ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

ব্যাংকারদের সব সময় আমানতে যত্নশীল হওয়া উচিত

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ব্যাংকারদের সব সময় আমানতে যত্নশীল হওয়া উচিত

ইদানীংকালে ব্যাংকিং খাতের খবরে দৈনিক কাগজগুলো থাকে ভর্তি। দৃশ্যত মনে হয় পাঠকরা এসব খবরে উৎসাহী। কী ধরনের খবর? খবর হচ্ছে ব্যাংকিং খাতের জালিয়াতি, কেলেঙ্কারি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, তারল্য সঙ্কট, ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদি। এমন খবরে কার না উৎসাহ থাকবে? অবশ্য এমনও হতে পারে, এসব খবরের মাধ্যমে একটা ‘অবস্থা’ সৃষ্টির চেষ্টা আছে। কোন্টা সত্য, কোন্টা মিথ্যা তা আমার পক্ষে বলা বড় মুশকিল। তবে আপাতদৃষ্টিতে যেহেতু মনে হয় মিডিয়ার একটা অংশ এসব খবরে উৎসাহী, সুতরাং আমি তাদের দুটো ব্যাংকিং খবর দিচ্ছি প্রতিবেশী দেশের। তারপর আমি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ‘তারল্য সঙ্কট’ নিয়ে লিখব। প্রতিবেশী দেশের দুটো তাজা খবর। একটি ব্যাংকিংয়ের ওপর এবং অন্যটি জালিয়াতির, যাকে ভারতের মিডিয়া বলছে নজিরবিহীন এবং ৭০ বছরের মধ্যে এই প্রথম। ভারতের ‘সিটি ইউনিয়ন ব্যাংকে’ তিনটি লেনদেনের মাধ্যমে ২০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি করার চেষ্টা করে হ্যাকাররা। দুটোতে সফল হয়, একটিতে তারা ব্যর্থ হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেছেন, এই হ্যাকিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের হ্যাকিংয়ের মিল রয়েছে। ব্যাংকের সবাই মনে করেছিল এটা নেটওয়ার্কের সমস্যা কিন্তু তা যে প্রকৃতপক্ষে সাইবার আক্রমণ তা কেউ বুঝতে পারেনি। একটি কাগজে দেখলাম রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, গত বছরে তাদের এক ব্যাংক থেকে হ্যাকাররা ‘সুইফটের’ মাধ্যমে ৬০ লাখ ডলার চুরি করেছে। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ভারত ও রাশিয়ার ব্যাংক থেকে টাকা চুরির খবরের পর আরও একটা বড় খবর আছে। এতে জড়িত টাকার পরিমাণ কমপক্ষে ১১ হাজার ৪০০ কোটি ভারতীয় রুপী। কেউ কেউ বলছেন এই জালিয়াতির পরিমাণ শেষ পর্যন্ত ২৫-৩০ হাজার ভারতীয় রুপীতে ঠেকতে পারে। এর নায়ক কে? নায়ক হচ্ছেন ভারতের শীর্ষস্থানীয় ডায়মন্ড ও স্বর্ণ ব্যবসায়ী নীরব মোদি (নেরেন্দ্র মোদির কেউ নন)। কীভাবে তিনি ‘পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক’ (পি এনবি) থেকে এত টাকা জালিয়াতি করে তুলে নিলেন। ওই ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে তিনি বৈদেশিক মুদ্রায় ‘লেটার অব আন্ডারটেকিং’ ইস্যু করান। এটা বস্তুত ঋণদাতাদের জন্য টাকা পরিশোধের ‘গ্যারান্টি’। এর বিপরীতে তিনি ডায়মন্ড ও স্বর্ণ আমদানির জন্য বিদেশের ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। ওই টাকা আর পরিশোধ করেননি। তিনি এই কাজ করছেন ২০১১ সাল থেকে। গত সপ্তাহে ধরা পড়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অবসরে যাওয়ার পর। এই ঘটনা ঘটানোর পর নীরব মোদি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান সপরিবারে। তিনি সরকারীভাবে একজন ‘নন-রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান’ (এনআরআই)। এত টাকা মেরে কী করে নীরব মোদি দেশ থেকে ভেগে গেলেন এটাই এখন ভারতীয় মিডিয়ার চর্চার বিষয়বস্তু। নীরব মোদি কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের’ সভায় উপস্থিত ছিলেন