ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভোজনানন্দ ও এশার ঈদ

প্রকাশিত: ১১:২৩, ৩১ মে ২০১৯

ভোজনানন্দ ও এশার ঈদ

ভোজনানন্দ শব্দটি দেখে কেউ ভুল করেও যেন ভাববেন না যে এটি কোন ব্যক্তির নাম। কেউ যদি মনে করেন যে ভোজনানন্দ হয়ত কবি জীবনানন্দ বা স্বামী বিবেকানন্দের কোন ঘনিষ্ঠজন তাও মহা ভুল। তবে সবার মাঝেই এই অনুভূতি কমবেশি আছে বা সময় বিশেষে ভোজনানন্দ হয়। ভুখা মানুষ যখন সামান্য নুনভাতও কাঁচামরিচ দিয়ে খেতে পায় তখন তার আত্মা দুলে উঠে ভোজনানন্দে, চেহারায় ধরা দেয় স্বর্গীয় তৃপ্তি। এই আনন্দ পেটুকের রসনাতৃপ্তির আনন্দ নয়, এ এক অন্যরকম আনন্দ। সারাদিনের রোজার শেষে রোজাদার ব্যক্তি যখন শীতল পানি বা মিষ্টি শরবত সহযোগে পরিমিতইফতার গ্রহণ করেন তার অন্তর তখন ভরে উঠে অনির্বচনীয় সুখে ও উপবাসক্লিষ্ট ক্লান্ত চেহারায় তার আভা ছড়ায় বেহেশতি প্রশান্তি। এশা ভুখাদরিদ্রও না, রোজাদারও নয়। খাদ্যানন্দ যে মানুষকে স্বর্গীয় তৃপ্তি দেয় বা ভোজনানন্দ বেহেশতি প্রশান্তি আনে এমন অনুভূতির সঙ্গে তার পরিচয়ই ঘটেনি। খাদ্যের অভাব কাকে বলে এটা এশা জানে না। সময়ের খাবার সময়ে গ্রহণ করার সুযোগ আছে বলে ক্ষুধিত হওয়ার সুযোগই ঘটেনি কখনও। তবে বিদেশে আসার পর ভোজনানন্দ বা খাদ্যানন্দে বিভোর লোকজনদেখে সে বিসি¥ত হয়েছে, তার উপর খাদ্যাসক্তি থেকে কেউ কেউ এমন বিশাল অবয়ব ধারণ করেছে যে তাদের দেখে রীতিমতো ভীত এশা। যে কোন অনুষ্ঠানে বা দাওয়াতে থাকে খানাপিনার বিশাল আয়োজন। খাবার দেখে ভিমড়ি খাওয়ার জোগার প্রায়। কোন তরিকা অনুসৃত হয় না খাদ্যসম্ভার উপস্থাপনে। বিরিয়ানি থেকে শুঁটকি সব পদের সমাহার থাকে। কাবাব, রোস্ট, কালিয়ার পাশাপাশি মাছের দোপেঁয়াজা, আস্ত গ্রিল্ড্ ফিশ এবং শাক-শুঁটকি, ভর্তা-ভাজি কোনটাই বাদ যায় না।। খাবারের প্রাচুর্যের মতোই পরিবেশও থাকে মানুষে মানুষে জনাকীর্ণ। একবার খাদ্যসম্ভারের পাশে যেতে পারলে ভোজনবিলাসী যারা তারা সবকিছু একপাতেই নিতে চেষ্টা করেন। এশাকে একবার দাওয়াতে একজন কাবাব কালিয়ার সঙ্গে শুঁটকিভুনাও তুলে দিতে যাচ্ছিলেন সে আঁতকে উঠে প্লেট সরিয়ে নিলে উনি বললেন, ‘সবাই নিয়েছে মনে হচ্ছে শুঁটকি মজা হয়েছে, নিয়ে নিন’ এশা নম্র কণ্ঠে বলেছিল ‘মাংশের সঙ্গে না, এগুলোই শেষ করতে পারব কিনা জানি না, যদি পারি পরে এসে নেব’ উনি ভিড়ের দিকে ইঙ্গিত করে নিচু স্বরে বললেন ‘মনে হয় না খাবার টেবিলের কাছে দ্বিতীয়বার আসতে পারবেন!’ তখন এশার একটা বিষয় বোধগম্য হলো যে কেন মানুষ দাওয়াতে গেলে প্রথামত ও রুচিমতো ভাতমাছ ও শাকসবজি-শুঁটকি নেবার পর পোলাও-কোর্মা ও কালিয়া-কাবাব পাতে নিতে পারে না। যারা ভোজনাসক্ত নন তারা চোখের লোভে সব ধরনের খাবার একপাতে নেন না। ভোজনরসিকরা খাদ্যানন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় সবই একসঙ্গে নিয়ে উপভোগ করেন। এশা মনে মনে ভাবে যারা পছন্দমতো দু’এক পদ দিয়ে খেয়েছে তারা তৃপ্ত বেশি নাকি যারা বিরিয়ানি থেকে ভর্তা সবই গোগ্রাসে উদরস্থ করেছে তারা বেশি তৃপ্ত? সুখ, তৃিপ্ত, খাদ্যানন্দ সবই আইনস্টাইনের থিওরির মোতাবেকই আপেক্ষিক। এশা বাংলাদেশের এমন এক অঞ্চল থেকে এসেছে যেখানে মাছের প্রাচুর্য রয়েছে তাই শুঁটকির কোন প্রয়োজনই হয় না। মাছ শুকিয়ে শুঁটকি বানিয়ে খাওয়ার রেওয়াজ ওদের এলাকায় নেই। বিদেশে এসে অবাক হয়ে দেখলো অনেক জাতির মানুষই শুঁটকি খায় এবং তাদের শুঁটকিরও গন্ধ রয়েছে। এক বন্ধুর কাছে একদিন বলেছিল ‘জান আমার ধারনাই ছিল না যে বিদেশীরাও শুঁটকি খায় এবং তাদের শুঁটকিতেও গন্ধ আছে!’ বন্ধু বলেছিল ‘আরে শুঁটকিতে গন্ধ থাকবেই স্বদেশী-বিদেশী বলে কোন কথা নেই। শুঁটকির উপকারিতা আছে জানতো?’ ‘এমন অদ্ভুত গন্ধওয়ালা বস্তু উপকারী! তা কি উপকার হয় শুনি?’ ‘আমাদের দেশে মানুষ প্রচুর শুঁটকি খায় জানতো, রোদে শুকানো জিনিসের খাদ্যগুণ বেড়ে যায় তা শুনেছো নিশ্চয়? এই কারনে আমাদের লোকজনের হাড় মজবুত, গ্রামেও হাত-পা ভাঙ্গা বয়স্ক মানুষ কম দেখা যায়।’ এশা কথাটা বিশ^াস করবে কিনা ভাবছিল। সে দ্বিধানি¦ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো ‘আচ্ছা শুঁটকির উপকারিতা নিয়ে কোন গবেষণা হয়েছে কি?’ ‘আরে নিজের চোখে দেখে বলছি বিশ^াস হচ্ছে না বুঝি? গ্রামে দেখবে দুষ্টামি-বাঁদরামি করে ছোট বাচ্চাদের হাত-পা প্রায়ই ভাঙ্গে আর বুড়োবুড়িদের হাড় ভাঙ্গাভাঙ্গি কমই হয় শুঁটকি খাওয়ার কারণে। এদেশে দেখ হসপিটালে অনেক বয়স্করা এই হিপ সার্জারি করে ঘরে ফিরে যাচ্ছে আবার নী ইনজুরি নিয়ে ফিরে আসছে।’ এশা ভাবল হয়ত কথাটা সত্যি তবে শুঁটকিকে সালাম। ঈদে রান্না করবে। ইন্টারনেট ঘেঁটে যত রেসিপি এশা পেল কোনটাই পছন্দ হলো না তার। একজনকে ফোন করে ছানার মিষ্টির রেসিপি চাইল কারণ উনার নিজের হাতে বানানো মিষ্টি খেয়ে খুব ভাল লেগেছিল। ভদ্রমহিলা অদ¢ুত। রেসিপি তো উনি দিলেনই না তবে উপদেশ দিলেন অনেক। বললেন ‘দেখ চারদিকে প্রায় শোনা যায় রক্তে মিষ্টি বেড়ে গেছে আর মিষ্টি খাইয়ে মানুষকে মারার ফন্দি কর না। টক-ঝাল-নুন্তা কর এতেই হবে।’ ‘টক-ঝাল না হয় বুঝলাম কিন্তু নুন্তা নিয়েই যত চিন্তা’ ‘কেন ডালপুরি সিংগারা এসব কর’ ‘আচ্ছা দেখি।’ এশা বাজারের কেনা জিনিস খাওয়াবে না ঠিক করল। যদিও সে রান্নার ‘র’ও জানে না। অনেক চিন্তাভাবনা করল। সব চিন্তা শেষে নিজের রেসিপি মতো শুধু সবজি দিয়ে ভেজেটেবল লাজানিয়া আভেনে বেক করল। ছানার পুর দিয়ে পুলিপিঠা বানিয়ে তা তেলে না ভেজেভাপে করল। এশার ভেজেটেবল লাজানিয়া স্যান্ডউইচ ব্রেডের সঙ্গে খেয়ে সবাই খুব তৃপ্ত হলো। অনেকেই বলল ওর লাজানিয়া খুব সুস্বাদু একটি ভেজিটেব্ল ডিশ। যিনি মিষ্টির রেসিপি দিতে চাননি তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে এশার কাছে ভেজেটেবল লাজানিয়ার রেসিপি চাইলেন। এশা আন্তরিকভাবে বলল ‘আমি রেসিপি লিখেরাখিনি যে; যদি চান তবে তা মুখে বলব আপনাকে একদিন।’ এশার আনন্দ হলো ভেবে যে ঈদের রান্না তার ভালই হয়েছে তাই তো লোকজন খেয়ে রেসিপি পর্যন্ত চাইছে। দু’দিন পর আবার ছানার মিষ্টি তৈরি করণেওলির ফোন। ভেজেটেবল লাজানিয়ার রেসিপি নিতে চান। এশা বললো ‘বলছি শুনুন’ ‘সবুর কর, কাগজ কলম হাতে নেই আমার কিছু মনে থাকে না। লিখে রাখতে হবে’ ‘লিখুন তবে, দু’টো মাঝারি আকৃতির তাজা বেগুন লাগবে, তার সাথে আলু দু’তিনটা, পাঁচ ছয়টা বাটন মাশরুম, কয়েকটা কাঁচামরিচ সামান্য পেঁয়াজ পাতা যাকে এখানে বলে স্প্রিং অনিয়ন, আরও লাগবে সামান্য মোজারেলা চীজ’ ‘আচ্ছা পড়ছি শুন এশা অবাক হয়ে বলে উঠল ‘এটা তো টেলিফোন নম্বর না!’ ‘রাখ তো মেয়ে মুরব্বিদের সঙ্গে এত কঠিন হবে না; লিখার অভ্যাস নাই তো ভুলভাল লিখলাম কিনা তাই দেখ একবার’ পড়ে শুনানোর পর নিজেই বললেন ‘ধুয়ে নিয়ে আলু-বেগুন আধ সেন্টিমিটার মোটা মতো গোল গোল চাক্তি করে কেটেছ দেখলাম?’ ‘আগে আলু ছিলে অল্প পানিতে লবন দিয়ে সিদ্ধ করে নেবেন যাতে না ভাঙ্গে তারপর কাটতে হবে, এবার...’ টেলিফোনের অপারে মহিলা চেচিয়ে উঠলেন ‘আস্তে থেমে থেমে বল তাড়াতাড়ি লিখতে পারি না, বুঝ না’ এশা ঈষৎ বিরক্ত হলো। উনি তাড়াতাড়ি লিখতে পারেন না এটাও জানবে কি করে! ‘এবার সামান্য তেলে বেগুনের চাকগুলো এপিঠওপিঠ পাঁচ মিনিট ফ্রাই প্যানে ভেজে নামান, ঢাকনা দিতে পারেন তবে ঢাকনায় জমা পানি যেন ফ্রাই প্যানে না পড়ে’ ‘এই মেয়ে শুন তুমি করেছ আভেন বেক আর আমাকে বলছ পানিতে আলু সিদ্ধ করতে, তেলে বেগুন ভাজতে, কেন?’ মহিলার গলাটা অভিমানী শুনাল। এশা দরদ মাখা কণ্ঠে বলল ‘আহা শুনুন তো আগে, এবার বেকিং ডিশে অলিভ অয়েল মাখিয়ে এক একটা আইটেম পরত পরত করে সাজান। প্রতি পরতে কাঁচামরিচ ও স্প্রিং অনিয়ন কুচি ছিটিয়ে তার উপর সামান্য মোজারেলা চীজ ছড়িয়ে দিন। এভাবে আলু-বেগুন-মাশরুমের স্তরে স্তরে চীজ, কুচানো কাঁচামরিচ পেঁয়াজ পাতা দিয়ে সাজিয়ে আভেনে ২৫/৩০ মিনিট বেক করে নিলেই হবে।’ ‘ঠিক লিখেছি কি না শুন’ এশা মন দিয়ে শুনে বলল ‘ঠিকই লিখেছেন; এবার আপনার মিষ্টির রেসিপিটা বলুন দেখি’ ‘কিসের রেসিপি?’ ‘সেই আপনার তৈরি ছানার র্বফি?’ মহিলা হেসে নিলেন একচোট। তারপর বললেন ‘তোমাকে শিখাচ্ছি তবে তুমি কাউকে বলবে না কেমন। দোকানের ছানার মিষ্টি বেলুন দিয়ে আস্তে চেপে পাতলা করে নিয়ে কেটে-ছেটে বরফি আকৃতি কর তার উপর কিশমিশ ঘিয়ে ভেজে পছন্দমতো নক্শা করে বরফির টুকরায় চাপ দিয়ে গেথে দাও। বেশ হয়ে গেল। বুঝেছো এসব হচ্ছে বিদেশী বুদ্ধি’ এশার খুব ভাল লাগল মহিলার সততা। ওর ঈদ আনন্দ দ্বিগুণ হলো একজনমানুষের সৎ ও সরল স্বীকারুক্তি শুনে।
×