ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বইয়ের মাসে স্মরণ;###;শরীফা খন্দকার

ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের পথিকৃৎ রংপুরের খেরাজ আলী

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের পথিকৃৎ রংপুরের খেরাজ আলী

সুদূর সেই অতীতে দিনেদুপুরে একটি পুঁথিশালা নড়তে নড়তে চলছে বাংলার এক জনারণ্যের প্রাণ কেন্দ্র- শুনে একটু ধাঁধাই লেগেছিল বটে। বালিকা বয়সে পড়েছিলাম ‘চেয়ে দেখি ঠোকাঠুকি বরগা কড়িতে- কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে’ সেটা না হয় কবির রাত ঘুমের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আজ থেকে ৮৫ বছর আগে ‘খাতুনিয়া সার্কুলেটিং লাইব্রেরী’ নামের এক পাঠভবন প্রকৃত অর্থেই তৎকালীন রংপুর শহরে চলন্ত রূপ ধারণ করেছিল, সেকথা আমার পরবাসী জীবনে শুনে হতবাক না হয়ে পারিনি! দেশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ম্যাগাসাস পুরস্কারপ্রাপ্ত বই আন্দোলনের কথা তো জানি। কিন্তু মাত্র বছর দেড়েক আগে আমাদের নিউইয়র্কের বাসায় এক চিত্রকরের গল্পের ইজেলে আঁকা হলো, যে দূর অতীতের চিত্রকলা সেটায় যেমন ছিল বিস্ময়, তেমনি লজ্জাও। লজ্জাটা ছিল এই কারণে যে, রংপুর সম্পর্কিত এই আশ্চর্য খবর সেখানকার স্কুল কিংবা কলেজ জীবনে একবারের জন্য শোনা হয়নি। এই গল্পচিত্রটি যিনি এঁকেছিলেন তিনি একজন স্বনামখ্যাত চিত্রশিল্পী নাম মতলুব আলী। তখনও চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, এক সময়ের ডিন। হৃদয়ে ধারণ করা সেই চিত্র কবে যেন হয়ে গেল চিত্রকল্পদ্রুম আর সেই সঙ্গে আমার নিজ জন্ম শহর নির্মাণ করল অদেখা দিনের নির্বাক একটি চলচ্চিত্র। প্রবাস বাড়ির পেছনের বৃক্ষাচ্ছাদিত নির্জন পথটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কল্পনার পর্দায় কতদিন দেখি চলমান সে ছবি। হেঁটে বা সাইকেলে চলছে মানুষজন কিংবা ছাত্র, গ্রাম থেকে আসা কিছু গরুর গাড়ি ফেরার পথে। মুটের মাথায় ভারি বোঝার জিনিসপত্র বা বাজার চাপিয়ে ছুটছেন কেউ, পর্দানসীন বিবিদের সঙ্গে করে কিংবা ভারি ভারি মালপত্র সামলিয়ে কেউ কেউ অন্যত্র যাচ্ছেন ঘোড়াগাড়ি নামক বাহনে। ছুটির পর পাঠশালার বালক-বালিকা, মেয়েরা বেরিয়ে পড়েছে বালিকা বিদ্যালয় থেকে। আরও কিছু পরে চল্লিশ শতকে আমার মা এবং খালা বিনুনি দুলিয়ে গার্লস স্কুলের সেই মেয়েদের দলে। কিন্তু কে এই সঙ্গীবিহীন একাকী তরুণ, কাঁধে অমন ওজনদার বইয়ের বোঝা নিয়ে যিনি সাইকেলে ধাবমান? মাঝে মাঝে তার দুই চাকার বাহনটি গতি কমিয়ে থামছে কোন পর্দানসীন খাতুনের সদর দুয়ারে- সেখান থেকে অন্দর মহলে। নানা ধরনের গ্রন্থ আদান-প্রদান করে সাইকেল আরোহী তরুণ ফের বইয়ের ঝোলা কাঁধে উঠিয়ে আবার ছুটছে অন্য এক খাতুনের দুয়ারে। এমন অভাবিত ঘটনা