ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাশার খান

কারা নির্যাতিত ভাষাসৈনিক লায়লা নূর

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

কারা নির্যাতিত ভাষাসৈনিক লায়লা নূর

‘আন্দোলন করে, জেল খেটে বাংলা ভাষার ন্যায্য অধিকার আদায় করেছি। আমার ছাত্র রফিকের হাত ধরে এসেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি। ভাবতে ভাল লাগে। চাই না কিছুই; আদালতসহ সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত হোক, তরুণ প্রজন্ম বাংলা ভাষার বিকৃত ব্যবহার না করুক- এটাই প্রত্যাশা।’ কথাগুলো ভাষাসৈনিক লায়লা নূরের। অল্পকথায় নিজের সংগ্রামী জীবন এবং প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির একটা সারমর্ম ফুটে উঠলেও তাঁর জীবনের ইতিহাসটা অনেক বড়। যে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালী জাতির মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি অর্জনের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপর্ব। বাংলা ভাষার দাবির আন্দোলনে নারীরা ছিলেন সামনের কাতারে, অকোতভয় হয়ে। লায়লা নূরের এই অকুতোভয় অংশগ্রহণটা কিশোরী বয়স থেকে। ১৯৪৮ সালে কুমিল্লা শহরের একটি স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়তেন তিনি। ভাষা আন্দোলনের শুরুর দিক থেকেই প্রতিবাদ কর্মসূচীতে সক্রিয় ছিল কুমিল্লা শহর। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশনে কুমিল্লার কৃতী সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের ভাষা হিসেবে ইংরেজী ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে সমান মর্যাদা দেয়ার প্রথম প্রস্তাব পেশ করেন। ধীরেন্দ্রনাথের ভূমিকা পূর্বপাকিস্তানের ছাত্র-যুবকদের পাশাপাশি কুমিল্লার ভাষা আন্দোলনকর্মীদেরও দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। ধীরেন্দ্রনাথ নিজেও কুমিল্লায় ভাষার দাবির কর্মীদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ঢাকায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দেয়, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে দেশের ছাত্রসমাজ। কুমিল্লার ছাত্র-শিক্ষকরাও আন্দোলন করেন তখন। অপরদিকে শহরের কিছু লোক উর্দুর পক্ষেও কর্মসূচী হাতে নেয়। লায়লা নূর জানান, ‘তখন মুসলিম লীগ প্রভাবাধীন স্থানীয় গণ্যমান্য কিছু নারীর উদ্যোগে কুমিল্লায় টাউন হলো ময়দানে একটি সভা হয়। সেখানে বক্তৃতায় তারা বলেন, ‘বাংলা তো আমাদের ভাষা নয়। এটা হিন্দুদের ভাষা। আমরা কেন হিন্দুদের ভাষাকে আমাদের রাষ্ট্রভাষা বানাব। আরবী ও উর্দুই হলো মুসলমানদের ভাষা। তাই বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে এত হৈ-চৈ করার কিছু নেই। টাউন হল ময়দানের ওই সভাটিতে বেশির ভাগ নারীরাই বক্তা ও শ্রোতা ছিল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন কিশোরী লায়লা নূর। বক্তাদের অযৌক্তিক কথা শুনে তীব্র ক্ষোভ জমে তাঁর। এ ব্যাপারে লায়লা নূর বলেন, ‘তাদের এই মূর্খের মতো কথাকে ভুল প্রমাণিত করতে আমি কিছু বলতে চাই- বলে তাদের একজনের কাছে অনুরোধ করলাম। আমি তাদের পক্ষে কথা বলবো ভেবে আমাকে কথা বলার সুযোগ দেয়। বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা বলা যে অমূলক ও ধর্মীয় গোঁড়ামি সে কথা যুক্তিপ্রমাণসহ সবার সামনে আমার বক্তৃতায় তুলে ধরি। পাকিস্তানে বিভিন্ন ভাষাবাসীর অবস্থানও তুলে ধরি। যদিও আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল কুমিল্লার বর্তমান তিতাসের গাজীপুর গ্রামে। কিন্তু বাবার চাকরিসূত্রে আমার শৈশব কেটেছে ভারতের বিহারে। ভাষাসহ নানা বিষয়ে আমাদের বাসায় প্রচুর বই ছিল। এজন্য ভাষার পরিসংখ্যান সম্পর্কে আমার ভালই ধারণা ছিল। আমার কথা শুনে উপস্থিত অনেকেই অবাক হন। বাংলা ভাষার দাবি যে যৌক্তিক, সেটা কিছুটা বুঝতে পারেন। সভায় কিছুটা কানাঘোষা কথা শুরু হয়। এক মহিলা ওঠে গিয়ে আমাকে বলে- তুমি এতক্ষণ যা বলেছে তাতো বলেছই। তুমি এখন সবাইকে বলো যে, আমি এত কথা এমনিতেই বললাম। তবে আমি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকেই পছন্দ করি। আমি ঐ মহিলার ওপর প্রচ- ক্ষিপ্ত হলাম। তারা আমার কথা বলা বন্ধ করে দিল। দুটি ছেলে এসে আমাকে বলল, দেখ তুমি এখান থেকে দ্রুত চলে যাও। চারদিকে পুলিশের তৎপরতা। তোমাকে গ্রেফতারও করতে পারে। আমি তখন কিছুটা নিরাপত্তহীনতা উপলব্ধি করলাম। ছেলে দুটির সহযোগিতায় সেখান থেকে নিরাপদে বাসায় আসতে পেরেছিলাম সেদিন।’ মেট্রিক পাসের পর লায়লা নূর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে এইচএসসি ও ১৯৫২ সালে বিএ পাস করেন। সে বছরই তাঁর বড় বোন ফরিদপুরের একটি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে চাকরি নেন। বাড়িতে লোক না থাকার কারণে লেখাপড়ায় এক বছরেরও বেশি সময় নষ্ট হয় লায়লা নূরের। পরে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও বাংলা ভাষা দাবিতে সরব থাকেন লায়লা নূর। ভাষা আন্দোলনে ১৯৫৫ সালটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘৫২’র একুশের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী বছরগুলোর ৫৫ সালেও ২১ ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরি এবং বিভিন্ন কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীরা অনবদ্য ভূমিকা রাখেন। সে বছর ২০ ফেব্রুয়ারি রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী নিবাসগুলোর ছাদে কালো পতাকা উড়িয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও পরদিন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পাকিস্তানী আর্মি বেআইনীভাবে ছাত্রদের হল এবং ছাত্রীনিবাস ‘চামেলী হাউজে’ রাতে প্রবেশ করে জোরপূর্বক পতাকাগুলো নামিয়ে ফেলে। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে অন্যান্য ছাত্রীদের সঙ্গে শাড়ি পরে খালি পায়ে এসে আমতলায় হাজির হন লায়লা নূর। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় শুরু হয় সভা। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ সেøাগানে মুখরিত হয়ে ওঠে আমতলা। তখন ট্রাকে করে একদল আর্মি এসে উপস্থিত হয় আমতলায়। তারপর ছাত্রদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। প্রচ- লাঠিচার্জের মধ্যে সেখানে মেয়েদের অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হুসনে আরা, তালেয়া রহমান, প্রতিভা মুৎসুদ্দি ও লায়লা নূরসহ অন্যান্য ছাত্রীরা লাইব্রেরির বারান্দায় গিয়ে আশ্রয় নেন। আর্মি লাইব্রেরির বারান্দায় এসে ২১ জন ছাত্রীকে গ্রেফতার করে। স্মৃতিচারণে লায়লা নূর বলেন, ‘আর্মি আমার হাতে যখন হ্যান্ডকাফ লাগাতে আসে, আমি ক্ষিপ্ত হয়ে তাদেরকে ধমক দিয়ে বলি- আমাকে ছোঁবে না বলছি। কোথায় যেতে হবে বলো। আর্মিরা ধমক খেয়ে কিছুটা সময় নেয়। তারপর আমাদেরকে ট্রাকে উঠতে বলে। সকাল ১১/১২টায় আমাদের বারান্দা থেকেই গ্রেফতার করে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। জেলখানায় রাতে আমাদের একটা ফ্লোরে শুতে দেয়। ছাত্রীদের যাঁরা গ্রেফতার থেকে বেঁচে যায়, তারা রাতে হোস্টেল থেকে আমাদের জন্য বিছানা পাঠিয়ে দেয়।’ সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রীদেরকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার কোন চেষ্টা করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ড. জেন কিন্স। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। এ প্রসঙ্গে লায়লা নূর বলেন, ‘ড. জেন কিন্স ছিলেন কড়া লোক। দেখতে খুব ফর্সা ও লম্বা। ব্রিটিশরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তাই তিনি ছাত্রীদের দ্বারা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা পছন্দ করেননি। এ কারণে তিনি ছাত্রীদের ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করেননি। আমার বড় বোন উম্মে কুলসুম গুল নাহার নূর ঐ সময় ফরিদপুর থাকতো। সে ফরিদপুর স্কুলের হেড মিস্ট্রেস ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্রে সেই ছিল আমার অভিভাবক। আমি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার দায়ে জেলে আছি- এই খবর জানিয়ে ভিসি আমার বোনকে চিঠি পাঠায়। ২১ দিন পর মার্চের ১২/১৩ তারিখে আমাদের জেল থেকে মুক্তি দেয়। জেল থেকে বেরিয়ে আমি চামেলী হাউজেই (বর্তমান সলিমুল্লা মুসলিম হল) উঠি।’ লায়লা নূর ১৯৫৬ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করে পরের বছর শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইংরেজী বিভাগে। তিনিই ছিলেন ঐতিহ্যবাহী এই কলেজের প্রথম নারী অধ্যাপক। অবসরে যান ১৯৯২ সালে। লেখালেখি করেছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে। ইংরেজীতে অনুবাদ করেছেন বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবিদের কবিতা। আন্দোলন-সংগ্রাম, শিক্ষকতা আর লেখালেখিতে কেটে গেছে লায়লা নূরের জীবন। বিয়ে করা আর হয়ে উঠেনি। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের জীবন্ত অংশীদার হয়ে এখনও বেঁচে আছেন চিরকুমারী এই মহীয়সী নারী। থাকেন কুমিল্লা শহরের অশোকতলার প্রফেসরপাড়ার মধুমতি লজ-এ। দুই পা আর্থারাইসিসে আক্রান্ত। খুব কষ্টে কিছুটা নড়াচড়া করেন হুইল চেয়ারের সাহায্যে। পত্রিকা ও বই পড়ে সময় কাটান। তাঁর অনেক ছাত্রই আজ সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, এমপি এবং মন্ত্রীও। লায়লা নূরের সরাসরি ছাত্র কানাডা প্রবাসী প্রয়াত রফিকুল ইসলামের হাত ধরেই ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি এসেছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে গর্ববোধ করেন তিনি। বর্তমান ছাত্র আন্দোলন নিয়ে লায়লা নূর ব্যক্ত করেন তাঁর হতাশার কথা। তিনি বলেন, ‘বর্তমান ছাত্র আন্দোলন নিয়ে আমার অনেক আক্ষেপ আর দুঃখ রয়েছে। আমাদের সময়ে ছাত্রদের সকল সিদ্ধান্তকে সাদরে গ্রহণ করত সাধারণ জনগণ। সাধারণ জনগণ বলত, ছাত্ররা যেহেতু বলেছে, তাহলে সঠিক বলেছে, দেশের ভালর জন্যই বলেছে- ছাত্রদের প্রতি এমন বিশ্বাসই ছিল তাদের। কৃষক-শ্রমিক ও গ্রামের লোকেরাও ছাত্রদের ডাকে রাস্তায় নামতো। ছাত্রদের ডাকেই জাতীয় ঐক্য তৈরি হতো। দুঃখের বিষয়- ছাত্র আন্দোলনের সেই সুনাম এবং সুদিন এখন আর নেই। এখন তারা আউট সাইড ক্রিমিনাল। এখন ছাত্রদের কথা শোনলে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়।’ লেখক : ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষক [email protected]
×