ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নুসরাত হত্যা মামলা

রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ, আসামি পক্ষের আজ থেকে

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ, আসামি পক্ষের আজ থেকে

নিজস্ব সংবাদদাতা, ফেনী, ১৬ সেপ্টেম্বর ॥ ফেনী সোনাগাজীর মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত হত্যা মামলায় রাষ্ট্র পক্ষ ও বাদী পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়েছে। মঙ্গলবার আসামি পক্ষের আইনজীবীগণ তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন। আদালত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত আদালত মুলতবি করেছেন বিচারক । আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হলে মামলার রায় ঘোষণার দিন ঘোষণা করবেন আদালত। রায় ঘোষণার দিন কাউন্টডাউন করছেন নুসরাতের পরিবার, আসামিদের পরিবার, বাদী- বিবাদীর আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্ট সকলে। সোমবার আদালতে মামলার কর্যক্রম শুরুর আগে ইতোপূর্বে আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার উপস্থাপিত আসামিদের একে অপরের সঙ্গে মোবইলে কথপোকথনের অডিও এবং নুসরাতের ডায়িং ডিকলারেশনের ভিডিও প্রক্টেরের মাধ্যমে পুনরায় আদালতে উপস্থাপন করা হয়। আদালতে রাষ্ট্র পক্ষ ও বাদী পক্ষ যুক্তিতর্কে নুসরাত হত্যাকা-ে আসামি যারা বিভিন্নভাবে জড়িত ছিল তার বিস্তারিত বর্ণনা দেন। ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতের হত্যা মামলায় সোমবার রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট আক্রমুজ্জামান যুক্তিতর্কে নুসরাত হত্যাকা-ের যুক্তিতর্কে হাইকোর্ট বিভাগের ৮-১০টি মামলার রায়ের উদাহরণ উপস্থাপন করে হত্যাকা-ে যারা সরাসরি জড়িত ছিল তারা ছাড়াও যারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছে তাদেরও একই শাস্তি হয়েছে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে রেফারেন্স পেপার আদালতে জমা দেন। হত্যাকা-ে সরাসরি জড়িত আসামিদের সহযোগিতা করার জন্য আদালতের কাটগড়ায় থাকা আসামিদের কার কি ভূমিকা ছিল তার বিস্তারিত আদালতে উপস্থাপন করেন। এ্যাডভোকেট আক্রমুজ্জামান আদালতে উপস্থাপন করেন যে হাইকোর্ট বিভাগের মামলার ( আবসার হোসেন বনাম রাষ্ট্র) রায়ে বলা হয়েছে এক বা ততোধিক লোক কোন অপরাধ, সংগঠিত করলে যারা সহযোগিতা করেছে তারা একই সাজা ভোগ করবে। একইভাবে অপর মামলায (৫৬ ডিএলআর - বরেন্দ্রকুমার ঘোষ বনাম রাষ্ট্র) কোন অপরাধ সংগঠনের জন্য সরজমিনে বা স্বশরীরে ঘটনাস্থলে থাকতে হবে এমন কথা নেই। যারা পর্দার অন্তরালে থেকে ঘটনা জন্য আর্থিক, বুদ্ধি, পরামর্শ, প্রভাব খাটিয়ে বা অন্যকোনভাবে সহযোগিতা করে। তার জন্যও একই শাস্তি প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ প্রচলিত দ- বিধির ১০৯ ও ৩৪ ধারা অনুসারে ঘটনার সহযোগী হিসেবে প্রযোজ্য হবে। হাইকোর্ট বিভাগের এক মামলার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, পলাশ কারাগারের কনডেম সেলে থেকে মিজানকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল। সে মমলায় ভিডিও ক্লিপ আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে আমলে নিয়েছেন। বর্তমান আইনে যে কোন ধরনের ডিজটাল প্রমাণ আদালতে সাক্ষ্য হিসাবে আমলযোগ্য। যা সাক্ষ্য আইনের ৩ ধারার সঙ্গে যোগ হয়েছে। এ মামলায় ৪ জন আসামির আদালতে ১৬৪ ধারায় দায়স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নেয়া হয়নি। এরা হলেন আসামি রুহুল আমিন, কাউন্সিলর মকসুদ আলম, আফসার উদ্দিন ও শামীম (২)। এ প্রসঙ্গে নন কনফেশনাল একিউজড এর বিষয়ে তিনি আদালতে হাইকোর্ট বিভাগের ১৫ বিএলসি, ২৩ ডিএলআরে উদাহরণ উপস্থাপন করেন। যেখানে বলা হয়েছে কোন আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী না থাকলেও অপর আসামি যারা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে তাদের সেই জবানবন্দীতে যার যার নাম উল্লেখ আছে তারা আসামি হিসেবে গণ্য হবে এবং সমান সাজা পাবে। আসামি রুহুল আমিন মাদ্রাসার সহ-সভাপতি হয়েও ঘটনার পর এ নিয়ে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ বা নুসরাতকে দেখতে বা তার কোন খোঁজখবর নেননি। অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা স্থানীয় নেতা ও মাদ্রাসার সহ-সভাপতি রুহুল আমিন ও কাউন্সিলর মকসুদ আলমের আশীর্বাদপুষ্ঠ। এরা সোনাগাজীর গডফাদার। ফুর্তির শ্লীলতাহানির ঘটনা বিচার করলে নুসরাতের ঘটনা ঘটত না। এরা অধ্যক্ষকে রক্ষা করা ও ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেছিল। আদালতে উপস্থাপিত মোবাইল কলের অডিও তে স্পষ্ট যে রুহুল আমিন