ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জরিমানার আদেশ স্থগিত ॥ শুনানি শুরুর আগেই বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের হাতাহাতি

খালেদার আপীল গ্রহণ, জামিনের শুনানি রবিবার

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

খালেদার আপীল গ্রহণ, জামিনের শুনানি রবিবার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজার বিরুদ্ধে করা খালেদা জিয়ার আপীল শুনানির জন্য গ্রহণ করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ওই মামলায় বিচারিক আদালতে খালেদা জিয়াকে দেয়া জরিমানার আদেশও স্থগিত করা হয়েছে। এ মামলায় বিচারিক আদালতের নথি তলব করা হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ওই নথি হাইকোর্টে পাঠাতে সংশ্লিষ্ট আদালতকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট দ্বৈত বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ আদেশ প্রদান করেন। এছাড়া জামিনের আবেদনের ওপর শুনানির জন্য রবিবার দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই দিন বেলা দুইটায় আবেদনটি শুনানির জন্য আসবে বলে জানিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী, জয়নুল আবেদীন ও মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রমুখ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। দুদকের পক্ষে ছিলেন খুরশীদ আলম খান। শুনানির শুরুর আগেই বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের হট্টগোলে ও হাতাহাতিতে এক পর্যায়ে বিচারপতিদ্বয় ১০ মিনিটের জন্য এজলাস কক্ষ ত্যাগ করেন। ১০ মিনিট পর বিচারপতিদ্বয় পুনরায় এজলাস কক্ষে ফিরে আসলে শুনানি শুরু হয়। এদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজিরের জন্য আবেদন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আগামী ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার যুক্তি উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের দ-প্রাপ্ত হয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রয়েছেন তিনি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আখতারুজ্জামান গত ৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলার রায়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদ- দেন। খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ অপর পাঁচ আসামির প্রত্যেককে ১০ বছরের জেল এবং আসামিদের প্রত্যেককে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার করে জরিমানা করা হয় রায়ে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, সরকারী এতিম তহবিলের টাকা এতিমদের কল্যাণে ব্যয় না করে পরস্পর যোগসাজশে আত্মসাত করে খালেদা জিয়াসহ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আসামিরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধ করেছেন। খালেদা জিয়াসহ ৬ আসামিকেই অর্থদ- দেয়া হয়। ১১৬৮ পৃষ্ঠার ওই রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর গত ২০ ফেব্রুয়াির হাইকোর্টে আপীল করেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের আইনজীবীরা। হাইকোর্ট ওইদিন আবেদনটির গ্রহণযোগ্যতার শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার দিন রাখে। আদালত খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের মঙ্গলবারই রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদককে আপীল ও জামিন আবেদনের কপি সরবরাহ করতে বললেও আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল অনুলিপি হস্তান্তর করেন বৃহস্পতিবার সকালে। মূল রায়সহ ১২২৩ পৃষ্ঠার আপীল আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে খালেদা জিয়ার খালাস চাওয়া হয়। আর ৮৮০ পৃষ্ঠার জামিন আবেদনের মধ্যে ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে ৩১টি যুক্তিতে খালেদা জিয়ার মুক্তি চাওয়া হয়। সকাল সাড়ে ১০টায় কোর্ট বসলে রাষ্ট্রপক্ষে ফরহাদ আহম্মেদ বলেন, তারা খুব অল্প সময় আগে আসামিপক্ষের কাছ থেকে কপি পেয়েছেন। শুনানির আগে তাদের সময় প্রয়োজন। রাষ্ট্রপক্ষ বেলা ২টা পর্যন্ত সময় চাইলেও বিচারক শুনানির জন্য বেলা ১২টায় সময় ঠিক করে দেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দু’পক্ষের আইনজীবীদের আদালতে উপস্থিত দেখে জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, যেহেতু দু’পক্ষই উপস্থিত আছে, সেহেতু আগেই শুনানি শুরু হতে পারে। কিন্তু আসামিপক্ষ এ সময় একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার কথা বলে। এই অপেক্ষার মধ্যেই বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের ব্যাপক ভিড়ের কারণে আদালতে হট্টগোল তৈরি হয়। আপীলের শুনানিকালে আইনজীবীদের কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। সকাল ১১টা থেকেই বেঞ্চের এজলাস কক্ষে প্রবেশ করা নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে কয়েক দফা কথা-কাটাকাটি, হাতাহাতি ও উচ্চবাচ্য হয়। এ কারণে বিচারপতিরা কয়েকবার তাদের সতর্ক করেন। এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল দাঁড়িয়ে আদালতকে বলেন, এভাবে শুনানি করা সম্ভব না। তিনি দুই পক্ষেই আইনজীবীর সংখ্যা সীমিত করে দিতে অনুরোধ করেন। বিচারক এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনিও সহমত প্রকাশ করেন। আদালত এরপর ১০ মিনিট সময় দিয়ে এর মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলেন। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে বেলা ১২টায় আপীলের গ্রহণযোগ্যতার শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে কে কি বলেন ॥ খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন দাঁড়িয়ে বলেন, আমাদের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা উপস্থিত রয়েছেন। তবে আপীলটি শুনানি করবেন এজে মোহাম্মদ আলী। তখন এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, ক্রিমিনাল ল এ্যামেন্ডমেন্ট এ্যাক্ট ১০ (১) ধারায় আপীলটি করা হয়েছে। আমি আপীল শুনানির জন্য আপীল গ্রহণের আবেদন করছি। আপীল গ্রহণ হলে জামিন আবেদন দেয়া হবে। ৪০৯ ধারায় আপীলকারীকে সাজা দিয়েছে ওই আদালত। আদালত বলেন, এ্যাডমিশনে কি প্রেয়ার আছে না শুধুই আপীল এ্যাডমিশন চেয়েছেন? এ্যাডমিশনের পরে আর কি প্রেয়ার আছে? এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, একটা আপীল এ্যাডমিশনের আবেদনে নরমালি যা যা থাকে আমরা তাই চেয়েছি। নথি দেখে আদালত বলে, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী সাজা বা দ- স্থগিতের বিধান আছে। কনভিকশন কি স্থগিত করা যায়? ক্রিমিনাল এ্যাক্ট ল এ্যামেন্ডমেন্ট এ্যাক্টে কনভিকশন স্থগিতের বিধান নাই। আপনারা তো কনভিকশনও স্থগিত চেয়েছেন। এজে মোহাম্মদ আলী : এটা গতানুগতিক এটা ঠিক করে দিব। সাধারণত এটা একটা প্রথা। সেজন্য এটা আমরা চেয়েছি। এরপর আদালত আপীল শুনানির জন্য গ্রহণ করে। আদেশ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে মামলার নথি তলব। এবং আপীল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত খালেদা জিয়ার অর্থদ- স্থগিত রাখা হলো। এজে মোহাম্মদ আলী : ১৫ দিন ধরে তিনি কাস্টডিতে আছেন। যেহেতু তাকে শর্ট সেনটেন্স দেয়া হয়েছে, সেজন্য আমরা তার বেইল চাচ্ছি। বয়স, সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় জামিন পাওয়ার হকদার। এ্যাটর্নি জেনারেল : আপীল ইতোমধ্যে আদালত গ্রহণ করেছে। আজকে সকালে আমরা জামিন আবেদন পেয়েছি। রেকর্ড আসার পরই বিষয়টি লিস্টে এনে শুনানি করা হোক। আদালত: আপীলকারী সাজা তো কম। আদালতের