরা, নৌকা বাওয়া। এ ধারায়ই এসেছে কলের লাঙ্গলে চারা রোপণ। কম্বাইন্ড হারভেস্টারে ধানমাড়াই করে বস্তায় ভরা, হাসকিং মেশিন। সেচ পাম্প, নৌকায় ইঞ্জিন। আমাদের নৌকা বাইচ বিদেশী অতিথিদের দেখানো হয়। গ্রামীণ খেলা হা ডু ডু ডু, কানামাছি বৌছি, ডাঙুলি, লাঠিখেলা, পাতাখেলার লোকজ সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই এসেছে ক্রিকেট-ফুটবল। মুঠোফোন হয়েছে দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যম। গ্রামে বিয়েশাদির অনুষ্ঠানে রয়েছে লোকজ সংস্কৃতির ধারা-বরকনের গায়ে হলুদে গীত গাওয়া। বাঙালীর নিজস্ব বলয় সৃষ্টি লোকজ সংস্কৃতি ঘিরে। যাকে বাঙালীর ভূগোলও বলেছেন কেউ কেউ। বেশি যুক্তি এসেছে লোকজ পক্ষে। বঙ্গীয় বদ্বীপে নদী, হাওর-বাঁওর, বিল, কোমল কাদামাটি, মনসামঙ্গল, দিনাজপুরের বিষহরির পালা, বরিশালের বয়ানিগান, রাজশাহীর মনসার গান, মানিকগঞ্জের ভাসান যাত্রা, চাঁপাইর গম্ভীরা সবই বাঙালীর সম্ভার। হাজার বছরের লোকজের ত্রয়ী ও ধ্রুপদীর সহ¯্র আঙ্গিকের বহু শাখা-প্রশাখা আজও বাঙালী সংস্কৃতির ধারা।
×