যেখানে উপস্থিত থাকেন বিশ্বের তাবৎ শত শত কোটির মালিকরা এবং প্রভাবশালী রাষ্ট্রের প্রধান ও সরকারপ্রধানরা। এই নীরব মোদির ঘটনার পর আরেকজন ভারতখ্যাত শিল্পপতি গত সপ্তাহে গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি বিখ্যাত ‘কোটারি’ পরিবারের। তিনি জালিয়াতি করেছেন ৪ হাজার ৩০০ কোটি ভারতীয় রুপী। উল্লেখ্য, এশিয়ার এক নম্বর ধনী বিখ্যাত ‘রিলায়েন্স গ্রুপের’ মালিক অনিল আম্বানি সে দেশের বড় বড় শিল্পপতির সঙ্গে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ঋণখেলাপী। এই খবর দিয়েছে ‘ফ্রন্টলাইন’ নামীয় বিখ্যাত ভারতীয় একটি ম্যাগাজিন। সুব্রত রায় নামীয় ‘সাহারা গ্রুপ’-এর কর্ণধারের খবর আমরা জানি যিনি ছোট সঞ্চয়কারীদের হাজার হাজার কোটি রুপী মেরে এখন জেলে বসবাস করছেন। এদিকে রয়েছেন বিজয় মালব্যÑ আরেকজন ভারতীয় ধনকুবের যিনি দশ হাজার কোটি ভারতীয় রুপী মেরে দিয়ে বর্তমানে লন্ডনে বসবাস করছেন। আরও অনেক খবর ভারতের কাগজে, মিডিয়ায় প্রতিদিন ছাপা হচ্ছে। আমাদের দেশে এসব খবর বড় বেশি পাত্তা পায় না। এই দলে আছে চীনা শত শত কোটি টাকার মালিকরাও যারা টাকা পাচার করে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। যেমন যাচ্ছেন আমাদের অনেক ব্যবসায়ী-শিল্পপতি। কয়েকদিন আগে দেখলাম টিপু সুলতান নামে এক ব্যবসায়ীর উধাও হওয়ার খবর। দেখলাম চট্টগ্রামের জাহিদ হোসেন মিয়ার নাম। এরা দু’জনে তিন-চার শ’ কোটি টাকা মেরে বিদেশে চলে গেছেন। ‘বিসমিল্লাহ’ কেলেঙ্কারির নায়ক দুবাই পালিয়ে আছেন। তার মামলা করেন একজন উকিল। এমন উধাও হওয়া ঋণখেলাপীর খবর দুই দিন পরপর কাগজে ছাপা হচ্ছে। আমি এসব খবরের একটা সংক্ষিপ্ত খবর দিলাম পাঠকদের। বিশ্ব ব্যাংকিং, উদার অর্থনীতি, বাঁচার অর্থনীতি, মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইন ইত্যাদির মধ্যে কী ঘটছে তা বোঝার জন্য। আমার উদ্দেশ্য আমাদের দেশের ব্যাংকিং সমস্যাকে ছোট করে দেখানোর জন্য নয়। আমার উদ্দেশ্য পাঠকদের খবর দেয়া এবং তা শুধু বাংলাদেশের খবর নয়, অন্যান্য দেশেরও খাতে তারা বুঝতে পারে কোথায় কী ঘটছে। এসব খবর দিয়ে আমি এখন চলে যাব বাংলাদেশের ব্যাংকিংখাতের একটা কথিত সমস্যার দিকে। কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন ব্যাংকিং খাতে ‘তারল্য সঙ্কট’ দেখা দিয়েছে। ‘তারল্য সঙ্কট’ কাকে বলে তার একটা সংজ্ঞা আছে বলে জানি। কোন ব্যাংক যদি তার গ্রাহককে টাকা তোলার সময় টাকা দিতে না পারে তবেই তা হয় তারল্য সঙ্কট। এই সমস্যা থেকে দূরে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই মুহূর্তে সম্ভবত ১০০ টাকা আমানতের মধ্যে সাড়ে উনিশ টাকা বিধিবদ্ধ ‘তারল্য’ রাখার নিয়ম বলবৎ রেখেছে। প্রত্যেক ব্যাংক তার মোট আমানতের সাড়ে উনিশ শতাংশ পরিমাণ টাকা নগদে অথবা নগদে রূপান্তরযোগ্য অবস্থায় রাখতে বাধ্যÑ যাতে আমানতকারীরা যখনই টাকা তুলতে আসবে তখনই টাকা দেয়া যায়। এই অবস্থার খেলাপ হলেই তাকে বলে তারল্য সঙ্কট (লিক্যুইডিটি ক্রাইসিস)। খবরের কাগজের রিপোর্ট অনুযায়ী একটি বেসরকারী ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ‘চাহিবা মাত্র’ ফেরত দিতে পারছে না। অন্য কোন ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না এমন খবর আমি অন্তত কাগজে দেখিনি। অতএব সমস্যাটা একটা ব্যাংকের। একে কী করে সমগ্র ব্যাংকিংয়ের সমস্যা বলা হচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়। আর এই অবস্থাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী দায়িত্ব পালন করছে তাও আমি বুঝতে পারছি না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয় এই মুহূর্তে ব্যাংকটিকে মরতে (লিক্যুইভেশন) দেবে, না হয় উদ্ধার করবে। উদ্ধার করার নানা পদ্ধতি আছে। এসব না করে তারা সমস্যাটাকে দীর্ঘায়িত করছে কেন এটাও বুঝতে পারছি না। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি আমানতকারীদের টাকা নানাভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুরক্ষিত করছে। এক লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতকারীদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। কোন ব্যাংক ‘গোল্লায়’ গেলে সঙ্গে সঙ্গে তারা টাকা পেয়ে যাবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। আমার জানা মতে, ৩০-৩৫ শতাংশ আমানতকারী এভাবে সুরক্ষিত। তারপর আছে ব্যাংকের পুঁজির টাকা, প্রভিশনিং-এর টাকা এবং ভাল ঋণ গ্রহীতাদের টাকা। এতে মোটামুটি আমানতকারীদের বৃহদাংশ সুরক্ষিত। এটা শুধু পাঠকদের জানার জন্য বললাম। তবে আমার উদ্দেশ্য অন্য একটা। বর্তমানে আমানতের একটা সঙ্কট আছে। এই সঙ্কট তৈরি করেছে ব্যাংকাররা, ‘এ্যাগ্রেসিভ ব্যাংকাররা’। তারা আমানত যোগাড় করেছে কম, অথচ ঋণ দিয়েছে বেশি। এতে ফান্ড সঙ্কট হয়েছে। কিন্তু একে তারল্য সঙ্কট বলা যায় কী-না তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে বলতে হবে। আমাদের ব্যাংকার এবং ব্যাংক মালিকদের সমস্যা হচ্ছে তারা ব্যাংকিং খাতটিকে নিজেরাই অস্থিতিশীল করে তুলেছেন। তারা ঋণ নিয়ে ব্যস্ত। অথচ তারা বুঝতেই পারছেন না যে, আধুনিক ব্যাংকিং শুরু হয় ‘ডিপোজিট’ দিয়ে। আগে আমানত, তারপর ঋণ। অথচ ব্যাংকাররা আমানতকে কোন স্থায়ী বিষয় করতে রাজি নয়। পাঠকরা লক্ষ্য করবেন ব্যাংক আজকাল তিন বছর, চার বছর, পাঁচ বছরের জন্য কোন আমানত গ্রহণ করে না। তারা আমানত নেয় তিন মাসের জন্য। ছয় মাসী, এক বছরী আমানত আছে। কিন্তু তাতে সুদের হার এমন যে, আমানতকারীরা কম মাসের জন্য আমানত রাখতেই উৎসাহী। ব্যাংক আসলে চায় স্বল্পমেয়াদী আমানত। অথচ ব্যাংকিং বরাবরের ব্যবসা। আজ করব, কাল নয়Ñ এমনটা ব্যাংকিং নয়। আবার ব্যাংকাররা শিল্প ঋণও দেন যা দীর্ঘমেয়াদী। তারা ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের’ বেশ আমদানিতে উৎসাহ দেন। এগুলোও সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী। দীর্ঘমেয়াদী ‘লেন্ডিং’ করা হবে অথচ আমানত ত্রৈমাসিকÑ এটা তো কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এসব করে এখন দেখা যাচ্ছে আমানতের বৃদ্ধির হার কম। লোকেরা অন্য খাতে টাকা বিনিয়োগ করছে, বিনিয়োগের পথ খুঁজছে। একবার টাকা অন্যদিকে চলে গেলে তা ব্যাংকিং খাতে ফিরিয়ে আনতে ভীষণ কষ্ট করতে হয়। এখন শুনছি ব্যাংকে ব্যাংকে ‘টার্গেটের’ অত্যাচার শুরু হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসম্ভব ডিপোজিট টার্গেট দেয়া হচ্ছে। এসব কেন? কেন স্থিতিশীল ব্যাংকিং করা যাবে না? একবার আমানতকারীদের ঝেটিয়ে বিদায় করা। আবার তাদের আদর করে ব্যাংকে আনা কেন? কেন আমরা আমানতকারীদের প্রতি সব সময়ের ভদ্রতা রক্ষা করি না? একবার কোন সুদ দেয় না, আরেকবার দেয়া কেন? ব্যাংকারদের এই মনোভাব, আমি মনে করি, ব্যাংকিং খাতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে। এর থেকে তাদের বেরিয়ে আসা উচিত। মনে রাখা দরকার, আমানতের ভিত্তি স্থিতিশীল না হলে ব্যাংকিং করা যায় না। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×