ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে গেছে সৌন্দর্যের অনুপম অনুষঙ্গ

নদীমাতৃক বাংলাদেশে পালতোলা নৌকা আজ বিরল

প্রকাশিত: ১১:০২, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

নদীমাতৃক বাংলাদেশে পালতোলা নৌকা আজ বিরল

শেখ আব্দুল আওয়াল ॥ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনা করা বা এর চিত্র তুলে ধরা একটি কঠিন বিষয়। কেননা আমাদের এই দেশটিকে সৃষ্টিকর্তা যেন নিজ হাতে সাজিয়েছেন। কবি-সাহিত্যিকরা তাদের লেখনীতে বাংলার প্রকৃতির বন্দনা করেছেন। সৌন্দর্যের আধার প্রিয় মাতৃভূমি বছরের একেক সময় একেক রূপে আমাদের সামনে হাজির হয়ে থাকে। তেমনি আমাদের মাঝে হাজির হয় নবরূপে শরতকাল। শুভ্র মেঘের দিগন্ত বিস্তৃত আকাশে সাদা ও নীলের খেলা বিমোহিত করে আমাদের। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে শরতকে কাছে পাবার তাড়না সবার মাঝে বিরাজ করে। শরত আর কাশফুল যেন অবিভাজ্য সত্ত্বা। শরতের দিগন্ত জোড়া মাঠে সাদা কাশফুলের মাঝে হারিয়ে যেতে মন মানে চায়। মাঝি-মাল্লাদের মনে লাল সবুজের পালতোলা নৌকা মাঝ নদীতে আনন্দ জাগায় শরতে। বর্ষা-শরতের অপার শোভায় বিমোহিত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন ‘শরৎ তোমার অরুন আলোর অঞ্জলী ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলী, শরৎ তোমার শিশির ধোয়ার কু-লে বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে আজ প্রভাতের হৃদয় উঠে চঞ্চলে ...’। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলার প্রকৃতি নিয়ে লিখেছেন ‘শরৎ যেন ভেসে ওঠে অপরূপ রূপে।। আজি কি তোমার মধুর মুরতি হেরিনো শারদ প্রভাতে! হে মাত বজ্র শ্যামল অঙ্গ ঝলিছে অমল সুভাতে। বাঙালী জাতি হিসেবে আমাদের রয়েছে নদীকেন্দ্রিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। আধুনিক যানবাহনের বহুল প্রচলনের আগে আমাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নদী আর নৌকা। যুগের হাওয়া লেগেছিল পালে, দ্রুত থেকে দ্রুততর ছুটতে হবে আমাদের। তাই দ্রত ছুটে যাচ্ছি আমরা মৃত্যুর দিকে, ধারণ করে চলছি যান্ত্রিক সভ্যতা। তাই পালতোলা নৌকাতে এখন আর আমাদের চলে না। ইঞ্জিনচালিত নৌকা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। কালো ধোঁয়ার পরিবেশ মরে যাচ্ছে। এতে আমাদের সন্তানেরা পাচ্ছে বিষাক্ত পরিবেশ। বেড়ে উঠবে এজমা নিয়ে-‘দুরারোগ্য অসুখের শ্বাসকষ্টের বিষাক্ত বাতাসে। বর্তমানে কালেভদ্রে দেখা মিলে পালতোলা নৌকার। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা, গানে, উপন্যাসে বাংলার প্রকৃতির সবকিছুই ফুটে উঠে। কবিগুরু তার ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে যে বর্ণনা দিয়েছেন বাংলার প্রকৃতির সেই রূপ চিরন্তন হয়ে আছে। বর্ষা-শরৎ প্রকৃতি মানব হৃদয়ে রোমান্টিকতার যে সুর তুলে ধরে তা অন্য কোন ঋতুতে মিলে না। বিশ্বজুড়ে জলবায়ুর যতই পরিবর্তন হোক বাংলার ষড়ঋতুর হেরফের হতে পারে। কিন্তু বৈচিত্র্যে পরিবর্তন আসতে এখনও অনেক দেরি। এই সময়টা ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে চোখ পড়ে নদের দিকে উত্তাল ঢেউ নেই, নদীতে জলরাশির স্তব্ধতা আকাশ একটু মেঘলা হলেই ঢেউ নেচে উঠে। নদীর