ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

অপারেশন কোটালিপাড়া থানা ॥ ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯

অপারেশন কোটালিপাড়া থানা ॥ ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল বুধবার। এইদিন পাকবাহিনী কোটালিপাড়া থানায় পুনরায় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও খাদ্যশস্য মজুদ করার খবর পাবার পর হেমায়েত বাহিনী আবার কোটালিপাড়া থানা আক্রমণ করেন। ১৪ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর থানা দখলে আসে। প্রচুর খাদ্যশস্য ও গোলাবারুদ হস্তগত হয়। অতঃপর হেমায়েত বাহিনী ৩ ডিসেম্বর শেষবারের মতো কোটালিপাড়া থানা দখল করেন। ১নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর ১০ জন যোদ্ধার একটি দল পরশুরামের আমজাদহাট এলাকায় পাকসেনাদের এ্যামবুশ করে। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে দু’ঘণ্টার ও বেশি সময় যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধা নায়েক নাদিরুজ্জামান সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে তার সতীর্থদের এ্যামবুশ অবস্থান ত্যাগ করতে সাহায্য করেন। এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ৮ জন সৈন্য হতাহত হয়। অপরপক্ষে মুক্তিবাহিনীর একজন বীরযোদ্ধা আহত হন। মুক্তিবাহিনীর লক্ষ্মীপুরের কাছে পাকসেনাদের দুটি বাঙ্কার অতর্কিত আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। মুক্তিবাহিনীর এই অভিযানে ৩ জন পাকসেনা নিহত ও ৮ জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনী লক্ষ্মীপুর থানায় পাক পুলিশ ও রাজাকারদের চন্দ্রগঞ্জ প্রতাপ হাই স্কুল ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে ৪০ জন পাকসেনা হতাহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধদের চাপের মুখে পাকবাহিনী তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ২নং সেক্টরের সাতানি, নারায়ণহাট, আবেদারহাট ও কাকডাঙ্গায় মুক্তিবাহিনীর তিন কোম্পানি যোদ্ধা পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ১০ জন পাকসৈন্য নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। অপরদিকে পাকসেনাদের শেলের আঘাতে দুইজন বেসামরিক লোক আহত হয়। ৮নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী কুরালগাছি ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসে অবস্থানরত পাকবাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে। এই আক্রমণে ৬ জন রাজাকার নিহত ও ২ জন আহত হয়। মুক্তিফৌজের একটি কোম্পানিকে সালদার শত্রুঘাটি রেইডিং করার জন্য পাঠানো হয়। সারাদিন রেকি করার পর রাত ৮.৩০ মিনিটে মুক্তিফৌজের কোম্পানিটি গোলন্দাজ বাহিনী এবং ৪ ইঞ্চি মর্টারের সহায়তায় পাকসেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় এবং প্রায় এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিফৌজের সৈন্যরা পাকসেনাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলো দখল করে নেয়। পাকসেনারাও তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে মুক্তিফৌজের অগ্রযাত্রায় বাঁধা দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিফৌজের সৈনিকরা ক্ষিপ্রতা ও বীরত্বের সঙ্গে পাকসেনাদের অবস্থানের ওপর তাদের হামলা অব্যাহত রাখে। পাকসেনাদের গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণের ফলে মুক্তিফৌজের অগ্রযাত্রায় কিছুটা বাঁধা আসে। কিন্তু তবুও মুক্তিফৌজের সৈনিকরা ডান দিক থেকে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে। সকাল পর্যন্ত সংঘর্ষে পাকসেনারা তাদের অবস্থান থেকে কিছুটা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিফৌজের সৈনিকরা এই অবস্থানের পেছনে অবস্থিত একটি পেট্রোল পাম্পও ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। এতে প্রায় ২০-২৫ জন সেনা হতাহত হয়। শালদার অবস্থান থেকে পাকসেনাদের বিতাড়িত করার পর মুক্তিফৌজ পরশুরামের নিকট অনন্তপুর গ্রামে পাকসেনাদের অবস্থানের ওপর চাপ বাড়িয়ে তুলে। এই অবস্থানে মুক্তিফৌজের গোলন্দাজ বাহিনী আক্রমণ চালায়। ফলে ১০ জন পাকসেনা নিহত এবং