ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

টিআইবিও স্বীকার করল বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেছে

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

টিআইবিও স্বীকার করল বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের দুই ধাপ অগ্রগতি হয়েছে। গত বছর যেখানে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদের অবস্থান ছিল ১৫তম, এবার তার অগ্রগতি হয়ে ১৭তম অবস্থানে এসেছে। বৃহস্পতিবার একযোগে বিশ্বের ১৮০টি দেশের দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করে বার্লিনভিক্তিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। এতে দেখানো হয় ২০১৭ অনুযায়ী ২০১৬ সালের তুলনায় বাংলাদেশের স্কোর ও অবস্থান দুই ধাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে সোমালিয়া। এ তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে দক্ষিণ সুদান এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যুদ্ধ বিধস্ত সিরিয়া। বিশ্বের শীর্ষ কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় এবারের স্থান পেয়েছে নিউজিল্যান্ড। কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার ক্রমানুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৩তম। সূচকে জিরো থেকে ১শ’ এর স্কেলে বাংলাদেশের প্রাপ্ত স্কোর মাত্র ২৮। তবে এই স্কোরকে এখনও দুর্নীতির ব্যাপকতা উদ্বেগজনক অবস্থানে বলে মনে করছে টিআইবি। বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ উপলক্ষে বৃহস্প্রতিবার ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারের টিআইবির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক এবং বাংলাদেশের দুর্নীতির পরিস্থিতির তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন। বলেন, এই সূচকে বাংলাদেশের দুই ধাপ অগ্রগতি হলেও অস্বস্তি রয়েই গেছে। ধারণা সূচকে বাংলাদেশ হয়ত দুই ধাপ এগিয়েছে, কিন্তু এটা মোটা দাগে আশার সঞ্চার করে না। দক্ষিণ এশিয়ায় কেবল আফগানিস্তানের থেকে আমরা এগিয়ে আছি। আর এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলেও নিচের দিক থেকে আমাদের অবস্থান চতুর্থ। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় ২০১৭ সালের এই ধারণা সূচকে ২০১৬-২০১৭ পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। সূচকের তথ্য সংগ্রহে মূলত চারটি ধাপ অনুসরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উপাত্তের উৎস নির্বাচন, পুনঃপরিমাপ, পুনঃপরিমাপকৃত উপাত্তের সমন্বয় এবং পরিমাপের যথার্থতা নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ। জরিপগুলোতে মূলত ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, সংশ্লিষ্ট খাতের গবেষক ও বিশ্লেষকদের ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্রণীত এই সূচকের মাধ্যমে সূচকে অন্তর্ভূক্ত দেশসমূহের দুর্নীতির অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে। এবারে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র হিসেবে ৮টি জরিপ ব্যবহৃত হয়েছে। জরিপগুলো হলোঃ বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি এ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল এ্যাসেসমেন্ট ২০১৭, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে ২০১৭, গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস ২০১৬, বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স ২০১৭-১৮, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল ইনডেক্স ২০১৭-১৮, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড ২০১৭, ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস ২০১৭ এবং ভ্যারাইটিস অফ ডেমোক্র্যাসি প্রজেক্ট ডাটাসেট ২০১৭ এর রিপোর্ট। সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থান ॥ টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১৭ সালের ধারণা সূচক অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে ভুটান। তাদের প্রাপ্ত স্কোর ৬৭। কম দুর্নীতি দেশগুলোর মধ্যে ভুটানের অবস্থান ২৬তম। এরপরের অবস্থানে রয়েছে ভারত, যার স্কোর ৪০ এবং অবস্থান ৮১। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এরপরে শ্রীলঙ্কা ৩৮ স্কোর পেয়ে ৯১তম অবস্থানে রয়েছে। ৩৩ স্কোর পেয়ে ১১২তম অবস্থানে এরপর রয়েছে মালদ্বীপ। ৩২ স্কোর পেয়ে ১১৭তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। অন্যদিকে, ৩১ স্কোর পেয়ে ১২২তম অবস্থানে রয়েছে নেপাল। এরপর রয়েছে বাংলাদেশ যার প্রাপ্ত স্কোর ২৮। এর পরে মাত্র ১৫ স্কোর পেয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে আফগানিস্তান। বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আফগাানিস্তানের অবস্থান চতুর্থ। বাংলাদেশের দুই ধাপ অগ্রগতি ॥ দুর্নীতির ধারণা সূচকে ২৮ স্কোর নিয়ে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় (নিচ থেকে উপর) বাংলাদেশের অবস্থা এবার গত বারের চেয়ে দুই ধাপ অগ্রগতি হয়েছে। গতবার যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫তম। এবার সেখানে গতবারের চেয়ে ২ পয়েন্ট বেশি, পেয়ে ১৭ অবস্থানে এসেছে। (উপর থেকে নিচ অনুযায়ী) সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকা অনুযায়ী এবার বাংলাদেশ ১৪৩তম অবস্থানে উঠে এসেছে। গতবার এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৫তম। শুধু বাংলাদেশ নয় একই স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে এ তালিকায় গুয়েতেমালা, কেনিয়া লেবানন ও মৌরতানিয়ার নাম রয়েছে। এছাড়া এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নিচ ক্রমানুযায়ী চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্র্নীতিগ্রস্ত ১২টি দেশ ॥ দুর্নীতির ধারণা সূচক অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮৯ স্কোর নিয়ে তালিকায় সবচেয়ে ভাল অবস্থানে আছে নিউজিল্যান্ড। এর পরে রয়েছে ডেনমার্ক। তাদের প্রাপ্ত স্কোর ৮৮। ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড ৮৫ স্কোর নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। সিঙ্গাপুর ও সুইডেনের প্রাপ্ত স্কোর ৮৪। কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় তাদের অবস্থান ষষ্ঠ অবস্থানে। কানাডা, লুক্সেমবুর্গ, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্যের প্রাপ্ত স্কোর ৮২। তাদের অবস্থান ৮ অষ্টম। এছাড়া জার্মানি ৮১ স্কোর নিয়ে ১২তম অবস্থানে রয়েছে। শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত ১২টি দেশ ॥ টিআই এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, তালিকায় এবারও সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া। তাদের প্রাপ্ত স্কোর ৯। গত বছরের তুলনায় এবার তাদের স্কোর ১ কমেছে। এর পরে রয়েছে দক্ষিণ সুদানের নাম। যাদের প্রাপ্ত স্কোর ১২, সিরিয়ার প্রাপ্ত স্কোর ১৪, আফগানিস্তানের প্রাপ্ত স্কোর ১৫, ইয়েমেনের প্রাপ্ত স্কোর ১৬, সুদানের প্রাপ্ত স্কোর ১৬, লিবিয়ার ১৭, গিনি-বিসাউ এর প্রাপ্ত স্কোর ১৭, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি এর প্রাপ্ত স্কোর ১৭, উত্তর কোরিয়ার স্কোর ১৭, ভেনিজুয়েলা ও ইরাক এর প্রাপ্ত স্কোর ১৮। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, উল্লেখিত সামান্য অগ্রগতি কোন অবস্থাতেই সন্তোষজনক নয়। বাংলাদেশের আইনী, প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতি কাঠামো তুলনামূলকভাবে সুদৃঢ়তর হয়েছে এই ধারণা থেকে সূচকে বাংলাদেশের স্কোর দুই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু প্রয়োগের ঘাটতি, ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে ক্রমবর্ধমান অনৈতিক প্রভাব বিস্তার, অনিয়ম ও দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলায় জড়িত সহায়তাকারী ও দায়ীদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিচারের আওতা তথা জবাবদিহিতা নিশ্চিতে সফল হতে না পারায় আমরা আরও ভাল করতে পারিনি। সংবাদ সম্মেলনে বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতির তথ্য তুলে ধরে জানানো হয়, ২০১৭ সালের সিপিআই অনুযায়ী বৈশি^ক দুর্নীতি পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। সূচক অনুযায়ী, বিশ^ব্যাপী দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লক্ষণীয় উদ্যোগ গ্রহণের পরও অধিকাংশ দেশ এর প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ধীরগতি পরিলক্ষিত হয়েছে, দুই-তৃতীয়াংশের অধিক দেশ ৫০ এর নিচে স্কোর পেয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, যে সকল দেশে গণমাধ্যম ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ (এনজিও) কম সুরক্ষা পেয়ে থাকে, সে সকল দেশে দুর্নীতি অধিকতর মাত্রায় বিদ্যমান। সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয় যে, সিপিআই নির্ণয়ে টিআইবি কোন ভূমিকা পালন করে না। এমনকি টিআইবি’র গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোন তথ্য বা বিশ্লেষণ সিপিআই-এ বিবেচিত হয় না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের টিআই চ্যাপ্টারের মতোই টিআইবিও দুর্নীতির ধারণা সূচক দেশীয় পর্যায়ে প্রকাশ করে মাত্র। যদিও দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণ- সর্বোপরি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে কঠিনতম অন্তরায়, তথাপি বাস্তবে দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি এবং তা প্রতিরোধে দেশের নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যর্থতার কারণে দুর্নীতির কার্যকর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান, অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। এতে জানানো হয়, টিআই এর বার্লিনস্থ সচিবালয়ের গবেষণা বিভাগ কর্তৃক সিপিআই প্রণীত হয়ে থাকে। কলম্বিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের স্ট্যাটিসটিকস ও পলিটিক্যাল সায়েন্স বিভাগ এবং ইতালির মিলানস্থ বকনী বিশ^বিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের বিশেষজ্ঞবৃন্দ কর্তৃক সিপিআই এর তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি বা মেথোডলজি প্রণীত হয়েছে। এছাড়া সিপিআই এর স্কোর জার্মানির হার্টি স্কুল অব ইকোনমিক রিসার্চ এবং মেক্সিকোর মনটেরে ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এ্যান্ড হায়ার এডুকেশনের বিশেষজ্ঞ কর্তৃক যাচাইকৃত।
×