ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব

মনের ভাব প্রকাশের জন্য মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে তার মাতৃভাষা। মানুষকে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীতে তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি করে। মানুষ আল্লাহর সেরা সৃষ্টি আশরাফুল মখ্্লুকাত। মানুষকে আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু গভীর মনোনিবেশ করবার, চিন্তাভাবনা করবার, উদ্ভাবন ও আবিষ্কার করবার ক্ষমতা দিয়েছেন, জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন, স্মরণশক্তি দিয়েছেন। মানুষকে তিনি দান করেছেন সুন্দর অবয়ব। ইরশাদ হয়েছে : লাকাদ খালাকনাল ইন্্সানা ফী আহ্্সানি তাকভীম- আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে। (সূরা তীন : আয়াত ৪)। মানুষকে আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু শুধু সুন্দরতম আকৃতিতেই সৃষ্টি করেননি, তিনি তাঁকে মনের ভাব প্রকাশের জন্য কথা বলার শক্তি দিয়েছেন। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : খালাকাল ইন্্সানা ‘আল্লামাহুল বায়ানÑ তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে। (সূরা র্আ্ রহ্্মান : আয়াত ৩-৪)। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের জন্য তার মাতৃভাষাই হচ্ছে সর্বোত্তম মাধ্যম। যত সহজে মনের ভাব মাতৃভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব হয়, অন্য কোন ভাষায় তা তত সহজে ব্যক্ত করা সম্ভব হয় না। এমনকি অন্য ভাষা চেষ্টা-তদ্বির করে, দিনকে দিন অনুশীলনের মাধ্যমে আয়ত্ত করা সম্ভব হলেও তা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্কতন্ত্রীতে তার বোধগম্যতা প্রতিধ্বনিত হয় কিন্তু মাতৃভাষাতেই। আমরা অন্য ভাষাকে অনুধাবন করি নিজের ভাষাতেই তথা মাতৃভাষার মাধ্যমেই। পৃথিবীতে বর্তমানে অসংখ্য ভাষা প্রচলিত রয়েছে। কিছু অপ্রচলিত ভাষার অস্তিত্বও কোনভাবে টিকে আছে। কালক্রমে বেশকিছু ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে মানবসভ্যতার উত্থান-পতনের কারণে। আবার কিছু ভাষা বিলুপ্তির পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু মানুষকে হিদায়াত দান করবার জন্য, সত্য-সুন্দর পথে চলবার পথনির্দেশনার জন্য, সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করবার জন্য, এক আল্লাহ্রই ইবাদত করবার তাকিদ দেয়ার জন্য, আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্্ নেই- এই সত্য কায়েম করবার জন্য যুগে যুগে বহু নবী-রাসূলকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তাঁরা যে দেশে বা যে জনপদে প্রেরিত হয়ে এসেছেন সেই দেশের বা জনপদের মানুষের মাতৃভাষাতেই তাঁরা হিদায়াতের বাণী প্রচার করেছেন। আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি প্রত্যেক রসূলকেই তাঁর নিজ কওমের ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি তাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করবার জন্য। (সূরা ইব্রাহীম : আয়াত ৪) এই আয়াতে কারিমায় মাতৃভাষার গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে যায়। আমরা লক্ষ্য করি যে, পৃথিবীতে অসংখ্য ভাষার এই বিচিত্র সম্ভার মানবসভ্যতাকে জ্ঞানরাজ্যের ধারাবাহিক ¯্রােতে যেন অবগাহন করাচ্ছে। ভাষার বিচিত্রতা আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহুর কুদরত ও নিয়ামতেরই অপূর্ব নিদর্শন। আল্লার্হ এই অপূর্ব নিদর্শন সম্পর্কে কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : এবং তাঁর (আল্লাহ্র) নির্দেশনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশম-লী পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য (সূরা রূম : আয়াত ২২)। পৃথিবীতে এক লাখ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী-রসূল এসেছেন। তাঁরা সকলেই তওহীদ প্রচার করেছেন, ইসলামের পথে মানুষকে আহ্বান করেছেন। তাঁদের মধ্যে সহীফা পেয়েছেন অনেকেই, কিতাব পেয়েছেন কয়েকজন সেই সমস্ত পুস্তিকা বা পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের ভাষাসংশ্লিষ্ট নবী বা রসূলের নিজস্ব ভাষা। সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ নবী সরওয়ারে কায়েনাত হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মাতৃভাষা আরবীতে নাজিল হয়েছে আল-কুরআনুল করীম। কেন কুরআন মজিদকে আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু আরবী ভাষায় নাজিল করলেন সে সম্পর্কে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি তো আপনার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে আপনি এর দ্বারা মুত্তাকিদের সুসংবাদ দিতে পারেন এবং এর দ্বারা বিত-াপ্রবণ সম্প্রদায়কে সতর্ক করে দিতে পারেন (সূরা মরিয়াম : আয়াত ৯৭)। এই আয়াতে কারিমায় উল্লিখিত ‘আমি তো আপনার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি’ (ফা ইন্নামা ইয়াসসারনাহু বিলিসানিকা)Ñ এই কালাম মজিদ মাতৃভাষার গুরুত্ব যে কত অপরিসীম তা সুস্পষ্টভাবে নিরূপণ করে দেয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচারক দল গিয়েছেন। তাঁরা যে অঞ্চলে বা যে দেশে গিয়েছেন প্রথমে সেখানকার মানুষের ভাষা তাঁরা আত্মস্থ করেছেন এবং সেখানকার ভাষাতেই ইসলামের দিকে মানুষকে আহ্বান করেছেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম লোহিত সাগরের ওপারে অবস্থিত আবিসিনিয়ায় একদল সাহাবী প্রেরণ করেন। এই দল প্রেরণের পূর্বে হযরত জাফর ইব্নে আবূ তালিব রাদিআল্লাহু তা’আলা আনুহুকে আবিসিনিয়ার ভাষা আয়ত্ত করতে নির্দেশ দেন। অত্যন্ত মেধার অধিকারী হযরত জাফর ইব্নে আবূ তালিব (রা.) কয়েকদিনের মধ্যে আবিসিনীয় ভাষা শিখে ফেলেন এবং আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী দলের সঙ্গে গমন করেন। আবিসিনিয়ায় পৌঁছে আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাসীর দরবারে তিনি যে বক্তব্য তুলে ধরেন তা আবিসিনীয় ভাষায়। পারস্য দেশের একটি প্রতিনিধি দল প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁরা দেশে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে কুরআন মজিদের কিছু অংশ তাঁদের মাতৃভাষা ফারসীতে অনুবাদ করে দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নির্দেশক্রমে হযরত সালমান ফারসী রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু সূরা ফাতিহাকে ফারসী ভাষায় তরজমা করে দেন। ফারসী ভাষাভাষী অঞ্চলে ইসলামের দ্রুত প্রসারের কারণ হিসেবে বলা হয় যে, ইসলামের কিতাবাদি ফারসী ভাষায় অনুবাদের ফলেই ত্বরিত ইসলাম সেখানে বিস্তৃৃত হয়। বড় বড় কবি-সাহিত্যিক ফারসী ভাষায় ইসলামের নানা বিষয়ে বড় বড় গ্রন্থ রচনা করেন। কবি শায়খ সা’দী, জালালুদ্দীন রূমী, হাফিজ, জামী, আনওয়ারী, ফেরদৌসীসহ অনেকেই ইসলামবিষয়ক লেখালেখি করে অমর হয়ে আছেন। চলবে... লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন
×