আরও বেশ কিছু আহত হয়। প্লাটুন কমান্ডার আইয়ূব আলী, দিলদার আহমেদ, হাফিজুর রহমান, মোঃ আবুল কাশেম যথাক্রমে কুমারঘাট, মুচারঘাট, বান্দিয়া ও নিমুরী এলাকায় দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা যাবত পাকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। ফলে ৫ জন রাজাকার নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। মোগলহাটে পাকবাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। এই ঘাঁটিতে প্রত্যেক দিন সকাল সন্ধ্যা পাকসেনারা একদলকে রেখে ডিউটিরত দলকে অন্যত্র নিয়ে যেত। ভোর রাতে দুরাকুটি নামক জায়গাতে মাইন ও বিস্ফোরক পদার্থ সহযোগে পাক সেনাবাহিনীর রেলগাড়ি উড়িয়ে দেয়া হয়। এতে লালমনিরহাট এবং মোগলহাটের মধ্যবর্তী রেললাইন ও ইঞ্জিনসহ বিধ্বস্ত হয়। এই অপারেশনে অন্ততপক্ষে ২৭ জন পাকসেনার মৃতু্যু ঘটে এবং ১০-১২ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। এই অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের একজন শহীদ এবং ৪ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সকাল ৮টায় পটিয়া থানার অন্তর্গত কালারপোল পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করে একজন পুলিশ ও ১ জন রাজাকার কে হত্যা করে। কমান্ডার ইন চিফ বাংলাদেশ বাহিনী কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী, পি এস সি. এম এন এ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ভাষণে বলেন, বাংলাদেশের জনগণ ধারাবাহিকভাবে উপনিবেশবাদের অনিষ্ট থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। কিন্তু এই উপনিবেশবাদ পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা আরও আঁকড়ে ধরে আছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ ৯৯% ভোট দেয় এবং ভোটের ৮০% বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগ পায়। আওয়ামী লীগ সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু ফলাফল সামরিক জান্তাকে অবাক করে। বাংলাদেশের জনগণ তারপর শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের আশ্রয় নেয়। আর্থ-সামাজিক সমস্যা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ক্রমাগত ঘনীভূত হতে থাকে। সঙ্গে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও ভবিষ্যত। তখন কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বিমান ও জাহাজে করে প্রচুর সৈন্য আসতে থাকে এবং ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা ত্যাগ করেন। মধ্যরাতের দিকে পাকিস্তানী বাহিনী যুদ্ধের দামামা বাজাতে শুরু করে। শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে মেশিনগান ও অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়। আমার নিজের ঘর মেশিনগানের ফায়ারে ভেঙ্গে দেয়া হয়। সৌভাগ্যক্রমে আমি পালাতে সক্ষম হই। তারপর তাদের বেলেল্লাপনা শুরু হল। সেই রাতে ঢাকা শহরে হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও শিশুদের হত্যা কর হয়। অঘোষিত গণহত্যা, আগ্রাসনের মধ্যে, সে রাতে যখন শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, মেধাবী ও প্রতিশ্রুতিশীল যুবক, শ্রমিক, দরিদ্র রুটি উপার্জনকারী, মায়ের কোলের শিশু, নিরস্ত্র বাঙালী অফিসার ও নিয়মিত বাহিনীর লোকদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হিন্দু নারীসহ অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের তারা ধর্ষণ ও হত্যা করে এবং নগ্ন করে হাঁটতে বলে। উপাসনালয় ধ্বংস, গ্রামীণ বসতবাড়িতে এবং ফসলে আগুণ এবং জেনেভা কনভেনশনের হিউম্যান রাইটস চার্টার এ সন্নিবেশিত সবকিছুকে অবজ্ঞা করে তারা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস ও জঘন্য গণহত্যা ও ধ্বংস পরিচালনা করে। শাসকদের লক্ষ্য ছিল বাঙালী নামের যে জাতিসত্তা বিরাজমান তাকে বিলুপ্ত করা, বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব পঙ্গু করে দেয়া ও লড়াইয়ের সামর্থ্য এবং বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনাকে নিছক অস্ত্রের মুখে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দেয়া। এই গণহত্যা ও নগ্ন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শান্তিকামী সাহসী বাঙালীরা জেগে ওঠে। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের এবং স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য আত্মত্যাগের অসামান্য উদাহরণ দিতে থাকে। বেসামরিক নাগরিক, চাকরিজীবী সবাই আমাদের মানবাধিকার আদায়ের লক্ষে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে যায়। ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে সাধারণ বাঙালী পুলিশের ওপর মাঝারি ট্যাঙ্ক দিয়ে আক্রমণ করা হয়। ভাগ্য বিপক্ষে থাকলেও তারা প্রায় ৪ ঘণ্টা ঘরে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন যে আমাদের সাহসী ছেলেরা যুদ্ধে সফলতার একটি রেকর্ড প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা নিজেদের চেয়ে সংখ্যা ও শক্তিতে বড় শত্রুসেনাদের সঙ্গে দৃঢ় প্রত্যয়ে ভয়ানক লড়াই চালিয়ে গেছে। তাদের ডেডিকেশন, লক্ষ্য ও সাহসের সঙ্গে লড়াই করে প্রচুর হতাহত হয়ছে-আজ পর্যন্ত যার সংখ্যা ২৫০০০ এরও বেশি। বাংলাদেশ ফোর্সে নিয়মিত বীর যোদ্ধাদের নিয়ে ‘মুক্তিবাহিনী’ এবং সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে গঠিত ‘গণবাহিনী’কে আমি আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। আমাদের শত্রুরা আমেরিকা ও চীন থেকে আধুনিক জেট বিমান, ভারি বন্দুক ও অত্যাধুনিক অস্ত্র পেয়েছে। কিন্তু আমাদের পাশে আছে আমাদের সততা ও ন্যায়পরায়ণতা। ভয়ানক সংকল্প ও বীরত্বের সঙ্গে, তারা যুদ্ধক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করছে। অনেকে শহীদ হয়েছে, অনেক আহত বা অক্ষম হয়েছে কিন্তু আপনারা শত্রুপক্ষে এর চেয়ে ৪০ গুণ বেশি হতাহত করেছেন। আমাদের লাখ লাখ মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। ভারতের নিজস্ব অর্থনৈতিক সমস্যা সত্ত্বেও, সরকার উদারভাবে তাদের গ্রহণ করেছে এবং সাময়িকভাবে তাদের দেখাশোনা করছে-এইজন্য আমি ভারতের সরকার ও জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশ এর জনগণ এখন যুদ্ধে লিপ্ত। এটি আমাদের একটি জাতীয় যুদ্ধ যাতে সমগ্র জাতি, রাজনৈতিক বিশ্বাসের, শ্রেণী, ধর্মবিশ্বাস-সব মিলে নির্বিশেষে একাত্ম হয়েছে। তাদের আদর্শ ইস্পাতের মতো শক্তিশালী। আমরা নৈতিকতা বর্জিত অধার্মিক শত্রুকে আমাদের বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করে যে কোন মূল্যে দেশ স্বাধীন করব। আমাদের প্রিয় ও মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি, সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা প্রত্যাহার-এর সঙ্গে কোন আপোস করা হবে না। তাই আপনারা যেখানেই থাকুন না কেন-নদী, হ্রদ, ক্ষেত, এবং দুর্গম গ্রাম, নদীমাতৃক জনপথ, সড়ক রুট, গ্রামীণ বাজার, শিল্পকেন্দ্র, শহর ও উপশহর-শত্রুদের ওপর কঠোর আঘাত করুন। যা আছে তাই দিয়ে তাদের ধ্বংস করুন। প্রিয় দেশবাসী আপনারা এগিয়ে আসুন। আমাদের দেশের নারী পুরুষ-প্রত্যেকের জীবন ও আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের নিরাপত্তা-সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এগিয়ে আসুন। জয় বাংলা। তেহরানে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও ইরানের শাহ রেজা পাহলভির মধ্যে পাক-ভারত পরিস্থিতি নিয়ে দুদিনব্যাপী আলোচনা শেষে যুক্ত ইস্তেহার প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ইরানের শাহ পাকিস্তানের সঙ্গে তার একাত্মতা প্রকাশ করছে। রয়টার পরিবেশিত খবরে বলা হয়,জাতিসংঘের পাকিস্তানের দূত আগাশাহী জাতিসংঘের বিশেষ কমিটির বৈঠকে বিশ্বশান্তি পরিষদের ভারতীয় প্রতিনিধি কৃষ্ণ মেননের দাবিকে ধৃষ্টতা হিসেবে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘মেনন শুধুমাত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে মুক্তি সংগ্রাম বলে চালানোর অপচেষ্টাই করছে না, জাতিসংঘের সনদের মূলনীতির বিরোধী কাজ করছে।’ নুরুল আমীনের বাসায় পিডিপি-র কার্যকরী কমিটির ১৮ জন সদস্যের উপস্থিতিতে নুরুল আমীনের সভাপতিত্বে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় মাহমুদ আলীকে পিডিপি পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×