ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী আজ

প্রকাশিত: ০০:৫১, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী আজ

লিটন আব্বাস ॥ দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরীর (১৯২৯-১৯৯৬) প্রয়াণ দিবস আজ ২৩ ফেব্রুয়ারী। তিনি ছিলেন একজন দ্রোহী কথাশিল্পী ও কথাসাহিত্যিক। তিনি সনিষ্ঠায় ও মনস্বিতায় অতুলনীয়। শুধুমাত্র তাঁর সাহিত্য চর্চা ও পাঠের মধ্য-দিয়ে একজন সচেতন বাঙালি ক্রমাগত চেতনা ও মননে জাগরিত হয়ে উঠতে পারেন। বস্তুত তিনি ছিলেন বাংলা-সাহিত্য-জগতে দ্রোহী কথাসাহিত্যের নির্মিতি ও মর্মাংশে এক শুদ্ধ আধুনিকোত্তরক। যুগাত্মক জটিল চেতনাপ্রবাহী আঙ্গিকে তিনি যেমন ছিলেন চূঁড়াবিহারি তেমনই বিষয়-বস্তু-ঘটনাও অতিশয় কালচৈতন্যবাহী ও বিস্ময়সূচক। অথচ এই অনন্য সাধারণ, স্বতন্ত্র সৃজনশীলতায় ঋদ্ধ দ্রোহী কথাসাহিত্যিক বাংলাদেশের সাহিত্য-আলোচনায় অতিঅল্প উচ্চারিত, ক্ষীণ তোলপাড় তোলা, আর তাঁর অবিনাশী সাহিত্যসম্ভারও কম পঠিত। সম্ভবত এই সময়কালের চতুর্দিকব্যাপী যে অবক্ষয় এই তার প্রমাণ। তাই তাঁর সৃজনশীলতা, শিল্পশৈলী ও কালচেতনার প্রতি ঐকান্তিকতা ও অভিনিবেশ গড়ে তোলার জন্য এবং ‘প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দেবো তোমারই দ্রোহী শব্দাবলী’র অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়ে ২০১৮-এ ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ ‘আব্দুর রউফ চৌধুরী/ রচনাসমগ্র’; অঙ্কুর প্রকাশনী ‘পথ/ আরব জাতির ইতিহাস’; নওরোজ সাহিত্য সম্ভার ‘মুক্তিযুদ্ধ সমগ্র/ বাংলাদেশ ১৯৭১’ প্রকাশের উদ্যেগ গ্রহণ করছে। এতে সচেতন বাঙালি পাঠকমাত্রই উজ্জীবিত ও আরও অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠবেন এমনটাই প্রত্যাশা। ‘নতুন দিগন্ত’-‘পরদেশে পরবাসী’-‘অনিকেত’-‘মা’ (উপন্যাস), ‘গল্পসম্ভার’-‘গল্পভুবন’-‘বিদেশি বৃষ্টি’-‘গল্পসল্প’ (ছোটগল্পের সংকলন), ‘’৭১-এ কবিতা’-‘কবিতাগুচ্ছ’, ‘স্মৃতিতে একাত্তর’, ‘বাঙালির উৎস সন্ধানে’, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’, ‘প্রবন্ধগুচ্ছ’-‘প্রবন্ধনিবন্ধ’ প্রভৃতি গ্রন্থে স্থান করে নেয় পাকিস্তানে প্রতি তীব্র ঘৃণা, ক্ষোভ এবং প্রতিবাদ। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে, তাই ৭ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণার পর থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালনসহ স্বাধীনতা লাভের জন্য নানাভাবে কাজ শুরু করেন, অক্লান্তভাবে। ২৫ মার্চের রাত ও ২৬ মার্চের ভোররাতের পৈশাচিকতার সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশের মুক্তির পক্ষে সোচ্চার হয়ে উঠেন তিনি। তিনি ইংল্যান্ডের ‘পাকিস্তান সোসাইটি’র সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে পদত্যাগ করে ‘সেন্ট আলব্যানস বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি’ গঠন করেন এবং আহবায়ক হিশেবে নির্বাচিত হন। বিশ্বজনমত গঠনের জন্য ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহর ভ্রমণ ও বক্তৃতা প্রদান ও তহবিল সংগ্রহ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের জন্য তহবিল সংগ্রহে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন; এমনকি হাইড পার্কে নিয়মিত জুতো-পলিশ কর্মকা- চালিয়ে অর্থসংগ্রহ করেন। ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সরকারি সাহায্য ও সহযোহিতার জন্য আবেদন জানিয়ে চিঠিপত্র প্রেরণ করেন; সারাও পান তাদের কাছ থেকে; যেমন―স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী (২৪ এপ্রিল ১৯৭১), পররাষ্ট্রমন্ত্রী (১৭ মে ১৯৭১), বিরোধী-দলের নেতৃবৃন্দ (জুন-অক্টোবর ১৯৭১)। তাছাড়াও সর্বাবস্থায়ই কলকাতাস্থ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন (‘মুক্তিযুদ্ধের অজানা দলিল’)। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারও তাঁর পরিশ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করে; যেমন―সূত্র: বি/৫/৪/৭১ (মে-অক্টোবর ১৯৭১-এর বিভিন্ন চিঠিপত্র)। তিনি, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে, ইংল্যান্ডে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সহকারী হিশেবে কাজ করেন; যার স্বীকৃতস্বরূপ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের চিঠিপত্র―১৭ মে ১৯৭১, ৬ জুন ১৯৭১, ২৪ জুন ১৯৭১ প্রভৃতি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৮ ফেয়ারি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে, প্রধানমন্ত্রী পত্রযোগে (সূত্র: পিএম-৩৯/১২-২১৮) তাঁর মুক্তিযুদ্ধকালীন সাহায্য ও সহযোগিতার কথা স্বীকার করে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে, সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে তাঁর প্রিয় সংগঠন ‘হবিগঞ্জ সাহিত্য পরিষদ’-এর উদ্যোগে আয়োজিত হবিগঞ্জ মুক্ত স্কাউট ভবনে ‘মহান একুশের স্মরণে’ আয়োজিত আলোচনা মঞ্চে বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষার অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই মহান ভাষার মাসে আমাদের পক্ষ থেকে নির্লোভ, নিরহংকারী দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন ও তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।
×