প্রথা আছে সাজা কম হলে জামিন দেয়ার। এই মামলায় মেরিট আছে। এ কারণে এটা আমরা কার্যতালিকায় এনে শুনানি করতে চাই। দুদকের আইনজীবী খোরশেদ আলম খান বলেন, আমরা এ্যাডমিশনের শুনানি করতে পারি নাই। তখন আদালত বলেন, যখন শুনানির প্রয়োজন তখনই আপনাকে সুযোগ দেয়া হয়েছে। এরপর দুদক আইনের ৩৩ (৫) ধারা দেখিয়ে বলে, এ ধরনের বিশেষ আইনের মামলার ক্ষেত্রে দুদককে যুক্তিসঙ্গত সময় দিয়ে শুনানি করতে হবে। আর আমরা আজ ৯টা ৩১ মিনিটে জামিনের আবেদনের কপি পেয়েছি। আদালত: তারা তো অন মেরিট জামিন চাচ্ছে না। পুরো রেকর্ডের কি দরকার আছে? খুরশীদ আলম খান : ফৌজদারি আইন ব্যবস্থায় নারী বলে আদালত জামিনের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। কিন্তু দুদক আইনে সে সুযোগ নেই। জামিনের আবেদন অনেক বড়, গ্রাউন্ডও অনেক। আদালত: এ কারণেই তো টকশোতে আপনি আলোচনার সুযোগ পেয়েছেন। খুরশীদ আলম খান : আমরা চাচ্ছি কার্যতালিকায় এনে শুনানি করা হোক। এজে মোহাম্মদ আলী : সাধারণত কম সাজা হলে আপীল করলে জামিন দিয়ে দেয়া হয়। আদালত: আপীল বিভাগের অনেক আদেশ আছে কম সাজা হলে জামিন দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সেগুলো বিশেষ আইন প্রণয়নের আগে। যেহেতু দুদক আইনে আছে তাদের যুক্তিসঙ্গত সময় দেয়ার তাই আমরা রবিবার দুপুর ২টায় শুনানির জন্য রাখলাম। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ॥ ২০০৪ (৫) দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক দায়েরকৃত মামলায় অথবা দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক গৃহীত যে কোন কার্যক্রমের যে কোন পর্যায়ে কোন আদালতে কেহ কোন প্রতিকার প্রার্থনা করিলে দুর্নীতি দমন কমিশনকে পক্ষভুক্ত করিতে হইবে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক দায়েরকৃত কোন মামলায় বা কার্যক্রমে কোন ব্যক্তি জামিন কিংবা অন্য কোন প্রকার প্রতিকার প্রার্থনা করিলে কমিশনকে শুনানির জন্য যুক্তিসঙ্গত সময় প্রদান না করিয়া শুনানি গ্রহণ করা যাইবে না। জামিন আবেদনের লিখিত যুক্তি ॥ জামিন আবেদনে বলা হয়েছে, আবেদনকারীর বয়স ৭৩ বছর। তিনি শারীরিক বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন। তিনি ৩০ বছর ধরে গেঁটে বাত, ২০ বছর ধরে ডায়াবেটিস, ১০ বছর ধরে উচ্চ রক্তচাপ ও আয়রন স্বল্পতায় ভুগছেন। ১৯৯৭ সালে তার বাম হাঁটু প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এবং ডান পায়ের হাঁটু ২০০২ সালে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। হাঁটু প্রতিস্থাপনের কারণে তার গিটে ব্যথা হয়, যা প্রচ- যন্ত্রণাদায়ক। এমনকি হাঁটাহাঁটি না করার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ রয়েছে। শারীরিক এসব জটিলতার কারণ বিবেচনায় তার জামিন মঞ্জুরের সবিনয় আরজি জানাচ্ছি। আরেকটি যুক্তিতে বলা হয়েছে, উপমহাদেশ এবং দেশের উচ্চ আদালতসমূহে দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে, যখন আসামি একজন নারী হয় তখন তার অনুকূলে জামিন বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আবেদনকারীর জামিন আবেদন মঞ্জুর করা হোক। আপীলের আরেক যুক্তিতে বলা হয়েছে, ২০০৭-০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূলে যে পদক্ষেপ নিয়েছিল এ মামলাটি তারই অংশ। তাছাড়া মামলার প্রথম অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা জামিন আবেদনকারীর বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলার কোন খুঁজে পায়নি। জামিন আবেদনকারী বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র চেয়ারপার্সন। বিচারিক আদালত তার এই বিষয়টি উপেক্ষা করেছে। তাছাড়া যে মামলায় তাকে সাজা দেয়া হয়েছে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। তাকে হয়রানি করার জন্য এ মামলা করা হয়েছে।
×