ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিজেকে খুঁজে নেয়ার সাজেক

লোকালয় থেকে বহু দূরে অনন্য এক মেঘের দেশ

প্রকাশিত: ১১:০১, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

লোকালয় থেকে বহু দূরে অনন্য এক মেঘের দেশ

মোরসালিন মিজান, সাজেক থেকে ফিরে ॥ সাজেক ভ্রমণ এমন কোন কঠিন কাজ নয়। আবার খুব যে সহজ, না, তাও বলা যাবে না। দীর্ঘ আঁকা বাঁকা পাহাড়ী পথ। কখনও একদম উপরে উঠে যাচ্ছে গাড়ি। কখনও ঢাল বেয়ে নিচে নামছে। রাস্তার দুই ধারে সবুজ। গায়ে গা লেগে থাকা পাহাড়। আসা যাওয়ার পথে দেখা। দেখতে কী যে ভাল লাগে! একটু পরপরই মনে হয়, সামনে আর কিছু নেই। পথ বুঝি শেষ হলো। হয় না। আনন্দ ভ্রমণে কিছুটা ক্লান্তি যোগ হওয়ার এক পর্যায়ে গাড়ি এসে থামে সাজেকে। গন্তব্যে পৌঁছার পর মন আবার সতেজ হয়ে ওঠে। ফড়িংয়ের মতো নেচে ওঠে মন। লোকালয় থেকে অনেক অনেক দূরে। অনন্য এক মেঘের দেশ। এই দেশে পৌঁছতেই এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। তবে তা আনন্দের। নিজেকে ফিরে পাওয়ার। নাগরিক ব্যস্ততা হুড়োহুড়ি সব ভুলে, ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে এখানেই পড়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সাজেকের মূল আকর্ষণ মেঘ। একে অনেকেই মেঘের বাড়ি বলে জানেন। বিশাল বিশাল পাহাড়ের গা ঘেঁষে সাদা মেঘ ওড়ে বেড়াচ্ছে। ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। চাইলেই হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয়া যায়! আকাশ ও পাহাড়ের অদ্ভুত মিতালী, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত দেখারও এটি চমৎকার জায়গা। পাহাড়ীদের সংগ্রামী জীবন, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ারও সুযোগ করে দেয় সাজেক ভ্রমণ। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত পর্যটন কেন্দ্রটি অপেক্ষাকৃত নতুন। কিন্তু জনপ্রিয়তায় দারুণ এগিয়ে। এটি রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত। মূলত ইউনিয়নটির নাম সাজেক। বাংলাদেশের এটি সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন বলে ধারণা করা হয়। আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। সাজেকের দক্ষিণে রাঙ্গামাটির লংগদু। পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা। পূর্বে ভারতের মিজোরাম। উত্তরে ত্রিপুরা। পর্যটকদের প্রাথমিক সমাবেশটি ঘটে সাজেকের রুইলুইপাড়ায়। জেনে অবাক হতে হয়, এই গ্রাম ১৮৮৫ সালে গঠিত! অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ১৭২০ ফুট উঁচুতে। তারও উপরে কংলাক পাহাড়। উচ্চতা প্রায় ১৮০০ ফুট। এই পাহাড়ে অবস্থিত কংলাক পাড়া। দুই পাড়া ঘুরে বেড়ানোর নামই সাজেক ভ্রমণ। গত কয়েকদিন আগে সাজেক ঘুরে দেখার সুযোগ হয়। রাঙামাটি জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও, খাগড়াছড়ি শহর থেকে যাতায়াত করা সহজ। এখান থেকে যাতায়াতের প্রধান বাহন ‘চাঁন্দের গাড়ি।’ বিশেষ এই জিপ ছাড়াও আছে সিএনজি অটোরিক্সা। এমনকি ভাড়ায় মোটরসাইকেল পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত বা সরকারী গাড়ি নিয়ে পাহাড়ে উঠে যাওয়ার দৃশ্যও চোখে পড়ে। দিনে দু’বার সকাল সাড়ে ১০টায় এবং বিকেল সাড়ে ৩টায় আসা যাওয়া করা যায়। সে অনুযায়ী, সকালে খাগড়াছড়ি শহর থেকে ‘চাঁন্দের গাড়ি’ ঠিক করা হয়। দীঘিনালায় গিয়ে এটি যুক্ত হয় মূল বহরের সঙ্গে। অর্ধশতাধিক গাড়ি একসঙ্গে যাত্রা করে। কিছুদূর যেতেই সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট। সেখানে পর্যটকদের যাবতীয় তথ্য দেয়ার পর পুনরায় চলতে শুরু করে গাড়ি। লুডুতে এঁকে রাখা সাপের মতো আঁকা বাঁকা পথ। গাড়ি ক্রমাগত ওপরের দিকে উঠছে। একইভাবে নামছে নিচের দিকে। থিমপার্কের রাইডে চড়ার অনুভূতি হয় মনে। রাস্তার দুই ধারে পাহাড়। ঘন সবুজ। মাঝে মাঝে কাঁচা ঘর বাড়ি। আদিবাসী শিশুদের মিষ্টি মুখ। কেউ গাড়িতে বসে দেখছেন। কেউ ওঠে গেছেন গাড়ির ছাদে। এভাবে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টার জার্নি। কেউ কেউ ক্লান্ত। বাকিরা জয় করার আনন্দে মাতোয়ারা। মেঘের রাজ্যে এদিন মেঘই স্বাগত জানালো আমাদের। দুপুরের দিকে রুইলুই পাড়ায় পৌঁছতেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যে সাজেকে পা রাখা হলো। এবং এই পায়ের নিচে বিশাল পাহাড়! অবশ্য মেঘের কারণে সামান্য দূরের জিনিসটিও দেখা সম্ভব হচ্ছিল না। সাদা মেঘের আড়ালে চলে গিয়েছিল প্রকৃতি। এভাবে মেঘ দেখার, বৃষ্টিতে ভিজে শীতল হওয়ার প্রথম সুযোগটি পেয়ে গেলাম আমরা। অনেকে হাত দিয়ে মেঘ ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন। হা করে গিলে খেতে চাইলেন কেউ কেউ। কাছের মানুষটিকে মেঘের মধ্যে ঠেলে দিয়ে ফের খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করলেন। এভাবে কিছু সময় খেলাধুলার পর আগে থেকে ঠিক করে আসা রিসোর্টের পথে পা বাড়ালাম আমরা। কাঠের দু’তলা বাড়িতে ব্যাগ ইত্যাদি রেখে সামান্য বিশ্রাম। তার পর বের হতেই দেখা গেল অন্য ছবি। মেঘ ওড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। আশপাশটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এখন। রুইলুই পাড়া থেকে চমৎকার একটি কংক্রিটের রাস্তা কংলাক পাড়ার দিকে চলে গেছে। বলা চলে, এই রাস্তাটুকুই সাজেক। দুই ধারে পাহাড়। প্রেমিক প্রেমিকার মতো একটি অন্যটিকে স্পর্শ করে আছে। আকাশকে চুমু খাচ্ছে পাহাড়। এর মাঝেই লক্ষ্য করা গেল, নিজের মোবাইল ফোনটি কাজ করছে না। কারণ জানতে চাইলে স্থানীয়দের একজন বললেন, এখানে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক নেই। কথা শুনে মন কিছুটা খারাপ হয়েছিল। ভাল হতেও সময় লাগলো না। চেনা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার এই তো সুযোগ! রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া। এই যাওয়ার জন্য সাজেকের কোন তুলনা হয় না। সাজেকে প্রবেশের মুখে ছোট্ট করে একটি গার্ডেন করা হয়েছে। স্টোন গার্ডেন নাম। এখানে কয়েকটি বড় পাথর। একটি থেকে অন্যটিতে পৌঁছতে কাঠের সেতু করে দেয়া হয়েছে। আছে দোলনাও। পাথরের উপর থেকে এবং দোলনায় দুলতে দুলতে প্রকৃতি দেখা হলো। রাস্তাটি ধরে কংলাকের দিকে এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে একাধিক হেলিপ্যাড। উঁচু খোলা জায়গা ঘিরে পর্যটকদের ভিড়। বিভিন্ন বয়সী মানুষ এখান থেকে চারপাশ দেখছেন। ঝিরি ঝিরি হাওয়া তাদের গায়ে এসে লাগছে। তরুণ তরুণীরা দু’ হাত শূন্যে মেলে ধরে পাখি হতে চাইছেন। মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় এমন আরও কত দৃশ্য ধরা পড়ছিল! ক্যামেরার প্রথম ক্লিকে মেঘ আছে। পরের ক্লিকেই সবুজ বন। লুকোচুরিটা সত্যি মনে রাখার মতো। বিকেলে এখানে দাঁড়িয়ে দেখা হয় সূর্যাস্ত। পরদিন একই স্থান থেকে সূর্যোদয় দেখা হয়। এ জন্য ভোর হওয়ার অনেক আগে থেকে উপস্থিত হতে থাকেন পর্যটকরা। বহু মানুষ একসঙ্গে দেখেন অপরূপ দৃশ্য। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের ছবিটা কত সুন্দর তা বর্ননা করে, সাজেক যাননি কোনদিন এমন পাঠকের দুঃখ বাড়াতে চাই না! প্রধান হেলিপ্যাডটি থেকে নেমে সামনের দিকে কিছু সময় হাঁটলে কংলাক। একটু শক্ত সামর্থ্য যারা তারা কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার চিন্তা করেন। বঁাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে আমরাও উপরের দিকে ওঠতে শুরু করলাম। একসময় দৃশ্যমান হলো স্থানীয় আদিবাসীদের বসতি। কাঁচা ঘরে দিব্যি আছেন তারা। দেখে বিস্ময় কাটে না। সর্বোচ্চ উচ্চতায় হওয়ায় এখান থেকে মেঘটা আরও ভাল দেখা যায়। দেখতে দেখতে কখন যে সময় চলে যায়, টেরও পাওয়া যায় না। অবশ্য সাজেকে থাকার ভাল ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অনেকগুলো হোটেল ও রিসোর্ট আছে এখানে। স্টোন গার্ডেনের পাশে সবচেয়ে বড় ও আধুনিক অট্টালিকা নির্মাণ করেছে সেনাবাহিনী। হেলিপ্যাডের পাশেই সেনাবাহিনীর আরেকটি রিসোর্ট। নাম রুণ্ময়।’ ইট সিমেন্টে তৈরি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। এর উপরে গোলাপী রঙের ঢেউ টিন। মাটির কাছাকাছি নেমে এসেছে। রিসোর্টটি দেখে সাজেক চেনা যায়। তবে অধিকাংশ রিসোর্ট কাঠে নির্মিত। প্রকৃতির সঙ্গে ভাল মানায়। প্রায় সব হোটেল কক্ষের বারান্দায় বসে পাহাড় আর মেঘের ওড়াওড়ি দেখা যায়। দরজা তাই খোলাই থাকে। রিসোর্টের নামকরণের ক্ষেত্রেও মেঘ শব্দটির প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। মেঘপুঞ্জি, মেঘাদ্রি, মেঘের ঘর, মেঘমাচাং, মেঘালয়, মেঘকাব্যÑ আরও কত নাম! জানা গেল, সব মিলিয়ে ১০৬টা রিসোর্ট রয়েছে সাজেকে। খাওয়ারও সুব্যবস্থা রয়েছে। মোট ১৮ রেস্তরাঁ। সন্ধ্যায় বেশ কয়েকটির সামনে লাকড়ি জ্বালিয়ে বারবিকিউ করা হয়। স্থানীয়দের খাবারের স্বাদ নিতে চান? আছে সে ব্যবস্থাও। একটি রেস্তরাঁর নাম ‘পেদা টিংটিং।’ মানে কী? জানতে চাইলে চাকমা মালিক টিপু চাকমা বললেন, ভরা পেট। এখানে স্পেশাল খাবার মুরগির ভর্তা। আছে কচি বাঁশসহ আরও নানা রেসিপি। খেয়ে দেখা গেল পেট নয় শুধু, মনও ভরে গেছে। আরেকটি রেস্তরাঁর নাম ‘ছিম্বাল।’ এখানে খাবারের পাশাপাশি বই রাখা আছে। চা বা কফি খেতে খেতে পড়া যেতে পারে জীবনানন্দ কিংবা হুমায়ুন আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা। রেস্তরাঁর মালিক বয়সে তরুণ। কর্মচারীদের পাশাপাশি নিজেও অতিথিদের আপ্যায়ন করতে ভালবাসেন। এদিকে, নতুন নতুন রিসোর্ট রেস্তরাঁর ফাঁকে ফাঁকে সাজেকে আছে স্থানীয়দের কাঁচা ঘরবাড়ি। এসব ঘর বাড়িতে বাস করছেন লুসাই, পাংখোয়া, ত্রিপুরা ও চাকমা সম্প্রদায়ের আদিবাসী জনগোষ্ঠী। গরবা নামের একটি দুই তলা হোটেলের ঠিক পাশে একটি কাঁচা ঘর। বাইরে থেকে দেখা গেল, চটের তৈরি দোলনায় নবজাতক শিশুকে দোল খাওয়াচ্ছে আরেক শিশু। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, এমন অকৃত্তিম দৃশ্য ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে সাজেক থেকে। আর যেন হারিয়ে না যায়। ফিরে আসতে আসতে কেবলই বলতে মন চাইছল, আর যেন হারিয়ে না যায় ওরা।
×