ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসের বিস্মৃত অধ্যায়

ক্ষমতাহীন নায়েব নাজিম, ঢাকার আদি নবাব

প্রকাশিত: ১১:১২, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ক্ষমতাহীন নায়েব নাজিম, ঢাকার আদি নবাব

মোরসালিন মিজান ॥ বহুকালের পুরনো শহর ঢাকা। এই শহরে কত শাসক এসেছেন, বিদায় নিয়েছেন! তবে নায়েব-নাজিমদের ইতিহাসটি আলাদা করে বলার মতো। ঢাকার আদি নবাব হিসেবে গণ্য করা হয় তাদের। নায়েব নাজিমদের কিছু স্মৃতিচিহ্ন এখনও এই শহর ধারণ করে আছে। কৌতূহলী চোখে দেখছেন রাজধানীবাসী। কিন্তু কেমন ছিল সেই সময়টা? কারা হয়েছিলেন নায়েব নাজিম? ঢাকার জীবন, সমাজ, সংস্কৃতিকে কতটা প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন তারা? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হয় ইতিহাসের কাছে। অতীত ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, ১৭১৭ সাল থেকে ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত ঢাকায় নায়েব নাজিমরা দায়িত্ব পালন করেন। তার আগে ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল সা¤্রাজ্য নানা অংশে বিভক্ত হতে থাকে। মুর্শিদ কুলী খান তখন বাংলায় একটি অর্ধস্বাধীন শাসকগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। এ শাসন নওয়াবী শাসন হিসেবে পরিচিত। আঠারো শতকের শুরুতে দূরবর্তী এলাকা শাসন এবং অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বহিরাগতদের দমনে নওয়াবকে সহায়তা করার জন্য নায়েব নাজিমের পদ সৃষ্টি করা হয়। নায়েব নাজিমরা প্রায় অর্ধশত বছর ধরে ঢাকা শাসন করেন। সংখ্যায় তারা ছিলেন মোট ১৬ জন। ঢাকার উপপ্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয় তাদের। তবে নায়েব নাজিমরা অধিকাংশ সময় ঢাকার বাইরে অবস্থান করতেন। তাদের নিযুক্ত করা প্রতিনিধিরা ডেপুটি নায়েবে নাজিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কোম্পানি শাসন চালু হওয়ার পর আরও ৬ জন ডেপুটি হিসেবে এই দায়িত্ব পালন করেন। নায়েব নাজিমদের বসবাসের জন্য ১৭৬৫-৬৬ সালের দিকে ঢাকার নিমতলীতে বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। নির্মাণ কাজ তত্ত্বাবধান করেন ঢাকার প্রথম ব্রিটিশ সামরিক শাসক ক্যাপ্টেন আর্চিবল সুইন্টন। বিপুল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল এই প্রাসাদ। বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল, শহীদুল্লাহ হল, অমর একুশে হল ও এর আশপাশের এলাকা প্রাসাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে জানা যায়। ১৮৯৭ সালে শক্তিশালী ভূমিকম্পে প্রাসাদসহ অধিকাংশ স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। একটি প্রবেশদ্বার এখনও স্মৃতির জানালা হয়ে আছে। এটিই বর্তমানে নিমতলী দেউড়ি বা নিমতলী গেট নামে পরিচিত। এশিয়াটিক সোসাইটি এখানে একটি জাদুঘর স্থাপন করেছে। এর পাশাপাশি স্মৃতি হয়ে আছে বিখ্যাত বারোদুয়ারী। ইতিহাসবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বারোদুয়ারী নায়েব নাজিমদের দরবার কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১২টি দরজা থাকায় এর নাম হয় বারোদুয়ারী। এখানে প্রতিদিন একটি বিশেষ সময়ে নায়েব-নাজিমরা মহল্লার সর্দারদের সঙ্গে বসতেন। ১২টি দ্বার দিয়ে ঢাকার ১২ মহল্লার ১২ সর্দার প্রবেশ করতেন। ঢাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন নিয়ন্ত্রণকারী এই সর্দারদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন নায়েবরা। পাশাপাশি এখানে দেশী-বিদেশী অতিথিদের সঙ্গে বৈঠক হতো। ভবনের সামনে বসানো শিলালিপি থেকে জানা