ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আইসিবির ২৩৮ কোটি টাকার দুর্নীতির কূলকিনারা হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

আইসিবির ২৩৮ কোটি টাকার দুর্নীতির কূলকিনারা হয়নি

মশিউর রহমান খান ॥ ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) প্রায় ২ শ ৩৮ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে সহায়তা চেয়ে দ্বিতীয় দফায় তদন্ত প্রতিবেদন পেতে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর আগে ২০১৭ সালের ৫ নবেম্বর ওই প্রতিবেদন চেয়ে নোটিস দেয়া হলেও আইসিবি দুদকের অনুরোধে কোন প্রকার সাড়া দেয়নি। ওই নোটিসে তদন্ত প্রতিবেদন ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে পাঠানোর জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয় দুদক। বারবার চিঠি প্রদানের পরও কোন সাড়া না পাওয়ার ফলে বিনিয়োগ খাতের বিপুল পরিমাণ অর্থের দুর্নীতির কোন কূল-কিনারা করতে পারছে না দুদক। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একমাত্র বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ৫শ ১৪টি মার্জিন হিসেবে এই দুর্নীতি হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। দুদক থেকে গত রবিবার পাঠানো নোটিসে বিষয়টি অতি জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানোর জন্য আইসিবির চেয়ারম্যান বরাবর অনুরোধ করা হয়েছে। অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুদকের সহকারী পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান স্বাক্ষরিত চিঠি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। চিঠিতে বলা হয়, অতি জরুরী ভিত্তিতে আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে চাহিদা অনুযায়ী কাগজপত্রের মূলকপি সংরক্ষণ করে সত্যায়িত ছায়ালিপি সরবরাহের জন্য আবারও অনুরোধ করা হলো। চিঠিতে চাহিদা অনুযায়ী রেকর্ডসমূহের বিষয়ে বলা হয়, আইসিবি সিকিউরিটিজ ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ে দেয়া ২০১৬ সালের ২০ মার্চের তথ্যানুসারে প্রতিষ্ঠানটিতে ৬শ ৮১টি মার্জিন হিসাব রয়েছে। এর মধ্যে ৫শ ২৯টি মার্জিন হিসাবে সম্পদের ঘাটতি রয়েছে। ইতোমধ্যে ১৫টি মার্জিন হিসাবের তদন্ত করা হয়েছে। বাকি মার্জিন হিসাবগুলোর বিষয়ে নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত দলের মাধ্যমে দ্রুত তদন্ত শেষ করে উক্ত তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য আবারও অনুরোধ করা গেল। এর আগে দুদক কর্তৃক ২০১৭ সালের ৫ নবেম্বর ওই প্রতিবেদন চেয়ে নোটিস দিলেও আইসিবি কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত তারিখ কিংবা তারিখের পরেও কোন প্রতিবেদন পাঠায়নি। তখন তদন্ত প্রতিবেদন ওই বছরের ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে পাঠানোর জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল দুদক। মাঝে বেশ কয়েকবার মৌখিকভাবে তাগিদ দেয়া হলেও প্রতিবেদন দেয়নি আইসিবি কর্তৃপক্ষ। উল্লেখ্য,আইসিবির সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছানাউল হকসহ উর্ধতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অনুসন্ধানে এরই মধ্যে আইসিবির বেশ কয়েকজন উর্ধতন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। কমিশনের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন অনুসন্ধানের তদারকি কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। সুত্র জানায়, দুদক সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করতেই বারবার আইসিবিকে চিঠি দিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে দুদক থেকে তাদের সব মার্জিন হিসাবে নথিপত্র যাচাই-বাছাই করা কষ্টসাধ্য এবং অনেক সময়ের প্রয়োজন। তাই আইসিবি কর্তৃপক্ষকে ৫শ ১৪টি মার্জিন হিসাবের বিষয়ে নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করার কথা বলা হয়েছে। এতে একদিকে সময়ের অপচয় যেমন কম হবে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদেরও অযথা হয়রানি হতে হবে না। অভিযোগের বিষয়ে দুদক সূত্র জানায়, আইসিবি ও এর সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান আইসিবি সিকিউরিটিজ ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডে (আইএসটিসিএল) ২শ ৩৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকার অনিয়ম হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে পিটি হিসাবগুলোতে (পাবলিক ট্রেড হিসাব) নিয়ম বহির্ভূতভাবে ঋণ সীমার অতিরিক্ত ১শ ২৩ কোটি ২৮ লাখ টাকার মার্জিন ঋণ দেয়া হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী ছানাউল হক, উপপ্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিপু সুলতান ফারাজীসহ ছয়জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এ অনিয়মের কারণে সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১শ ৫০ কোটি টাকা। এছাড়া আইএসটিসিএলের প্রধান কার্যালয়ের ১শ ৯১টি পিটি হিসাবে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২শ ৩৭ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার টাকার মার্জিন ঋণ দেয়া হয়। এ হিসাবগুলোতে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ঋণ সীমার অতিরিক্ত ১শ ২৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা দেয়া হয়। এ পিটি হিসাবসমূহ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মূলত ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালের প্রথম দিকেই মার্জিন ঋণ সীমার ব্যাপক অনিয়ম ঘটিয়ে সিকিউরিটিজ কেনা হয়। হিসাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১০৩২ নম্বর পিটি হিসাবে ডেবিট স্থিতি থাকা অবস্থায় কাজী ছানাউল হকের মেয়াদকালে ২০০৮ সালের ১৯ অক্টোবরে ১৭ লাখ ৪৮ হাজার ৮৯১ টাকার ক্রেডিট স্থিতির ওপর ১৮ লাখ টাকা এবং ২০ অক্টোবর ৫১ হাজার টাকা ডেবিট স্থিতির ওপর পুনরায় ৭ লাখ টাকা তহবিল উত্তোলন দেয়া হয়েছে। যা বিধি বহির্ভূত এবং গুরুতর অনিয়ম। ৪৪৮১ নম্বর পিটি হিসাবে প্রায় সাড়ে ৪৪ লাখ টাকা ডেবিট স্থিতি থাকা অবস্থায় ছানাউল এবং উপপ্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিপু সুলতান ফারাজীর মেয়াদে ২০১০ সালের ৪ অক্টোবর সিকিউরিটিজ অন্য প্রতিষ্ঠানের লিংক বিও-তে স্থানান্তর করা হয়েছে, যা শতভাগ নিয়ম লঙ্ঘন। এমন ঘটনায় আইসিবি ব্যাংক ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে এ তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।
×