আগ থেকে ঘটনা সম্পর্কে জানতেন। আসামিদের নিরাপদ স্থানে থাকতে বলেছেন। থানা পুলিশ ম্যানেজ করবেন এবং থানা পুলিশের বিষয় তিনি দেখবেন বলে আসামিদের আশ্বস্ত করেছেন। সিরাজউদদৌলা করাগারে থেকে তার অনুসারীদের এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সব সময় রুহুল আমিন ও মাকসুদ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দিতেন। যা সিরাজউদদৌলা তার ১৬৪ ধারায় আদালতের জবাবন্দীতে উল্লেখ করেছেন। মকসুদ আলম ঘটনার পর সাহাদাত হোসেন শামীমকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য। যা সাহাদাত হোসেন শামীম আদালতে ১৬৪ ধাারার জবানবন্দীতে উল্লেখ করেছেন। নুসরাতকে হত্যার মূল উদ্দেশ্য ছিল নুসরাত মারা গেলে সিরাজউদৌলার বিরুদ্ধে দায়ের করা শ্লীলতাহানির মামলার কোন প্রমাণ থাকবে না। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট আক্রমুজ্জামান সবশেষে আদালতে বলেন তিনি সকল আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি প্রার্থনা করেন। কারণ- দেশে ন্যায়বিচার আছে তা প্রমাণের জন্য এ মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তির সঙ্গে আইনের বিধান অনুযায়ী এক লাখ টাকা জরিমানা দ- দাবি করছেন। শুধু সারাদেশ নয় সারা পৃথিবীর মানুষ এ নৃশংস হত্যার বিচারের রায় দেখতে অপেক্ষা করছে। রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে বাদী পক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট শাহজাহান সাজু যুক্তিতর্কে উপস্থাপন করেন যে ৬ এপ্রিল ঘটনার দিন আসামি আফসার মোবাইলে নুসরাতের ভাই নোমানকে সিরাজউদদৌলার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি উঠিয়ে নেয়ার জন্য শেষবারের মতো নির্দেশ দেন। নুসরাত নিরাপত্তাহীন থাকায় তার ভাই নোমান পরীক্ষার সময় তাকে হলে বসিয়ে যেতেন। পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘটনার দিন নোমান কে মাদ্রাসার গেইটের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। আসামিরা ঘটনা পর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী নুসরাত আত্মহত্যা করতে চেয়েছে বলে প্রচার চালাতে থাকে। আসামি সাহাদাত হোসেন শামীম মোবাইলে সকলকে জানায় নুসরাত সাইক্লোন সেন্টারের ছাদে আত্মহত্যা করতে গায়ে আগুন দিয়েছে। যা আদালতে উপস্থাপিত অডিও ক্লিপে দেখা গেছে। তিনি আসামিদের এ ঘটনায় কার কি ভূমিকা ছিল তার বর্ণনা দেন। সবশেষে ন্যায়বিচারের স্বার্থে এবং আর কারও বোন, কারও মেয়ে, কারও বান্ধবী যেন এমন নৃশংস ঘটনার শিকার না হয় তার জন্য আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তির প্রার্থনা করেন। বিচার শুরুর ৪৭ কার্য দিবসে ৮৭ জন সাক্ষী স্বশরীরে আদালতে এসে সাক্ষ্য প্রদান করেন। মামলার অভিযোগপত্রে ৯২ জন সাক্ষীর নাম দিয়েছে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই। বহুল আলোচিত ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার ধার্য তারিখ রবিবার সকালে ফেনী কারাগার থেকে ১৫ জন আসামিকে আদালতে আনা হয়েছে। কামরুন নাহার মনি ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিধায় যুক্তিতর্ক চলাকালীন আদালতে হাজির থাকা থেকে অব্যাহতির আদেশ দেন আদালত। দুপুরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালের বিচারিক মোঃ মামুনুর রসিদের আদালতে আসামিদের হাজির করা হয়। গত ৬ এপ্রিল সকালে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত আলিমের আরবি পরীক্ষা প্রথমপত্র দিতে মাদ্রাসায় গেলে দুর্বৃত্তরা তাকে ডেকে কৌশলে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে যায়। পরে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় দগ্ধ নুসরাত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫ দিন পর গত ১০ এপ্রিল রাতে মারা যায়। পরদিন ১১ এপ্রিল বিকেলে সোনাগাজীতে তার নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলাকে প্রধান আসামিসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করে নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। পিবিআই ও পুলিশ এ মামলায় ২১ জনকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে হত্যায় সরাসরি জড়িত ৫ জনসহ ১২ জন আসামি আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। গত ২৯ মে দুপুরে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের আদালতে নুসরাত হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই ইন্সপেক্টর শাহআলম আদালতে ১৬ জন আসামির বিরুদ্ধে চার্জশীট জমা দেন। এ মামলায় আটক থাকা চার্জশীটের বাইরের ৫ জনকে বিচারিক আদালত মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন।
×