যায়, বারোদুয়ারীতে মোট ছয়জন নায়েব দরবার করেছেন। ১৭৭৬ সাল থেকে ১৭৭৮ সাল পর্যন্ত দরবার করেন জেসারত খান। ১৭৭৮ থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত দরবার করেন হাশমত জং। শামসুদৌল্লা এই কক্ষে দরবার করেন ১৮২২ থেকে ১৮৩১ পর্যন্ত। ১৮৩১ থেকে ১৮৩৪ সাল পর্যন্ত দরবার করেন কামরুদ্দৌলা। ১৮৩৪ সাল থেকে ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত দরবার করেন শেষ নায়েব গাজী উদ্দীন। তবে ঢাকার নায়েব-নাজিমদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন নুসরত জং। ১৭৮৫-১৮২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৭ বছর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এই নায়েব নাজিম বর্ণাঢ্য জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিলেন। ১৮০১ সালের একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, নুসরাত জংয়ের ভৃত্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০০। বাইরে বের হওয়ার সময় তার সঙ্গে থাকত ৬ জন ঘোড়সওয়ার। ৬ জন বর্শাধারী পাইক ও প্রায় চল্লিশ জন নিরস্ত্র অনুচর। তার চেয়ে বড় কথা, এই নায়েব ঢাকাবাসীর কাছে বিশেষ প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। সে কথা জানিয়ে তায়েশ লিখেছেন, তিনি ধনী-দরিদ্র সকলের সঙ্গে অত্যন্ত হৃষ্টচিত্তে কথাবার্তা বলতেন। বিত্তহীনদের অত্যন্ত ভালবাসতেন। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের বর্ণনা থেকে জানা যায়, নুসরাত জং সুকুমারকলার প্রতি বেশ আগ্রহী ছিলেন। সে কালের বিষ্টিজনরা তার এই সুকুমারবৃত্তি ও মহৎ হৃদয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। নুসরাত জংয়ের আরেকটি কীর্তি ‘তারিখ-ই-নুসরাত জঙ্গী’। তার লেখা এই পা-ুলিপিতে সমসাময়িক ঢাকার অনেক তথ্য সংযোজিত হয়েছে। অবশ্য তারও আগে, ক্ষমতা হারান নায়েব নাজিমরা। ১৭৭২ সালে লর্ড হেস্টিংসের সময় নতুন শাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়। প্রত্যেক জেলায় নিয়োগ দেয়া হয় কালেক্টর। ঢাকা প্রশাসনও কালেক্টরের অধীনে চলে যায়। নায়েব নাজিম বা তাদের প্রতিনিধিরা পদ ধরে রাখতে সক্ষম হন বটে। ক্ষমতা বলতে কিছুই তাদের হাতে থাকে না। নায়েব নাজিমদের শেষভাগে এসে ঢাকার প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে। সুবেহ বাংলার রাজধানী ও রাজমহল মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হয়। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রটি দুর্বল হয়ে পড়ে। বাইরে থেকে আগত ব্যবসায়ী ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মুর্শিদাবাদমুখী হয়। আরও নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায় ঢাকা। এর পরও ঢাকার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাজুড়ে আছেন নায়েব নাজিমরা। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ইতিহাসবিদ ড. ফিরোজ মাহমুদ জনকন্ঠকে বলেন, নায়েব নাজিমদের সময়কালকে দুই ভাগে ভাগ করে বিচার করতে হবে। প্রথমভাগে তারা ছিলেন স্বাধীন। স্বাধীন নায়েব নাজিমরা ঢাকার প্রশাসন সমাজ সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। শেষভাগে এসে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হলেও, ঢাকাবাসীর কাছে তাদের গুরুত্ব খুব একটা কমেনি। তিনি বলেন, আহসান মঞ্জিলের নবাবরা নবাব ছিলেন বটে। আদি নবাব ছিলেন নায়েব-নাজিমরা। ঢাকায় নবাবী আমলের শেষ প্রতিনিধি হিসেবে ইতিহাস তাদের আলাদা জায়গা হয়েছে। ঢাকার ইতিহাস লিখতে হলে নায়েব নাজিমদের কথাও লিখতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
×