ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দলের ব্যর্থতার মাঝে উজ্জ্বল সাকিব

প্রকাশিত: ১০:১৫, ৭ জুলাই ২০১৯

 দলের ব্যর্থতার মাঝে  উজ্জ্বল সাকিব

মিথুন আশরাফ ॥ ক্যারিয়ারে মুদ্রার এপিঠ দেখেছেন। ওপিঠটাও এবার বিশ্বকাপে দেখে ফেললেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। হতে পারত শেষ বিশ্বকাপটা রাঙানো। কিন্তু সমালোচনায় ভরে গেল। তা হয়েছে ব্যর্থতার জন্যই। তিনি যে বল হাতে ছিলেন ফিকে। তাই দলের জন্য এতসব কিছু করেও সমালোচনা থেকে মুক্ত হতে পারেননি মাশরাফি। তবে বিশ্বসেরা ওয়ানডে অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান সেই সবের মধ্যে নেই। শেষ পর্যন্ত দলের অবস্থা যতই ব্যর্থতায় ভরে থাকুক, ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে আকাশে উড়ছেন সাকিব। উজ্জ্বল নৈপুণ্য করে দেখিয়েছেন। রেকর্ডের পাতায় নিজের নামটি জ্বালিয়ে রেখেছেন। ব্যর্থতা সঙ্গী করে আজ বাংলাদেশ দল বিকেলে ফিরছে দেশে। এই ব্যর্থতার মাঝেও বিশ্বকাপে সেরা নৈপুণ্য দেখিয়ে ফিরছেন সাকিব। শুধু মাশরাফিই নয়, এ বিশ্বকাপে সবচেয়ে হতাশ করেছেন তামিম ইকবালও। চার বিশ্বকাপ খেলা অভিজ্ঞ পেসার মাশরাফি যেখানে বল হাতে ৮ ম্যাচ খেলে ৫৬ ওভারে ৩৬১ রান দিয়ে ১ উইকেট নিতে পেরেছেন। বল হাতে ব্যর্থতার ষোলোকলা পূর্ণ করেছেন। চার বিশ্বকাপ খেলা তামিম ব্যাট হাতে ছিলেন নীরব। দলের সেরা ওপেনার তিনি। অথচ ৮ ম্যাচে ৩২.৮৫ গড়ে ২৩০ রানের বেশি করতে পারেননি। একটি হাফ সেঞ্চুরি ছাড়া বলার মতো আর কোন ইনিংসই নেই। তাকে বলা হয়, ‘বিগ রোল প্লে করা ওপেনার’। কোন ভূমিকাই তিনি এবার বিশ্বকাপে নিতে পারেননি। বারবার সেট হয়ে আউট হয়ে গেছেন। যদি তামিম এবার শুরুটা দুর্দান্ত করে দিতে পারতেন তাহলে বাংলাদেশ শুধু তিন ম্যাচ নয়, আরও বেশি ম্যাচ জিততে পারতো। দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয় মিলেছে। কিন্তু নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে হার হয়েছে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটি বৃষ্টিতে হয়েছে পরিত্যক্ত। পাকিস্তানের বিপক্ষে হার দিয়ে বিশ্বকাপও শেষ হয়েছে বাংলাদেশের। সেমিফাইনালে খেলার আশা ছিল। সেখানে বাজে দলগুলোর মধ্যেই অবস্থান হয় বাংলাদেশের। তাতে ব্যর্থতাও যোগ হয়। সেই ব্যর্থতা থেকে বের হওয়া যেত। বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো চার জয় নিয়ে মাঠও ছাড়া যেত যদি ব্যাট হাতে ইনিংসের শুরুটা তামিমের হাত ধরে অসাধারণভাবে হতো। কিন্তু তা হয়নি। আর তাই বাংলাদেশও সাফল্যে শেষ পর্যন্ত আর ভাসতে পারেনি। সেই তুলনায় বল হাতে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলা মুস্তাফিজ আলো ছড়িয়েছেন। তিনি এবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮ ম্যাচ খেলে ৭২.১ ওভার বোলিং করে ৪৮৪ রান দিয়েছেন। বেশি রান দেয়ার তালিকায় উঁচুতে মুস্তাফিজ। বাজে বোলিং। তাতে সমালোচনা আরও বেশি হতে পারতো। কিন্তু উইকেট যে ২০টি নিয়েছেন। শেষ দুটি ম্যাচেই নিজের দিকে খানিক আলো নিতে পেরেছেন মুস্তাফিজ। দেশের দ্রুততম ১০০ উইকেট শিকার করেছেন। বিশ্বকাপের সেরা বোলার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানটিও দখল করে নিয়েছেন। তাতে প্রশংসা পাচ্ছেন। শেষ দুই ম্যাচে ৫ উইকেট করে শিকার করে এত রান দেয়ার হিসেব থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন মুস্তাফিজ। উজ্জ্বল নৈপুণ্যের তালিকাতেই তিনি থাকছেন। অবশ্য ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে সাকিবের উর্ধে কেউই যেতে পারেননি। অলরাউন্ড নৈপুণ্যে সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন সাকিব। তার ওপর যেন আধ্যাত্মিক কিছু এবার বিশ্বকাপে ভর করে বসেছিল। বল হাতে ১১ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে যা করে দেখিয়েছেন তা যেন সাকিবের পক্ষেই সম্ভব ছিল। ব্যাট হাতে ৮ ম্যাচে ৮৬.