ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শফিক হাসান

একাব্বর মুন্সীর ঢাকা দর্শন

প্রকাশিত: ১১:৪৭, ৩১ মে ২০১৯

 একাব্বর মুন্সীর ঢাকা দর্শন

একাব্বর মুন্সী সহজ কথার দুই রকম অর্থ করেন অধিকাংশ সময়েই। সহজ কথাটিই তার কাছে এসে কঠিন হয়ে যায়! গ্রামে লাকড়ি পোড়া ছাই আর কে কেনে! অমূল্য রতন সন্ধানী মানুষের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। নতুন করে গ্যাসের চুলা ব্যবহার শুরুর পর ছাইয়ের দরকার পড়লো একাব্বর-পত্নীর। নিকট প্রতিবেশীর সাথে ছাগলে গাছ খাওয়া নিয়ে ঝগড়া হয়েছে দু’দিন আগে। এ সময়ে তার কাছে মামুলি ছাইয়ের জন্য হাত পাতাটাও ঠিক হবে না! দূরের প্রতিবেশীদের কাছে চাইতে মন সায় দিলো না তার। গ্রাম এবং শহরের খুব কম দোকানেই ছাই বিক্রি হয়। কথায় কথায় সোনার সাথে ছাইয়ের নাম উচ্চারিত হলেও বাস্তবে এর তেমন উপযোগিতা নেই। সব বাস্তবতা জেনেও একাব্বর মুন্সী এলাকার দোকানে গিয়ে বললেন, ‘ছাই আছে?’ ঘাঘু দোকানী হলদে দাঁত বের করে বললেন, ‘দাঁত মাজার খাঁটি নিমের ছাই?’ ‘না। মাছ-মাংস কাটার ছাই!’ অবাধ্য ও পিছলা মাছ কুটতে ছাইয়ের প্রয়োজন আছে বৈ কি, তাই বলে মাংসের ক্ষেত্রেও...! খদ্দের হচ্ছে লক্ষ্মী। দোকানীরা পারতপক্ষে খদ্দেরকে নিরাশ করতে চায় না। বিকল্প জিনিসটা ধরিয়ে দেয়। মাছ-মাংসের বিতর্কে না গিয়ে বুদ্ধি করে দোকানী বললেন, ‘মাংস কাটার ছাই তো নেই। আপনি নিমের মেসওয়াক নিয়ে যান।’ বিরক্ত হলেন একাব্বর মুন্সী- ‘ডালপালা দিয়ে কী করবো!’ ‘ডালপালা নয়, শুধু ডাল। মনে করেন- এটা দিয়ে আপনি সুন্দরভাবে ক’দিন দাঁত মাজলেন। দাঁত পরিষ্কার হয়ে গেলে ডালটা পুড়িয়ে ছাই বানালেন। সেই ছাই দিয়ে মাছ-মাংস রান্না করা হলো, এদিকে বোনাস হিসেবে দাঁতও পরিষ্কার হলো!’ বুদ্ধিটা পছন্দ হলো একাব্বর মুন্সীর। ভালো পরামর্শ দেওয়ার মানুষও তাহলে এখনো আছে! দোকান থেকে তিনি ২০ টাকায় দুইটা নিমের ডাল কিনে এলেন বাড়িতে। ছাইয়ের শক্ত চেহারা দেখে (কোলেস্টেরল ও আয়োডিনমুক্ত) তেলে-নুনে জ্বলে উঠলেন বাসন্তী বেগম। নিমডাল দুটি ছুঁড়ে মারলেন একাব্বরের মুখ বরাবর- ‘এমন বেকুব মানুষ দিয়ে কিভাবে সংসার চালাবো আমি!’ একাব্বর নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রসঙ্গ তোলার চেষ্টা করলে হিতে বিপরীত ফল দেয়। ‘কাঠ পোড়ালেই কয়লা হয়, কয়লা গুঁড়া করলে ছাই...।’ এমন যুক্তিতে মুখ ঝামটে ওঠেন বাসন্তী বউ- ‘তুমি থাকো কাঠকয়লা নিয়ে, আমি চললাম বাপের বাড়ি!’ লহমায় বাঁধা-ছাঁদা শেষ! যে মাছ কুটতে প্রয়োজন হয়েছিলো ছাইয়ের, মাছ সব দিয়ে দিলেন প্রতিবেশী বাড়ির বেড়ালকে। প্রতিবেশীকেই দিতে পারতেন কিন্তু তুমুল ঝগড়ার পর এতটা উদারতা দেখানো মানায় না। বেড়াল মাছ সাবাড় করতে করতেই বাসন্তী বেগমের গোছগাছ শেষ। যথারীতি এবারও একাব্বর বউয়ের সঙ্গী হলেন। বউ যতই তাকে রেখে যেতে চান- একাব্বরের এক যুক্তি, একা থাকার চেয়ে ঘরজামাই থাকা বুদ্ধিমানের কাজ! শেষ পর্যন্ত বাসন্তী বউ বরের শ্বশুরালয় গমনের বিষয়টি মানতে বাধ্য হলেন। মেজাজ ঠান্ডা হলে বললেন, ‘রিকশা-ভ্যান কিছুই তো দেখছি না। যাবো কিভাবে?’ উত্তর রেডিই ছিলো একাব্বরের মুখে- ‘আগে বাড়ো। বাস-ট্রাক কিছু একটা পাবোই!’ ‘ট্রাকে তোমার চোদ্দগোষ্ঠীর লাশ নিবা নাকি...’ বাক্য শেষ করলেন না বাসন্তী। রাস্তাঘাটে ঝগড়া করলে লোকে খারাপ বলবে। অবশেষে কাঠফাটা গরমে এক লিটার ঘাম ঝরার পর পাওয়া গেলো একটা রিকশা। সেই রিকশার ভাড়া ঠিক করা নিয়ে ঝরলো আরো ছটাক খানেক লবণাক্ত ঘাম। শ্বশুরবাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ি থেকে নামার পর একাব্বর মুন্সী স্ত্রীকে বললেন, ‘তুমি যাও, আমি চা পান খেয়ে আসছি।’ গাঁটরি বোচকার ভার সামলে বাসন্তী বেগম দাঁত খিঁচালেন- ‘আমার মাথাডা খাইবা না?’ ‘সেটা পরে খাবো। আপাতত টং দোকানে গিয়ে চা পান খাই।’ শ্বশুরালয়ের সরু পথের মুখেই একটা টং দোকান। গ্রামের অলস-বেকার লোকজন, কর্মবিরতি দেওয়া কৃষকরা চা বিড়ি খেতে খেতে গুলতানি ঝাড়ে। দোকানদার ও নিয়মিত খদ্দেররা একাব্বরকে চেনে বেকুব জামাই হিসেবে। তিনি দোকানে ঢুকেই বললেন, ‘একটা করে চা পান দেন দেখি।’ দোকানদার প্রথমে নিজামপুরী জর্দা দিয়ে পান বানালেন, তারপর কড়া লিকারের গরম চা। দুটাই একত্রে বাড়িয়ে দিলেন একাব্বর মুন্সীর দিকে। তা দেখে ঠাট্টার সম্পর্কের এক শালা বললো, ‘দুলাভাই, দুটাই একত্রে খাবেন নাকি?’ একাব্বর বললেন, ‘তৃষ্ণা পেয়েছে। পান-ই আগে খাই। তারপর চা। পান মুচড়ে গন্ধ শুঁকে মুখে পুরলেন তিনি। চিবুতে চিবুতেই চুমুক দিলেন চায়ে। পানের রসের সাথে চায়ের স্বাদ মিশে মুখ পেলো নতুন স্বাদের খাদ্য। একাব্বর মুন্সী মজা পেলেও ছেলে-বুড়োরা হাসি গোপন করলেন। এদেরই একজন কূটবুদ্ধির বালক চটজলদি খবর পৌঁছে দিলো শ্বশুরবাড়িতে- জামাই দোকানে বসে চা ও পান খাচ্ছে একত্রে। মিয়া বাড়ির মানসম্মান বুঝি আর থাকলো না! দুলাভাইয়ের এমন কান্ড-কারখানায় আগে থেকেই চেতে ছিলো কইতরী বানু। একমাত্র শ্যালিকা বলে কথা। একাব্বর মুন্সী বাড়ি পৌঁছালে বিশেষ কায়দায় অভ্যর্থনা জানালো কইতরী। গাধা-বাঁধা একটি দড়ি ধরিয়ে দিলো হাতে- ‘নেন, আজ থেকে আপনি এটা চরাবেন!’ ‘গরু চরাবো কেন, আমি কি রাখাল?’ ‘গরু পাইলেন কই, এটা তো গাধা। আপনার বিরহ সইতে না পেরে অনেক কষ্টে এটাকে কিনেছি। দু’পেয়ে গাধা লাখ লাখ থাকলেও চা পেয়ে গাধার সংখ্যা কম। তাই দামও বেশি!’ গাধাকে গাধা হিসেবে মানতে নারাজ একাব্বর। তার এক কথা- গাধা দেখা যায় সিনেমায়। সেই গাধা পর্দা ফুঁড়ে বাইরে আসবে কিভাবে! ছোট মেয়ের গাধা-কান্ডে এমনিতেই বিরক্ত ছিলেন একাব্বরের শ্বশুর। নতুন করে গাধা-গরু বিতর্কে মেজাজ সপ্তমে চড়লো তার। বড় মেয়েকে ডেকে বললেন- ‘গাধাটাকে কোনো দোকানপাটে চাকরি দিয়ে দিই?’ বাসন্তী বেগম বাবার সাথে দ্বিমত পোষণ করে বললেন, ‘তোমার গাধা জামাইয়ের সেই যোগ্যতা কি আছে? দেখা যাবে দোকানে এসে কেউ মরিচ চাইলো আর তাকে হারপিক দিয়ে বসে আছে!’ ‘তবু চেষ্টা করতে তো দোষ নেই। কত আর সহ্য করবো?’ বাসন্তীর বড় এক ভাই ঢাকার উত্তরায় টাইলসের ব্যবসা করেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো- আপাতত তার কাছেই থাকবেন একাব্বর মুন্সী। সেখানে থেকে ‘চালাক’ হওয়ার পর অন্য চিন্তা করা যাবে। পরদিনই তাকে তুলে দেওয়া হলো ঢাকাগামী বাসে। নিমরাজি একাব্বর একটি ঝোলা সাথে নিয়ে চললেন নতুন দেশ আবিষ্কারের বাসনায়। ডিসট্রিক্ট বাস থেকে নামার পর লোকাল বাসের কনডাকটররা ছেঁকে ধরলো তাকে। যাত্রী হিসেবে সবাই-ই তুলে ফেলতে চায় যার যার বাসে। একাব্বর মুন্সী জানালেন তার গন্তব্য গুলিস্তান-উত্তরা। দ্বন্দ্বে পড়লো সব রুটের কনডাকটররা। সে সময়ে উপস্থিত একজন পুলিশ সদস্য বিষয়টির সুরাহা করতে চাইলেন। তাকে কটাক্ষ করে একাব্বর বললেন, ‘কোনো পুলিশ-টুলিশের সাহায্য চাইনি তো!’ এমন ধারা কথায় ক্ষেপে গেলেন পুলিশ সদস্য- ‘পুলিশ না হয় বুঝলাম, টুলিশ কী!’ ‘আম-জামের মতো আর কী!’ একাব্বরের ত্বরিত উত্তর। সেই পুলিশ তার ক্ষমতায় সর্বোচ্চ প্রয়োগ দেখালেন। কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখলেন একাব্বরকে। সবশেষে তাকে ছেড়েও দিলেন। সব টাকা রেখে দিয়ে দয়া পরবশ হয়ে ভাড়ার টাকাটাই দিলেন। পরক্ষণে বুদ্ধি খুললো তার। সেই টাকাও ফেরত নিয়ে একাব্বরকে তুলে দিলেন টঙ্গীর বাসে। কনডাকটরকে বলে দিলেন, ‘আমার নিজস্ব লোক। ভাড়া চাস না।’ উত্তরার ঠিকানা খুঁজে বের করতে তাকে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সবদিকেই চক্কর কাটতে হলো। একাব্বর মুন্সী ভেবে পেলেন না, উত্তরায় যেতে এত প্যাঁচ থাকবে কেন! যাদের কাছ থেকে ঠিকানার সন্ধান করেছেন এদের অনেকেই কোট-টাই-সু পরিহিত। একাব্বর কয়েকজনকে মুখ ফুটে বললেনও- ‘এই গরমে এসব কেন পরেন! ঘাম দিয়েই তো গোসল সেরে ফেললেন!’ তারা ফাজিল বলে তিরস্কার করলো। একাব্বর মুন্সী আজব এ শহরের মাথামুন্ডু বুঝলেন না। চান্দিফাটা গরমে অন্যরা কোট-প্যান্ট পরে কষ্ট করলেও তিনি খুলে ফেললেন পরনের একমাত্র শার্টটি! দিগম্বর অবস্থায় খুঁজে পেলেন সম্বন্ধীকে। সম্বন্ধী এমন অবস্থা দেখে বিরক্ত হলেন। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে একাব্বর প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা মিয়া ভাই, উত্তরা তো এলাম; দক্ষিণা, পূর্বা ও পশ্চিমা কোন দিকে?’ সম্বন্ধী যতই বোঝাতে চান একাব্বর বুঝতে নারাজ। তিনি পাল্টা যুক্তি দেখান- উত্তর থাকলে দক্ষিণ থাকবেই! আর দক্ষিণ থাকলে পূর্ব-পশ্চিম যাবে কই! বলাবাহুল্য, একাব্বর মুন্সীর ঢাকাবাস তেমন সুখকর হয়নি। ঢাকা দর্শনে তার অসংখ্য প্রশ্ন জাগলো, সদুত্তর পেলেন না একটিরও!
×