ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বপ্নের সন্ধানে সৌরভ

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ১২ জুন ২০১৮

স্বপ্নের সন্ধানে সৌরভ

তিনি একজন স্বপ্নবাজ তরুণ। ক্যামেরার রোল যার জীবনের ক্যানভাস। সাধারণ ঘটানাকে যিনি সাধারণ্যে উপস্থাপন করেন অসাধারণভাবে। ফুটিয়ে তুলেন বড় পর্দায়। যার গল্পগুলো তরুণদের নতুন করে ভাবায়। ভালবাসেন নিজের কাজের মাধ্যমে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে। ভিন্নধর্মী শর্ট ফিল্ম দিয়ে তিনি জিতে নিয়েছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার। যার মধ্যে “চেস”, “ডেড সার্কাস”, “স্ট্যান্ড পয়েন্ট”, “প্রতিভাস” অন্যতম। তিনি ফরিদুল আহসান সৌরভ। বিচারক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন এই স্বপ্নবাজ মানুষটি। সম্প্রতি কানাডার একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জববষ ণড়ঁঃয ঋরষস ঋবংঃরাধষ, ঠধহপড়াঁবৎ, ইঈ, ঈধহধফধ ২০১৭-১৮তে ইয়ুথ জুরি নির্বাচিত হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন বাংলাদেশের। আমাদের আজকের আয়োজনের অতিথি এই তরুণ। সঙ্গে ছিলেনÑ মাহির দীপন ডিপ্রজন্ম : আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং পরিবার সম্পর্কে কিছু বলুন। সৌরভ : প্রথমে পরিবার দিয়েই শুরু করি। পরিবার বলতে আমাদের বাসায় আব্বু, আম্মু, বড় ভাইয়া আর আপু। আব্বু পেশায় একজন সরকারী কর্মকর্তা। আমার জন্ম নারায়ণগঞ্জ জেলায়। ছেলেবেলার বড় একটা অংশ কেটেছে চাষাঢ়াতে। শহরের যান্ত্রিকতার মাঝেও প্রতি সন্ধ্যায় কখনও বোস কেবিন আবার কখনও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আড্ডা জমাতাম বন্ধুদের নিয়ে। এরপর যখন একটু বড় হলাম, তখন থেকে সেই আড্ডার অবসরটুকু হারালাম। প্রতিদিনই চাষাঢ়া থেকে তেজগাঁতে ক্লাস করতে যেতে হতো। আমি পড়তাম সরকারী বিজ্ঞান কলেজে। কলেজে থাকা অবস্থাতেই একটা সময় নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে ঢাকাতে চলে আসা হলো। এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি যে আমার নানাবাড়ি, দাদাবাড়ি দুইই নারায়ণগঞ্জ। তাই সময় পেলে এখনও ভার্সিটির বাসে করে হুটহাট চলে যাই সেখানে। ডিপ্রজন্ম : চলচ্চিত্র ভাবনার শুরুটা... সৌরভ : স্কুলজীবনে অনেক ফিল্ম দেখা হতো। তবে সেভাবে বাছবিচারে ছিলাম না। বন্ধুদের কাছ থেকে ডিভিডি নিয়ে মুভি দেখার দিন ছিল তখন। ফলে খুব যে পছন্দমাফিক ফিল্ম দেখার সুযোগ হতো তা নয়। আর সে সময় তো টিভি ছিল মুভি দেখার অন্যতম মাধ্যম। সিনেমার সাথে আমার পরিচয় বা সখ্যতা আসলে সে সময় থেকেই। তবে তখনও ঠিক চলচ্চিত্র নির্মাণের ভাবনাটা সেভাবে ভাবা হয়নি। শুধু দর্শক হিসেবেই চলচ্চিত্রের সাথে বোঝাপড়ার চেষ্টা চলত। পরবর্তীতে নির্মাতা হবার ইচ্ছেটা আসলে দানা বাঁধতে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন আমি প্রথম বর্ষে। প্রথম বর্ষে ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি আর আড্ডা দিয়েই সময় কাটত আমার। টিএসসিতে দিনরাত পরে থাকা হতো। ফলে টিএসসির বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত হবার সুবাদে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথেই পরিচয় হয়। সেখান থেকেই স্বপ্নের শুরু। এরপর শিল্পকলার মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সিনেমা নির্মাণের আগ্রহটা আরও বাড়তে থাকে। ডিপ্রজন্ম : সবাই যেখানে অভিনয় করতে চায় সেখানে নির্মাতা হবার পথ বেছে নিলেন কেন? সৌরভ : একজন নির্মাতাকে যদি তার কাজের স্রষ্টা ধরা হয়, তবে তার কুশীলবরা সেই স্রষ্টার আজ্ঞাবাহী সহযাত্রী। অর্থাৎ যিনি নির্মাতা তার নির্দেশনাতেই অভিনয় শিল্পীরা কাজ করেন। এটা ঠিক যে অভিনয়ে নতুনত্ব আনা যায়, ব্যক্তি পারফর্মেন্সেও চমক দেখানো যায় কিন্তু সামগ্রিকভাবে যে শিল্পটি নির্মিত