শুধু সেই শহরে নয়, তৎকালীন ভূভারত কিংবা তার বাইরের দুনিয়াতেও ঘটেছিল কিনা সংশয় আছে। কারণ, এমন ইতিহাস পুঁথিপুস্তকে মেলেনি। এই অভূতপূর্ব ঘটনাটি সম্পর্কে সে সময়ের খ্যাতিমান সংবাদপত্র ‘রঙ্গপুর দর্পণ’ একটি খবর প্রকাশ করেছিল ‘খেরাজ আলী স্থানীয় কোর্টের জনৈক কর্মচারী ইনি মাদ্রাসা রোডে নিজ বাড়িতে ‘খাতুনিয়া লাইব্রেরী ‘বা মহিলা পাঠাগার নাম দিয়া একটি পাঠাগারের প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। এই পাঠাগারের বর্তমান পুস্তক সংখ্যা দুই শতাধিক এবং পাঠক সংখ্যা অর্ধশতের ওপর-হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মহিলা পাঠিকার সংখ্যাই সমধিক। প্রতিষ্ঠাতা উপন্যাস পরিপ্লাবিত বঙ্গদেশে, বালক-বালিকাদিগের বিশেষত মায়ের জাতির মতিগতি সুনীতি, সুরুচি ও স্বধর্মের প্রতি আকর্ষণের জন্য মহৎ জীবন এবং নীতি ধর্মমূলক সুখপাঠ্য পুস্তকাবলী সংগ্রহ করিয়া তাহা পাঠক-পাঠিকাদিগের গৃহদ্বারে পৌঁছাইয়া দিবার ব্যবস্থা করিয়াছেন। পুস্তক পাঠেচ্ছু নর-নারী মাসিক চাঁদা পাঁচ পয়সা দিলে একখানি মুদ্রিত কার্ড পাইবেন। উহা পূরণ করিয়া পাঠাইয়া দিলে একমাস পর্যন্ত ঘরে বসিয়া প্রতিমাসে পাঁচ পয়সা প্রদানে নানাবিধ সুখপাঠ্য সৎগ্রন্থ পাঠের সুবিধা প্রদান করায় বহু পরিবারের মধ্যে জ্ঞান প্রচারে বিশেষ সহায়তা হইয়াছে।’ রংপুরের ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা ‘রঙ্গপুর দর্পণ’ ১৬ চৈত্র ১৩৪১ সালের সংখ্যায় আরও লিখেছিল ‘মৌলভী খেরাজ আলী এই প্রতিষ্ঠানের জনক, উন্নত ও অভিনব আদর্শে ইহা রংপুরের বাহিরের বহু বিশিষ্ট লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে।’ পত্রিকার বিবরণের সঙ্গে যোগ করতে হয় আরও কিছু আশ্চর্যের কথা। নিজ উদ্যোগে আপন বসতবাটিতে পাঠভবন প্রতিষ্ঠা করে স্বয়ং প্রতিষ্ঠাতা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অন্তঃপুরবাসিনীদের কাছে পৌঁছে দিতেন পুস্তক। এখানে বলা ভালো খাতুনিয়া পাঠাগারে মাসিক চাঁদা ৫ পয়সার সঙ্গে ভর্তি ফি ছিল ১০ পয়সা। অত্যন্ত কড়াকড়ি নিয়ম মোতাবেক কোন পাঠক বই হারিয়ে ফেললে তাকে সেটি ক্রয় করে দিতে হতো অথবা পরিশোধ করতে হতো নগদ মূল্য। আলোচিত খেরাজ আলীর কর্মস্থল ছিল রংপুর শহর। যেটির উপকণ্ঠে পায়রাবন্দ নামক গ্রামে নারী জাগরণের বাণী অন্তরে ধারণ করে মহীয়সী নারী রোকেয়ার জন্মগ্রহণ ও বেড়ে ওঠা। কিন্তু অনগ্রসর মুসলিম সমাজের অবরোধবাসিনীদের মুক্তির লক্ষ্যে আরদ্ধ কাজ অসম্পূর্ণ রেখে মধ্যগগনে কলকাতায় অস্তমিত হয়েছিল বেগম রোকেয়ার জীবনসূর্য। এমন শোকাবহ ঘটনার দশ মাসের মাথাতেই এই কথিত যুবক নিজ শহরের অগণিত রাজা জমিদারদের অন্তর্ভুক্ত না হয়েও অনন্ত সাহসিকতার সঙ্গে মহীয়সীর নিভে যাওয়া আলোটি জ্বালানোর ব্রত নিলেন যেন মাটির প্রদীপ হয়ে।’ খাতুনিয়া সার্কুলেটিং লাইব্রেরী’ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে প্রতিষ্ঠাতা খেরাজ আলী লিখেছেন, ‘১৯৩০/৩১ সালের দিকে দু’চারজন মুসলিম অফিসার রংপুরে আসতে শুরু করেন। তারা তো পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হিন্দুদের মতো কখনও চাকরি জীবনে অভ্যস্ত নন। যে টাকা তারা বেতন পেতেন, তাতে শুয়ে বসে খাওয়া-পরা ভালভাবেই চলে যেত। মিঞারা দশটা পাঁচটা অফিস করতেন। বিবিরা তামাম দিন সরকারী বাসায় শুধু চাকর চাকরানীর ভরসায় গড়াগড়ি পেড়ে আর ঘুমিয়ে কাটাতেন। তখন এই মেয়েরা কিছু কিছু লেখাপড়া জেনেছেন। আলস্যে কাটানো তাদের এই বরবাদ জীবনকে অর্থবহ করবার চিন্তা আমার মাথায় দেখা দিল। নতুন খেয়াল মনে এলো। একটা চলন্ত লাইব্রেরী থাকলে ওই বিবিদের জন্য পড়াশোনা করে সময় সময় কাটাবার বন্দোবস্ত হতে পারে সেই সৎ চিন্তাদি তাদের সন্তানের জন্মে ও তাদের লালন পালনেও শরিক হবে। চাইকি তার ভিতর দিয়ে বিশেষ কোন প্রতিভার জন্ম হতে পারে।’ জানা যায়, কলকাতায় বেগম রোকেয়ার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের উদ্বোধন হয়েছিল তিনখানা বেঞ্চ ও ৭ জন মাত্র ছাত্রী ভরসা করে আর রংপুর শহরে খেরাজ আলীর গ্রন্থাগার আত্মপ্রকাশ করেছিল ৯৩ খানা পুস্তক জোগাড়যন্ত্র করে। যদিও পরবর্তীতে এর সংখ্যা হয় হাজারের অধিক। আরবি ভাষায় ‘খাতুন’-এর আভিধানিক অর্থ সম্ভ্রান্ত মহিলা। সেই যুগটাতে বিশেষত মুসলিম ললনাকুলই ছিলেন যেমন শিক্ষা বঞ্চিত, তেমনি অন্তরীণ দশায়। হিন্দু আধুনিক মহিলারা কিয়দংশে হলেও বেরিয়ে এসেছেন আলোয়। এমন কি ১৮৮৪ সালে চন্দ্রমুখী বসু নামের প্রথম বাঙালী মহিলা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাস করেছেন। সে কারণে প্রাথমিক অবস্থায় মুসলিম ললনাদের নিয়েই এই পথিকৃৎ তার কাজের শুরুটি করেছিলেন এবং ‘খাতুনিয়া সার্কুলেটিং লাইব্রেরী’ ছিল গ্রন্থাগারের যথার্থ যুগোপযোগী নাম। ১৯৮২ সালের জুলাই মাসে তার মুখোমুখি হয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, তখন তিনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ। বলেছিলেন, ‘কিছু একটা করবার জন্য তাড়না অনুভব করতাম সবসময়, তখন সবচেয়ে কষ্টকর ব্যাপার ছিল মেয়েদের জন্য বই জোগাড় করা। কাজেই যারা একটু আধটু পড়তে জানতেন তারাও বইয়ের অভাবে পড়তে পারতেন না।...এই লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠাকালে আমার চিন্তা ছিল যেহেতু আমাদের মেয়েরা ঘরের বাইরে আসতে পারেন না- সে জন্য তাদের হাতে ঘুরে ঘুরে বই পৌঁছাতে হবে এজন্য পাঠিকাদের জন্য আমি নিজেই বই নির্বাচন করতাম’। লাইব্রেরী ও সাহিত্য বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে খেরাজ আলীর বেশ কয়েকবার পত্রবিনিময় ঘটেছিল। ‘খাতুনিয়া’কে কবিগুরু তার রচিত ৭ খানা