ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

যেসব শিল্প-কারখানা পরিবেশ দূষণ করছে সেগুলো সরিয়ে নেয়া হবে পরিবেশ রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে

মহানগরে শিল্প নয় ॥ দূষণ রোধে সরকারের সিদ্ধান্ত

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

মহানগরে শিল্প নয় ॥ দূষণ রোধে সরকারের সিদ্ধান্ত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নতুন করে দেশের কোন মহানগরীতে আর শিল্প স্থাপনের অনুমোদন দেবে না সরকার। পরিবেশ এবং পানি দূষণরোধে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রবিবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে নদী দূষণরোধে গঠিত টাস্কফোর্সের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠকে যেসব শিল্প-কারখানা মহানগরীর পরিবেশ দূষণ করছে তা সরিয়ে নেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকাকে ঘিরে বুড়িগঙ্গা এবং শীতলক্ষ্যাসহ নদীগুলোর দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এসব দূষণের জন্য ঢাকার শিল্প-কারখানাই দায়ী। শহরের হাজারীবাগের চামড়া শোধনাগার সাভার সরিয়ে নিলেও নদীর দূষণ কমছে না। শুধু ঢাকাই নয় ঢাকার পাশের দুই নগরী গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও ঢাকার পরিবেশে বিষ ছড়াচ্ছে। অনেক দিন থেকেই শহুরে শিল্প সরিয়ে নেয়ার দাবি ছিল। খোদ রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠাও প্রতিরোধ করা যাচ্ছিল না। শুধু রাজধানী ঢাকাই নয় অন্য বড় শহরের উপকণ্ঠেই শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছিল উদ্যোক্তারা। তবে এখন থেকে শিল্প স্থাপনের অনুমোদন দেবে না সরকার। নৌপরিবহনমন্ত্রী ও টাস্কফোর্সের সভাপতি শাজাহান খান বৈঠকের পর জানান, এখন থেকে উদ্যোক্তাদের আর কোন মহানগরী এলাকায় শিল্প স্থাপন করতে দেয়া হবে না। যে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো শহরের মধ্যে রয়েছে সেগুলোকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হবে। দেশে ১১০টি ইকোনমিক জোন রয়েছে। ঢাকাসহ সব মহানগরীর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থনৈতিক জোনে যেতে হবে, যেভাবে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে নিয়ে গেছি সেভাবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। নৌমন্ত্রী জানান, যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিশোধনাগার বা ইটিপি থাকার পরও তা চালু রাখে না, তাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদফতরকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দূষণে মাটি, পানি, বাতাস সবগুলোতেই বিষ ছড়াচ্ছে। যে ধরনের শিল্প গড়ে তোলা হয়েছে, সেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে দূষণ হচ্ছে। একইসঙ্গে ইটের ভাঁটির কারণেও দূষণ হচ্ছে। নদীগুলো দূষিত হচ্ছে শিল্প-কারখানার বর্জ্য।ে আমাদের খাদ্যে দূষণের প্রভাব খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া না হলে সেগুলো দূষণের প্রভাব মুক্ত করতে অনেক সময় লেগে যাবে। ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে বায়ু এবং শব্দদূষণের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু এবং বয়স্করা। তাদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, বা এ্যাজমার মতো রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়া পরিবেশ দূষণের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, কেবল এই চার নদীতে প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন বিষাক্ত তরল ও কঠিন বর্জ্য পড়ছে। এসব বর্জ্যরে ৬০ ভাগই ট্যানারি ও স্যুয়ারেজের, ৩০ ভাগ নানা শিল্প-কারখানার এবং বাকি ১০ ভাগ বর্জ্য অন্যান্য উৎসের। রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে ছোট বড় মিলে প্রায় আড়াই লাখ শিল্প-কারখানা রয়েছে। এসব শিল্প-কারখানার ৯৯ ভাগেরই তরল বর্জ্যরে পানি শোধনাগার নেই। নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের বুড়িগঙ্গার পানি পরীক্ষার রিপোর্টে ক্রোমিয়াম, নাইট্রেট, সিসা ও উচ্চমাত্রায় পারদসহ ৬৮ প্রকার অপরিশোধিত রাসায়নিক পদার্থের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। বুড়িগঙ্গার প্রতি লিটার পানিতে প্রায় দশমিক ৪৮ মিলিগ্রাম ক্রোমিয়াম রয়েছে। তবে পানিতে ক্রোমিয়ামের মাত্রা দশমিক ৫০ মিলিগ্রাম মিশ্রণ পানি পান করলেই মানুষ মারা যাবার সম্ভাবনার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিএর জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে, পলিথিন, শিল্প-কারখানা এবং মানববর্জ্যরে কারণে বুড়িগঙ্গ নদীর তলদেশে প্রায় ১২ ফুট স্তর জমা পড়েছে। বুড়িগঙ্গার তলদেশের এসব বর্জ্য উত্তোলনের জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছিল। কিন্তু বর্জ্য উত্তোলন করা হয়নি। বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, বিদ্যুত জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোঃ আবদুস সামাদসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কর্মকর্তরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় জানানো হয় যে, পরিবেশ ও নদীর পানি দূষণরোধে সাভারস্থ ট্যানারির সিইটিপি ত্রুটিমুক্ত করতে শিল্প মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সিইটিপি সম্পূর্ণভাবে স্থাপন ও কার্যকরী না হওয়া পর্যন্ত ঠিকাদারের বিল পরিশোধ না করতে সভায় নির্দেশ দেয়া হয়। সভায় জানানো হয় যে, বুড়িগঙ্গা নদীর সম্পূর্ণ অংশ, তুরাগ নদের আংশিক এবং ধলেশ্বরী নদীর আংশিক সীমানা পুনঃজরিপ করা হয়েছে। আপত্তিকৃত এক হাজার ১৫৪টি পিলারের মধ্যে ৭৬২টি পিলারের পুনঃজরিপ কাজ শেষ হয়েছে। অবশিষ্ট আপত্তিকৃত পিলারের পুনঃজরিপ কাজ, চলমান রয়েছে। সীমানা পিলার উচ্ছেদ বন্ধ করার জন্য বিআইডব্লিউটিএর মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। সভায় জানানো হয় যে, ঢাকা মহানগরের ৪৬টি খালের মধ্যে ২৬টি চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি খাল উদ্ধার, সংস্কার ও পাড় বাঁধাইয়ের কাজ চলমান রয়েছে। ঢাকা শহরের খালগুলো খননের জন্য ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের কাছে ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে। সভায় আরও জানানো হয় যে, আদি বুড়িগঙ্গা উদ্ধারে জরিপ কাজ সম্পন্ন এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে আটজন সার্ভেয়ারকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। নদী তীরে অননুমোদিত স্থানে স্থাপিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থানান্তরের কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
×