হচ্ছে সেটিকে নিজের অভিনয় দিয়ে খুব বেশি প্রভাবিত করা যায় না। কিন্তু একজন নির্মাতাকে শিল্পের সেই সামগ্রিক নান্দনিকরণের কাজটিই করতে হয়। যা আমার কাছে খুব বেশি চ্যালেঞ্জিং বলে মনে হয়। আবার নির্মাতা অডিও ভিজুয়াল মিডিয়ামে একটি কাহিনী বা বক্তব্যকে নিজের চিন্তাভাবনা ও মেধার সমন্বয়ে উপস্থাপন করতে পারেন। যা অভিনয় শিল্পীদের কাজ নয়। এ কাজ করতে চাইলে তখন একজন অভিনয় শিল্পীকেও নির্দেশনায় আসতে হবে। তাই আমার কাছে নির্দেশনাকে একটি স্বাধীন শিল্প প্রকাশের মাধ্যম বলে মনে হয় বলেই বেছে নেয়া। ডিপ্রজন্ম : বিভিন প্রদর্শনীতে নিজের চলচিত্রগুলো প্রদর্শিত হয়েছে। দর্শকদের সাথে বসে পর্দায় নিজের অনুভূতিটা কেমন? সৌরভ : ফিল্ম ফেস্টিভাল দর্শক এবং নির্মাতার মেলবন্ধনের কাজটি করে। প্রথমত বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভালের পাবলিক স্ক্রিনিংয়ে আমি আমার কাজগুলো একজন দর্শকের অবস্থান থেকে দেখার চেষ্টা করি। এতে সহজে নিজের কাজের সবল ও দুর্বল দিক ধরতে পারা যায়। দ্বিতীয়ত, একই সময়ে আমি আশপাশের মানুষের এক্সপ্রেশন দেখার চেষ্টা করি, যেন এই এক্সপ্রেশন দেখে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আদৌ তৈরি হচ্ছে কিনা সেটা বুঝা যায়। স্ক্রিনিং শেষে যখন একজন দর্শকের কাছ থেকে প্রশংসা পাই তা সত্যিই বেশ আনন্দদায়ক অনুভূতি। আবার অনেকে গঠনমূলক সমালোচনা করে থাকেন। সেটিও শুনতে ভাল লাগে। তখন নিজের সাথে বোঝাপড়ার বিষয়টি আরও ভালভাবে কাজ করে। সমালোচনা যৌক্তিক হলে তা নিয়ে পরবর্তীতে কাজ করারও সুযোগ থাকে। এজন্য পাবলিক স্ক্রিনিংকে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য সেরা প্ল্যাটফর্ম বলে মনে হয়। ডিপ্রজন্ম : নির্মাতা হিসাবে আপনার অর্জনগুলো... সৌরভ : নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি সিনে এ্যান্ড ড্রামা ক্লাব আয়োজিত ইন্টার ইউনিভার্সিটি শর্টফিল্ম ফেস্টিভাল ২০১৬-তে সেরা নির্বাচিত হয় আমার নন ফিকশন এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম ‘স্ট্যান্ডপয়েন্ট’। রোমানিয়ার টুয়েলভ মান্থ ফিল্ম ফেস্টিভালের জুলাই এডিশনে ৬৮টি দেশের ২৫৬টি ফিল্মের মধ্যে এক্সপেরিমেন্টাল ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান পায় স্ট্যান্ডপয়েন্ট। এছাড়াও পুয়েবলা, মেক্সিকোর বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক ফেস্টিভাল নিওফেস্টে অংশ নেয় চলচ্চিত্রটি। আমার ‘চেস’ বুলগেরিয়ার আর্লি বার্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফিল্ম ফেস্টিভালে এক্সপেরিমেন্টাল ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ থেকে একমাত্র ফিল্ম হিসাবে অফিসিয়াল সিলেকশন পায়। কানাডার ইন্ডিউইস ফিল্ম ফেস্ট ২০১৬তে ডকু ফিকশন ক্যাটাগরিতে ফাইনালিস্ট ফিল্ম হয় আমার ‘ডেড’স সার্কাস। ‘ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ান’ নিয়ে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছি সারাবিশ্বের হরর ফিল্মের সবচেয়ে বড় আসর ‘ঋৎরমযঃ হরমযঃ ভরষস ভবংঃরাধষ’ ২০১৬তে। ২০১৭তে আফ্রিকার অন্যতম বৃহৎ চলচ্চিত্র উৎসবসহ কার্ডিফ এবং ইতালির সিফালো ফিল্ম ফেস্টিভালে অফিসিয়াল সিলেকশন পায় আমার ‘প্রতিভাস’। তালিকা দীর্ঘ না করে বলি দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পারা আমার সবচেয়ে বড় অর্জন। ডিপ্রজন্ম : চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুপ্রেরণাটা কোথা থেকে পান? সৌরভ : কখনো নিজের থেকে আবার কখনো দেশে বিদেশের বিভিন্ন ফিল্ম দেখে। যে ফিল্ম দেখে তার ইতিবাচক অনুভূতি দীর্ঘসময় মনে রয়ে যায় সেটিই আমার বিবেচনায় ভাল অনুপ্রেরণাদায়ক ফিল্ম। আবার কখনও আশপাশের ঘটে যাওয়া কোন ঘটনাও চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। ডিপ্রজন্ম : জীবন নাকি চলচিত্রের রোল কোনটাকে