ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জিরো লাইনে অবস্থান নেয়াদের বিষয়ে আজ বৈঠক

রোহিঙ্গা তালিকা যাচাইয়ের পর প্রত্যাবাসন শুরু করবে মিয়ানমার

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

রোহিঙ্গা তালিকা যাচাইয়ের পর প্রত্যাবাসন শুরু করবে মিয়ানমার

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী লাখ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন প্রশ্নে কূটনৈতিক পর্যায়ে নানা আয়োজন চলতে থাকলেও এখনও এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন সময় ঘোষণা করছে না মিয়ানমার পক্ষ। সোমবার সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিশ্ব চাপের মুখে মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আগে তাদের তালিকা এবং সে অনুযায়ী যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হওয়ার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। বর্তমানে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ৭০ হাজারের কাছাকাছিতে পৌঁছেছে। এর মধ্য থেকে গত শুক্রবার ৮ হাজার ৩২ রোহিঙ্গার একটি তালিকা মিয়ানমার পক্ষকে হস্তান্তর করা হয়েছে। ইতোপূর্বে হস্তান্তর করা হয়েছিল ১১ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা। তমব্রু সীমান্তে ওপারে শূন্য রেখায় অবস্থানকারী ছয় সহস্রাধিক রোহিঙ্গাদের নিয়ে আজ দুদেশে পক্ষে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে, মিয়ানমার পক্ষ রোহিঙ্গাদের অত সহজে তাদের দেশে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক নয়। এ নিয়ে তারা নিত্যনতুন কৌশল অবম্বরন করছে। এতে করে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি দীর্ঘস্থায়ী যে হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। আর এ কারণেই সরকার ভাসান চরে প্রাথমিকভাবে এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য আশ্রয়স্থল গড়ে তুলছে। সঙ্গে থাকবে সাইক্লোন শেল্টারও। পরবর্তীতে এ ধরনের আরও ব্লক সৃষ্টি করা হবে বলে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্য দিয়েছেন। এদিকে তমব্রু সীমান্তের ওপারে নোম্যানসল্যান্ডে আশ্রিত ছয় সহস্রাধিক রোহিঙ্গা সেখান থেকে অন্য কোন স্থানে না যাওয়ার অটল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তারা বলেছে, সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থানকারীদের ওপর কোনপক্ষ বল প্রয়োগ করতে পারে না। যদিও সম্প্রতি মিয়ানমার সেনা ও পুলিশের মাইকিংয়ের কারণে কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। অপরদিকে উখিয়া ও টেকনাফে ১২ অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনকল্পে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনের ব্যাপত তৎপরতা লক্ষণীয়। ওপার থেকেও খবর পাওয়া গেছে, সেখানেও মিয়ানমার সরকার ক্যাম্প নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিচ্ছে। এছাড়া দুদেশেই এগিয়ে চলেছে ট্রানজিট পয়েন্ট স্থাপনসহ অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজ। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের স্বদেশে পাঠাতে দুটি ট্রানজিট পয়েন্টের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও টেকনাফের কেরুনতলিতে এই দুটি ট্রানজিট পয়েন্ট নির্মিত হচ্ছে। মিয়ানমারও রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে রাখাইনের দুটি স্থানে আপাতত বিশ্রামাগারজাতীয় নির্মাণ কাজ শেষ করেছে বলে জানা গেছে। সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অবস্থানকরা সাড়ে ছয় সহস্রাধিক রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম পয়েন্ট দিয়ে স্থলপথে এবং কেরুনতলি পয়েন্ট দিয়ে নাফ নদী হয়ে নৌপথে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাবে বাংলাদেশ। ১৯৯২ সালেও ওই দুটি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কাজ প্রক্রিয়া চলে। রোহিঙ্গা ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম জানান, প্রথম দিকে ঐ দুটি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। তাই স্থল ও নৌ পথে দুটি ট্রানজিট ক্যাম্প নির্মাণ করা হচ্ছে। খুব দ্রুতই এ গুলোর নির্মাণকাজ শেষ হবে। বাংলাদেশ সরকার সীমান্তের ১০টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে চেয়েছিল। তবে মিয়ানমার শুরুতে দুটি ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপনে সম্মত হয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর এখনও দিন-তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে গত বছরের ২৩ নবেম্বর মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে। চুক্তিতে দুই মাসের মাথায় প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ট্রানজিট পয়েন্ট স্থাপনসহ কিছু কাজ অসম্পন্ন থাকায় কোন রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফেরত যেতে পারেননি। এদিকে মিয়ানমারের একটি গণমাধ্যমে সোমবার জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ যেসব রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করেছে, তা প্রথমে যাচাই-বাছাই শুরু করবে মিয়ানমার। এরপর মিয়ানমার সরকার তা যাচাই করে নেবে তালিকাভুক্তরা রাখাইনের বৈধ অধিবাসী কিনা। এই যাচাই-বাছাইয়ে টিকে গেলেই প্রত্যাবর্তন শুরু হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর এখনও দিন-তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি। রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার জন্য নিরাপদ ও যথাযথ অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশ দ্রুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে নিজ উদ্যোগে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এদিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু শূন্য রেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের স্থান ত্যাগ না করার উস্কানি দিচ্ছে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপ আরএসও। সূত্র মতে, মিয়ানমার অভ্যন্তরে গহীন জঙ্গলে রয়েছে সশস্ত্র আরএসওর শক্ত ঘাঁটি। ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসলেও কেন ৮ হাজার রোহিঙ্গা (বর্তমানে ছয় সহস্রাধিক) মিয়ানমার অভ্যন্তরে রয়ে গেছে? এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে স্থানীয়দের মধ্যে। জিরো লাইনে অবস্থানকৃত রোহিঙ্গারা ইতোপূর্বে বলেছিল নিজ দেশে শান্তি ফিরে আসলে তারা নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে যেতে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু ওসব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের পক্ষে শূন্য রেখা ছেড়ে হয়ত বাংলাদেশে অথবা মিয়ানমারের ফেরত যেতে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ রোহিঙ্গা অনড় রয়েছে। তারা বলছে বর্তমানে আশ্রিত স্থান ত্যাগ করবে না। আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন অনুসারে সীমান্তের জিরো লাইনে (১৫০ গজের মধ্যে) বসতি স্থাপন ও কোন রকমের স্থাপনা নির্মাণ করা যায় না। তাই মিয়ানমারের পক্ষে এসব রোহিঙ্গাকে নো-ম্যান্সল্যান্ড ছেড়ে দিতে বলা হচ্ছে। শূন্য রেখায় বসবাসকারী এসব রোহিঙ্গার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, গত শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) দেশটির উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল অং সো এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল রাখাইন রাজ্যে সফরে এসে রোহিঙ্গাদের ডেকে তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই স্থান ত্যাগ করে বাংলাদেশে অথবা মিয়ানমারে অভ্যন্তরে ফেরত যাওয়ার নির্দেশনা প্রদান করেন। এরপর থেকে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) মাইকে প্রতিদিন নো-ম্যানসল্যান্ড ছাড়তে প্রচারণা শুরু করে। সূত্র জানায়, রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহী সংগঠন আরএসও ক্যাডাররা জিরো লাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের স্থান ত্যাগ না করতে চাপ প্রয়োগ করছে বলে জানা গেছে। একদিকে প্রশাসনের স্থান ত্যাগের নির্দেশনা অপরদিকে সশস্ত্র রোহিঙ্গা ক্যাডারদের শক্ত অবস্থানে থেকে যাবার চাপ প্রয়োগে দিশেহারা হয়ে পড়েছে সাধারণ রোহিঙ্গারা। বর্তমানে তারা না পারছে স্থান ত্যাগ করতে, না পারছে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। কোন ধরনের লিখিত ছাড়া নিজ দেশের ভেতরে যেতে যেমন প্রশাসনকে ভয় পাচ্ছে, তেমনি রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী গ্রুপ আরএসও ক্যাডারদের স্থান ত্যাগ না করার হুমকিতে তটস্থ হয়ে পড়েছে। সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত অধিবাসীদের সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ও সশস্ত্র রোহিঙ্গা ক্যাডারদের স্বার্থ হাসিলের দলাদলিতে সীমান্তের জিরো লাইনে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা সৃষ্টি হতে পারে। সীমান্তের তুমব্রু কোনারপাড়া শূন্য রেখায় সাড়ে ৫ মাস ধরে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরতে না চাওয়ার ঘটনায় প্রশাসন বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। তবে ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মনজুরুল হাসান খাঁন নো ম্যানসল্যান্ডে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলেছেন। তিনি স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, প্রত্যাবাসনের শুরুতেই সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য প্রত্যাবাসন কমিটি প্রস্তুতি নিচ্ছে। যে কারনে শূন্যরেখায় আশ্রিত রোহিঙ্গারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। কক্সবাজার শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম জানান, আজ মঙ্গলবার ঘুমধুম সীমান্ত এলাকায় বান্দরবান জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিকের নেতৃত্বে দুদেশের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে শূন্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গাদের কখন কোথায় ও কিভাবে স্থানান্তর করা হবে। শুক্রবার দুদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে নো-ম্যান্সল্যান্ডে অবস্থানকরা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে প্রস্তাব করে বাংলাদেশ। এরপর মিয়ানমার সম্মতি প্রকাশ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ২০ ফেব্রুয়ারি বৈঠকের আয়োজনের প্রস্তাব রাখে। ঐ সিদ্ধান্তের আলোকে আজ মঙ্গলবার বাংলাদেশ-মিয়ানমার বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ ও মানববন্ধন ॥ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নো-ম্যানসল্যান্ড অবস্থানরত রোহিঙ্গারা জীবনের নিরাপত্তা ৬ দফা দাবি পূরণের লক্ষ্যে প্রত্যেহ সেখানে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করে চলছে। পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনসহ ছয় শর্ত পূরণ না হলে মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজি না বলে জানানো হচ্ছে। মানববন্ধনে রোহিঙ্গারা দাবি করেন জাতিসংঘের শান্তি মিশন রাখাইনে পাঠিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাকে যুক্ত করা, সেনা তা-বে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা, গণমাধ্যমসহ মানবাধিকার গোষ্ঠীকে রাখাইনে অবাধ প্রবেশ-প্রস্থানের সুযোগ দেয়া এবং রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রে বিদ্যমান সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা। রোহিঙ্গা স্বামীর ছুরিকাঘাতে স্ত্রী নিহত ॥ উখিয়ার অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বামীর ছুরিকাঘাতে রেনোয়ারা বেগম নামে এক রোহিঙ্গা নারীর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার ভোরে উখিয়ার কুতুপালং অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধুরছড়া-লম্বাশিয়ার মধ্যবর্তী ব্লক এ-জোনে এ হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটে। খবর পেয়ে উখিয়া থানা পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য জেলা সদর হাসাপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে। জানা গেছে, ২ স্ত্রীর ঝগড়াকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা স্বামী মোঃ হোসেন ভোরে স্ত্রী রেনোয়ারাকে ছুরিকাঘাত করলে ঘটনাস্থলে (বস্তিতে) তার মৃত্যু হয়। পুলিশ ওই ঘাতক স্বামীকে আটক করতে পারেনি।
×