৫৭ গড়ে ৬০৬ রান করে দেখিয়েছেন সাকিব। বিশ্বকাপের এক আসরে যা বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যান করে দেখাতে পারেননি। এবার বিশ্বকাপে সাকিবই প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৬০০ রান করতে পেরেছেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটি শেষে এক নম্বরেও থাকেন সাকিবই। বিশ্বকাপে ১০ উইকেট ও ৪০০ রান করার কৃতিত্বওতো একমাত্র সাকিবেরই আছে। কী দারুণ অলরাউন্ড নৈপুণ্য করে দেখান সাকিব। দুটি সেঞ্চুরির সঙ্গে ৫টি হাফ সেঞ্চুরি আছে সাকিবের। ৮ ম্যাচের মধ্যে ৭টি ম্যাচেই পঞ্চাশ উর্ধ ইনিংস করে দেখিয়েছেন তিনি। বিশ্বকাপের এক আসরে ২০০৩ সালে ভারতের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকরই ৭টি পঞ্চাশ উর্ধ ইনিংস খেলতে পেরেছিলেন। এবার সাকিব তিন ম্যাচ কম খেলে তা করে দেখালেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬৪ রান করেন। আর ৬৭ রান যদি করতে পারতেন তাহলে টেন্ডুলকর যে এক আসরে সর্বোচ্চ ৬৭৩ রান করেছিলেন তা স্পর্শ করে ফেলতেন সাকিব। এরপরও গ্রেট সব ক্রিকেটারদের তালিকায় থেকেছেন সাকিব। রেকর্ডের পাতা ওলট-পালট করে দেন সাকিব। এক সাকিবই খেলে গেছেন। কিন্তু সেমিফাইনাল আর খেলতে পারলেন না। আকাশচুম্বী সাফল্য পেয়েছেন। কিন্তু যোগ্য সঙ্গীর অভাবে শেষ চারে না খেলেই দেশে ফিরতে হচ্ছে। যেখানে সাফল্য ভাগ্যে জুটতো সেখানে দল ব্যর্থতায় পড়ে থাকল। আর তাই অধিনায়ক মাশরাফির আফসোসের শেষ নেই। সাকিব এত ভাল খেলার পরও যে সেমিফাইনালে দল খেলল না তা নিয়েই আফসোস করেছেন মাশরাফি। দলের ব্যর্থতা নিয়ে হতাশার সঙ্গে সাকিবকে নিয়ে আফসোস ঝরেছে মাশরাফির কণ্ঠে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা সন্তুষ্ট নই। বিশ্বকাপটা আরও ভালভাবে শেষ করতে পারতাম। দিনশেষে আমাদের বিশ্বকাপকে ৫০-৫০ বলতে হবে। আমরা নিজেদের শতভাগ দিয়েছি কিন্তু মাঝে মধ্যে ভাগ্যটাও দরকার হয়। ভাগ্য এ টুর্নামেন্টে আমাদের পাশে ছিল না। আমাদের ব্যাটিং ভাল হয়েছে। কিন্তু ফিল্ডিংটা ভাল হয়নি। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে বাজে ফিল্ডিংয়ের খেসারত দিতে হয়েছে আমাদের।’ সাকিবকে নিয়ে মাশরাফি বলেন, ‘শেষ দুই ম্যাচে সাকিব এত ভাল ব্যাটিং করেছে কিন্তু আমরা জুটি দাঁড় করাতে পারিনি। দুটো ম্যাচই ৫০-৫০ ছিল, ভেবেছিলাম আমরা তাড়া করতে পারব। কিন্তু কোন জুটিই গড়তে পারিনি আমরা। সাকিবের জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে আমার। আমরা বাকি যারা আছি তারাও যদি এগিয়ে আসতে পারতাম তাহলে হয়তো চিত্রটা ভিন্ন রকম হতো। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে সাকিব অসাধারণ ছিল। বোলিং, ফিল্ডিং, ব্যাটিং সব বিভাগেই সাকিব ছিল অসাধারণ।’ এক সাকিবের সঙ্গে মুস্তাফিজ শেষদিকে ঝলক দেখিয়েছেন। বাকিরা নিয়মিত নৈপুণ্য দেখাতে পারেননি। আর তাই ব্যর্থতার ছোঁয়াই লেগেছে। লিটন কুমার দাসকে ড্যাশিং ব্যাটসম্যান বলা হয়। একাদশে সুযোগ পেয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচে অপরাজিত ৯৪ রান করেন। এরপর নিজেকে হারিয়ে খুঁজেন। সৌম্য সরকারও একই। তার এগিয়ে থাকা একটি জায়গাতে, বোলিং করতে পারেন। কিন্তু তার কাছ থেকে আগে ব্যাটিংটাই চাওয়া হয়। সর্বোচ্চ হতাশ করেছেন সৌম্য। মুশফিকুর রহীম মিডলঅর্ডারে দলের ভরসা। তিনি ভরসার প্রতিদানও দিয়েছেন। একটি ম্যাচে সেঞ্চুরি ও দুটি ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করেছেন। বিশ্বকাপে নিজেদের শুরুতেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৮ রানের ইনিংস খেলে দলকে জেতান। মোহাম্মদ মিঠুন হচ্ছেন স্ট্রাইক রেটেড করে উইকেটে সেট হতে পারেন এবং বড় রান করার সামর্থ্য রাখেন। এমনই ব্যর্থ হন পরে একাদশেই আর দেখা যায়নি। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে ক্রাইসিস ম্যান বলা হয়ে থাকে। ক্রাইসিস মুহূর্তে সেরা পারফর্মার। এবার খুব সংখ্যক ম্যাচেই তার থেকে নৈপুণ্য দেখা গেছে। সাব্বির রহমান রুম্মন ছিলেন এবার বিশ্বকাপের এক্স ফ্যাক্টর। ২৮০ হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩১০ রানে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য আছে তার। সেই সামর্থ্য দেখাতে পারেননি সাব্বির। মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে দলকে জেতান। শিরোপা জেতায় বিশেষ অবদান রাখেন। বিশ্বকাপে সেই ঝলক মিলল কোথায়? মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন হচ্ছেন ভবিষ্যতে ১০-১২ বছরের জন্য বাংলাদেশের সেরা সম্পদ। তিনি ঝলকও দেখান। বল হাতে ডেথ ওভারে কার্যকরও হয়েছেন। উইকেটও নিয়মিত পেয়েছেন। ব্যাট হাতে একটি ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরিও করেছেন। কিন্তু ১৩ উইকেট নেয়ার সঙ্গে রান দিয়েছেন সবমিলিয়ে ৭ ম্যাচে ৫৮ ওভার বোলিং করে ৪১৭। এবার বিশ্বকাপে মুস্তাফিজের পর যা সর্বোচ্চ রান দেয়া বোলার হয়েছেন। তাতেই ব্যর্থতা সামনে চলে আসে। মেহেদী হাসান মিরাজ নাকি মূল্যবান খেলোয়াড়। ৭ ম্যাচে ৬ উইকেটের বেশি নিতে পারেননি। আবু জায়েদ রাহী হচ্ছেন বল করার আগে বলতে পারেন ইনসুইং না আউটসুইং করাচ্ছেন। এমন বোলার এক ম্যাচেও একাদশে সুযোগ পাননি। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ কাঁপিয়ে দেয়া রুবেল হোসেন ক্রুশিয়াল মমেন্টে ব্রেক থ্রু দেন। তিনি দুই ম্যাচে সুযোগ পেয়ে ব্যর্থতার বোঝা বাড়িয়েছেন। হিসেবে দেখা যাচ্ছে, সাকিবতো বিশ্বকাপটাই রাঙিয়েছেন। তার সঙ্গে মুস্তাফিজ ও মুশফিকই নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছেন। এত বড় টুর্নামেন্টে যদি মাত্র তিনজন নৈপুণ্য দেখান, তাও সাকিব ছাড়া কেউ নিয়মিত নৈপুণ্য দেখান না, তাহলে সেই দল কী আর বহুদূর যেতে পারে? তাই বাংলাদেশ তিন ম্যাচের বেশি জিততেও পারেনি। আগের বিশ্বকাপগুলোতেও সর্বোচ্চ ৩ ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ। এবার ইতিহাসের সেরা দল নিয়েও সমান সংখ্যক জয় মিলেছে। সেমিফাইনালে ওঠা কোন দলকেই হারানো যায়নি। যাদের হারানো গেছে তারা বাংলাদেশের আগেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে। আর তাই ব্যর্থতাও মিলেছে। সেই ব্যর্থতার ছোঁয়া যেন মাশরাফি ও তামিমের গায়েই বেশি করে লেগেছে। তাদের দুইজন এমনই ব্যর্থ হয়েছেন সমালোচনাতেও বিদ্ধ হচ্ছেন। মাশরাফি ও তামিমের মতো ক্রিকেটার যারা দলকে সর্বোচ্চটা দিয়েছেন, তারা যখন সমালোচনার মধ্যে পড়েন তখন বুঝতে হবে দল কতটা ব্যর্থ হয়েছে। দলের সেই ব্যর্থতার মাঝে উজ্জ্বল শুধু একজনই। তিনি সাকিব আল হাসান।
×