বেশি সহজ মনে হয়? সৌরভ : জীবনের চরিত্র অকৃত্রিম তথা প্রাকৃতিক। ফলে এই রোল প্লে করা খুব সহজাত একটা ব্যাপার বলেই মনে হয়। কিন্তু চলচ্চিত্রের পিছনে কাজের ভূমিকায় অনেক বেশি বাড়তি দায় দায়িত্ব বহনের ব্যাপার থাকে। সেই রোলে আপনি আপনার নিজের চরিত্রের বাইরেও আরও অনেক অনেক ইন্ডিভিজুয়াল চরিত্র নিয়ে কাজ করেন। সেই চরিত্রগুলো আপনি অনুধাবনের চেষ্টা করেন, যে ব্যাপারটি কিন্তু প্রাকৃতিক না। যার ফলে অন্য একটি চরিত্র সৃষ্টি করে সেই চরিত্রকে আবার ক্যামেরায় বন্দী করা নিঃসন্দেহে তুলনামূলকভাবে কঠিনই বলব। ডিপ্রজন্ম : নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কোন ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছেন? সৌরভ : সময় এবং অর্থ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় এই দুইয়ের সমন্বয় দুরূহ একটি ব্যাপার। তবে চেষ্টা চালিয়ে এবং সেক্রিফাইস করে কিছুটা সমন্বয় করতেই হয়। আপনি যখন কোন কিছু নির্মাণ করতে চাইবেন তাখন প্রথম বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে আপনি সেটিকে কতটা অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। যদি তুলনামূলক বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন তবে ঠিকই অনেক কিছু সেক্রিফাইস করে সব বাধাকে অগ্রাহ্য করে নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাবেন। ডিপ্রজন্ম : বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে পড়ছেন। এবং চলচ্চিত্রের বাইরে কি নিয়ে আগ্রহ আছে? সৌরভ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের “শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট” (আই.ই.আর) এ স্নাতকোত্তর করছি। আমার স্নাতক একই বিষয়ের ওপর ছিল। প্রথম বর্ষে থাকাকালীন টিএসসি আর আমাদের আইইআরের গেমস রুমে নিয়মিত যাওয়া হতো। ক্লাসের ফাঁকে প্রতিদিনই টেবিল টেনিস খেলতাম। একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণেই দেশের শিক্ষা সংক্রান্ত যে কোন বিষয়ে আমি আগ্রহ খুঁজে পাই। আলাদা করে বললে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমি কাজ করতে আগ্রহী। এছাড়া ইত্তেফাকে ফিচার লিখতাম আগে। লেখালেখি করতেও আমার ভাল লাগে। ডিপ্রজন্ম : প্রিয় লেখক, প্রিয় বই, নিজের আইডল... সৌরভ : প্রিয় লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়। প্রিয় বই “একেই বলে শুটিং”। সেভাবে বলতে আমার কোন আইডল নেই। আমার বাবা আমার একজন অসাধারণ অনুপ্রেরণার উৎস। আর নির্মাতাদের মধ্যে আকিরা কুরোসায়া, আব্বাস কিয়ারোস্তামি, জাফর পানাহিকে অবচেতনভাবে অনুসরণ করা হয়। ডিপ্রজন্ম : ভবিষ্যত এ কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান? সৌরভ : ভবিষ্যতে এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে থাকবে সুশাসন, দেশ হবে দুর্নীতিমুক্ত। দেশে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, থাকবে না কোন শ্রেণীবৈষম্য। দেশের মানুষ সৃজনশীল চিন্তার পাশাপাশি সৃজনশীলতা চর্চার ধারা অব্যাহত রাখবে। বর্তমান ইউরোপে ফ্রান্স, ইতালি এবং স্পেন যেভাবে শিল্প, সাহিত্যের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে, বাংলাদেশও ভবিষ্যতে দেশীয় এবং বিশ্ব সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে পুরো বিশ্বে সেরকম পরিচিত লাভ করবে। ডিপ্রজন্ম : ভবিষ্যত নিয়ে কি ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে? সৌরভ : একটা সময় থেকে আমি শুধু নির্মাতা হবারই স্বপ্ন দেখি। এবং সে লক্ষ্যেই সামনে কাজ করে যেতে চাই। ভবিষ্যতে আমি যেমন স্বল্পদৈর্ঘ্য বানাতে চাই, তেমনি ফিচার ফিকশন করারও আগ্রহ রাখি। আবার প্রামাণ্য চলচ্চিত্রও নির্মাণ করতে চাই। আমি স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরবে, চলচ্চিত্র নিয়ে সারাবিশ্বে আমরা গর্ব করতে পারব।
×