ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় নির্বাচনী বছরে সঙ্কটে সরকার

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় নির্বাচনী বছরে সঙ্কটে সরকার

রশিদ মামুন ॥ নির্বাচনের বছরে এসে জ¦ালানির মূল্য বৃদ্ধি সঙ্কট তৈরি করবে সরকারের জনপ্রিয়তায়। আবার জ¦ালানির মূল্য বৃদ্ধি না করলে জ¦ালানিতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হবে। সরকারের পক্ষে এই বাড়তি ব্যয় সহনীয়ও নয়। সরকারের নীতি নির্ধারকরা বলছেন, এখন জ¦ালানির দর একটি বাড়তি দুশ্চিন্তা যোগ করেছে। বিশেষত বিশ^ বাজারে তেলের দর বেড়ে যাওয়ায় সঙ্কটে পড়েছে দেশের জ¦ালানি খাত। এপ্রিলে নতুন জ¦ালানি এলএনজি এলে একবারে গ্যাসের দামও বৃদ্ধি করতে হবে। জ¦ালানির দর সমন্বয় নিয়ে সরকারের চিন্তা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিদ্যুত, জ¦ালানি এবং খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ শনিবার জনকণ্ঠকে বলেন, গ্যাসের দাম সমন্বয় নিয়ে আমরা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছে গেছি। তারা বিষয়টি দেখছে, কি করা যায়। এলএনজি আনা হলে আমরা আগে থেকেই বলেছি শিল্পের গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হবে। এখনও আমরা সেই অবস্থানেই আছি। তেলের দাম সমন্বয়ের জন্য আমরা একটি ফর্মুলা নির্ধারণের চেষ্টা করছি; যাতে তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে আমাদের এখানেও বাড়বে আর কমে গেলে আমাদের এখানেও কমে যাবে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেক মাসে দর সমন্বয় হবে। তিনি জানান, এখন বিপিসি প্রতিমাসে ৩৫০ কোটি টাকার মতো লোকসান করছে। বিপিসি বলছে, ২০০১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত টানা লোকসান হয়েছে তাদের। তখন সরকার প্রতিবছর বিপিসির ঘাটতি মোকাবেলাতে ভর্তুকি দিত। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের পর বিশ^ বাজারে তেলের দাম কমে আসায় বিপিসির লাভ হতে থাকে। জ¦ালানি খাত থেকে সরকার ভর্তুকিও তুলে নেয়। তবে এবার জনপ্রিয়তার কথা চিন্তা করে দাম বৃদ্ধি না করলে বছরে তিন হাজার কোটি টাকার ওপর ঘাটতি মোকাবেলায় বিপিসিকে ভর্তুকি দিতে হবে। তেলের আন্তর্জাতিক দর বৃদ্ধির সঙ্গে অন্য জ¦ালানির দরও বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে এলএনজির দামের ক্ষেত্রে সরকারকে আরও কিছুটা বাড়তি দাম গুনতে হবে। আগামী এপ্রিল থেকেই দেশে এলএনজি আসা শুরু হচ্ছে। বাড়বে এলপিজির দরও। যদিও এলপিজিতে সরকারের ভূমিকা খুব কম। সরকার যে সামান্য পরিমাণ এলপিজি বিতরণ করে তা দিয়ে দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণও সম্ভব নয়। সম্প্রতি জ¦ালানি বিভাগে পাঠানো চিঠিতে কেরোসিনে ১১ টাকা, ডিজেলে ৭ টাকা এবং ফার্নেস অয়েলে ১৩ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় কেরোসিনে ১১ টাকা, ডিজেলে সাড়ে পাঁচ টাকা এবং ফার্নেস অয়েলে ১০ টাকা লোকসান করছে বিপিসি। এখন বাজারে কেরোসিন ও ডিজেল ৬৫ টাকা এবং ফার্নেস ওয়েল ৪২ টাকায় বিক্রি করছে বিপিসি। সমীন্তের ওপারে বাংলাদেশী মুদ্রায় ৮৬ টাকা লিটার দরে ডিজেল বিক্রি হচ্ছে যা বিপিসির দরের তুলনায় ২৩ টাকা বেশি। এতে দেশ থেকে ডিজেল পাচার হচ্ছে বলে দাবি করছে বিপিসি। গত ৭ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে বিপিসি দাবি করেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় তাদের লোকসান হচ্ছে। এজন্য সংস্থাটি ডিজেল, কেরোসিন ও ফার্নেস অয়েলের দাম বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। তবে অকটেন ও পেট্রোলের দামের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। বিপিসি বলছে, তারা গত বছরের জুনে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি ব্যারেল ত্রুড অয়েল ৪৭ ডলারে কিনেছিল তা বেড়ে বর্তমানে ৭১ ডলার হয়েছে। জ¦ালানি বিভাগ বলছে, আগামী এপ্রিলে দেশের প্রথম এলএনজি টার্মিনাল উৎপাদনে আসবে। এতে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি জাতীয় গ্রিডের গ্যাসের সঙ্গে যোগ হওয়ার কথা। ফলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি করতে গেলে বিপুল লোকসানের শিকার হতে হবে। সরকার শেষ বছরে এসে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করতে না চাইলে এক্ষেত্রেও ভর্তুকি দিতে হবে। জ¦ালানি বিভাগ সূত্র বলছে, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ইতোমধ্যে শিল্প উদ্যোক্তাদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করা হয়েছে। শিল্প উদ্যোক্তারা সরকারকে সহনীয় পর্যায়ে গ্যাসের দর বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। এক্ষেত্রে গ্যাসের ওপর থাকা সকল ধরনের কর তুলে দেয়ার আহ্বানও জ¦ানিয়েছে ব্যবসায়ীরা। সরকার ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে এলএনজি আমদানির শুরু থেকে গ্যাসের ওপর থাকা ৯৩ দশমিক ২৪ ভাগ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন শুধু গ্যাসের ওপর ১৫ ভাগ ভ্যাট থাকবে। বড় রকমের ছাড় দেয়ার পরও এলএনজি আমদানিতে কোন ভর্তুকি দিতে না চাইলে গ্যাসের দাম সহনীয় থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। সরকারের পর্যালোচনায় বলা হচ্ছে, দেশে এখন গ্যাসের বিক্রিমূল্য প্রতি হাজার ঘনফুটে দুই দশমিক ১৭ ডলার। এখন সমপরিমাণ এলএনজি আমদানি মূল্য ৮ মার্কিন ডলার। এই সময়ে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করে সরবরাহ করা দৈনিকের দুই হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করলে রি-গ্যাসিফিকেশন চার্জ, সঞ্চালন, বিতরণ ব্যয় এবং সকল রকমের কর অন্তর্ভুক্ত করলে দাম পড়বে ৪ দশমিক ৩৫ ডলার। জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সরকার এই পদ্ধতিতেই এলএনজি বিক্রি করতে চাইছে। তবে এতেও একবারে গ্যাসের মূল্য দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে শিল্প উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিতে সামগ্রিক মূল্যস্ফিতি ঘটবে। অন্যদিকে বাড়তি দরের গ্যাস বিদ্যুত উৎপাদনে ব্যয় করা হলে পিডিবির ভর্তুকির পরিমাণও বাড়বে। অর্থ বিভাগ এই ভর্তুকি দিতে না চাইলে বিদ্যুতের দর বৃদ্ধিরও কোন বিকল্প থাকবে না। জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, জ¦ালানি খাতে সরকারের উদ্যোগের অভাবে আমাদের দেশের স্থল এবং সমুদ্রে তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান না করায় সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এখন সেই সঙ্কট সামাল দিতে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। তিনি বলেন তেলের ক্ষেত্রেও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপ করলে দাম বাড়াতে হতো না।
×