তীর ও কোথাও সামান্য সবুজ কোথাও নদীর কিনারে কাশফুল ঘেঁষে যখন নৌকা বয়ে যায় তখন মাঝিদের সঙ্গে যাত্রীরা অনুভব করে অনাবিল সুখ। এই সময়ে প্রকৃতির বাতাস এসে দোল খায় পালতোলা নৌকায়। একটা সময় নদীর কিনারে দিয়ে গুনটানা (দড়ি) নৌকা চলত এখন আর তা চোখে পড়ে না। বাতাসের অনুকূলে যাওয়ার জন্য বড় কাপড় দিয়ে আটকানো হতো পালতোলা নৌকা। আজকাল তাও কমে গেছে নৌকার পালকে কোন কোন এলাকায় বলা হয়ে থাকে বাদাম। যার নৌকা যত বড় বাদাম থাকত সেই নৌকা বাতাসের গতির সঙ্গে জুড়ে চলত। নদী আর নৌকা ছিল আমাদের গ্রাম জীবনের বহমানতা। নদী, হ্রদ কিংবা সমুদ্র তীরবর্তী এক জনপদের সঙ্গে আরেক জনপদের যোগাযোগের সাহায্য করে আসছে নৌকা, বহু বছর আগে থেকেই বাংলাদেশের নদ-নদী খাল-বিল অজস্র এমন অনেক এলাকা রয়েছে আজো, যেখানে মানুষের জীবন নৌকা ছাড়া অচিন্তনীয় কিন্তু এ বাহনটির ইতিহাস কি তাও কেউ জানে না। তবে নৌকার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগে¦দে। মানসা মঙ্গল ও বাংলার সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস কাব্যে বণিক চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যতরী ১৪ডিঙ্গা নির্মাণ করে বাণিজ্য যাত্রা করে ছিলেন। ক্রিট দ্বীপের মানুষেরা ১ লাখ ৩০ হাজার বছর আগে নৌকার ব্যবহার জানত বলে জানা যায়। বাংলাদেশে সবচেয়ে পরিচিত নৌকার নাম হচ্ছে ডিঙ্গি। নদীর তীরে যারা বসবাস করেন তারা সকলেই এই নৌকাটি ব্যবহার করেন নদী পারাপার বা অন্যান্য কাজে। আকারে ছোট বলে এই নৌকাটি চালাতে একজন মাঝিই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে এতে পালও লাগানো হয়। প্রতœতত্ত্ববিদদের আবিষ্কৃত সবচেয়ে পুরনো নৌকা ৭ থেকে ১০ হাজার বছর আগের। কুয়েতের ফাইলাকা দ্বীপে পাওয়া যায় সমুদ্রগামী জাহাজ বা ‘রিড বোড’ তৈরি হয়েছিল ৭ হাজার বছর আগে। মহাসাগরে খ্রীস্টপূর্ব ৪ হাজার থেকে ৩ হাজার সালে প্রচুর জলযানের আনাগোনা ছিল বলে ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেছে। সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা রকমের নৌকার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। এখন থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বছর আগে ভূমধ্যসাগরে বহু দাঁড় বিশিষ্ট নৌকা দেখা যেত। নৌকায় দাঁড় টানার কাজে ব্যবহার করা হত ক্রীতদাসদের। দাঁড় টেনে নৌকা বাওয়া অত্যন্ত শ্রমসাধ্য ও ক্লান্তিকর। পালের উদ্বাবন এ অবস্থা থেকে মানুষকে খানিকটা মুক্তি দিয়েছে। দাঁড় টানার সঙ্গে পাল টানানো হলে নৌকার গতি বেড়ে যায় এবং হাওয়ার গতিতে নৌকা আরও বেশি বেগমান হয়। তখন থেকেই নানা ধরনের পালের ব্যবহার শুরু হয় বাতাসের শক্তি কাজে লাগানোর জন্য। বাংলার বারভূইয়াদের একটা বিরাট বহর ছিল ঈশা খাঁ ১৫৭৫ খ্রিীস্টাব্দে বাংলা থেকে নওয়াবদের বিতাড়িত করেন রণতরীর সাহায্যে। বিক্রমপুরের কাছে নৌযুদ্ধে মান সিংহের নৌবহরের ওপর তার চূড়ান্ত বিজয় ষোড়ষ শতকে বাংলার নৌশক্তির একটি উজ্জ্বল প্রমাণ। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে পালতোলা নৌকার প্রচলন প্রায় উঠে গেছে বললেই চলে। নদীতে মাঝে মধ্যে পালের নৌকা দেখা মেলে । পালতোলা নৌকা চলাচলের দৃশ্য এখন বিরল, এটি এখন শুধুই স্মৃতি।
×