গ্রন্থ পাঠিয়েছিলেন উপহার হিসেবে। আলী সাহেবের বড় সাধ নিয়ে প্রিয় কবিগুরুকে এই প্রতিষ্ঠানটিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ ঘটায় সেটি অপূর্ণ থেকে যায়। তদানীন্তন রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহকুমার পলাশবাড়ী অঞ্চলের গড়েয়া গ্রামে জন্ম হলো এক শিশুর। নবজাতকের জন্মের পরপরই স্থানীয় জমিদার বাড়ির প-িত আগমন করলেন বাড়িতে। দাদা আব্দুর রহিমের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে তার নাতির নামকরণের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। এই প-িত শুধু সংস্কৃত শাস্ত্রে সুপ-িত ছিলেন না, পা-িত্য অর্জন করেছিলেন আরবী ও ফার্সী ভাষাতেও। আরবী ভাষাতেই তিনি নবজাতকের নাম দিলেন খেরাজুন অলিউন-যার অর্থ সৃষ্টি কর্তার প্রতি প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ খাজনা। নামকরণের এই ইতিহাসটুকু ও তার মর্মার্থ অবগত না হলে খেরাজ আলীকে জানা সম্পূর্ণ হবে না। নিজ নামের ক্ষেত্রে খেরাজ আলী বহন করেছেন অনন্য অসাম্প্রদায়িক এমন একটি ঐতিহ্য। পূর্বেই বলা হয়েছে ‘খাতুনিয়া লাইব্রেরী’টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৩ সালে এবং স্থায়ী হয়েছে দীর্ঘ ২০ বছর ১৯৫৫ পর্যন্ত। বন্ধ হওয়ার কারণ সম্পর্কে তার আলোচিত সুযোগ্য পুত্র বলেছেন,’ সে সময় তার পিতার শরীর থেকে হারিয়ে গেছে তারুণ্যের অপরিমেয় শক্তি, অথচ এমন এক বিশাল কাজের ভার নেবার মতো যোগ্য উত্তরাধিকার তিনি খুঁজে পাননি। সন্তানরাও সে সময় সাবালক হয়ে ওঠেননি। অবশেষে খাতুনিয়ার ৭৫ বছর পার হওয়ার সময় সংগোপনে পরিবারের অজ্ঞাতসারে জমিশুদ্ধ লাইব্রেরী গোপনে দান করে দিলেন কেরামতিয়া হাই স্কুলকে। সৃষ্টি কর্তার শ্রেষ্ঠ খাজনা নামের মানুষটি আশঙ্কা করেছিলেন তার বংশগত উত্তরাধিকারীরা যদি কোনদিন দখল করে বসে তার তিলেতিলে গোড়া এই অমূল্য সম্পদ, তবে তিনি স্রষ্টার কাছে তার কি জবাব দেবেন! অথচ এমন ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থাগারের স্মৃতির কোন মূল্য দেয়নি ইতিহাস-ঐতিহ্যবিমুখ জাতির অংশ হিসেবে সমাজের কিছু মানুষ। নব্বইয়ের দশকে দেশের এমন মূল্যবান সম্পদকে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে ধূলিসাত করে তৈরি করে স্কুলের নতুন ভবন। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি এবং স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেশের সরকার অসংখ্য গুণীজনকে পদকে ভূষিত করে থাকেন। মৌলবী খেরাজ আলীকে শ্রদ্ধা জানাতে জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষাকারী সরকার এগিয়ে আসবেন আশা করি। কৃতজ্ঞতা স্বীকার : আমার কারমাইকেল কলেজের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আলিম উদ্দিন ও অধ্যাপক মতলুব আলী
×