ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

জিডিপি সর্বদা সাফল্যের মাপকাঠি নয়

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

জিডিপি সর্বদা সাফল্যের মাপকাঠি নয়

জিডিপি বা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন একটি দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্য বা অবস্থা নির্ণয়ের প্রধান নির্দেশিকাগুলোর অন্যতম। একটি নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদিত সব পণ্য ও সার্ভিসের মোট ডলারের মূল্য দিয়ে তা প্রকাশ করা হয় এবং সেটাকে অর্থনীতির আকার হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। সাধারণত পূর্ববর্তী বছরের অর্থনীতির আকারের সঙ্গে তুলনা করে দেখা হয় যে, অর্থনীতির আকার কত শতাংশ বেড়েছে বা কমেছে। জিডিপি পরিমাপের কাজটি বেশ জটিল। তবে একেবারে মৌলিক ব্যাপার হচ্ছে, এটি দুটো উপায়ের যে কোন একটির দ্বারা করা যেতে পারে। একটি নির্দিষ্ট বছরে হয় প্রত্যেকের অর্জিত আয় যোগ করে অথবা প্রত্যেকে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে তা যোগ করে। যুক্তি হিসেবে দুটো কৌশলের সমষ্টিগত ফল একই হওয়ার কথা। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সহযোগী সম্পাদক এবং ‘দি গ্রোথ ডিভিউশন’ গ্রন্থের লেখক ডেভিড পিলিং মনে করেন- জিডিপি দিয়ে একটা দেশের অর্থনীতির সাফল্য পরিমাপ করা যায় না। কারণ এটা একটা ত্রুটিপূর্ণ কৌশল। ‘টাইম’ পত্রিকায় এক নিবন্ধে স্পিনিং উল্লেখ করেন, ব্রেক্সিট প্রশ্নে গণভোটের কিছু আগে লন্ডনের কিংস কলেজের ইউরোপীয় রাজনীতির অধ্যাপক আনন্দ মেনন এক আলোচনাসভায় অধিকাংশ অর্থনীতিবিদের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি তুলে বলেছিলেন- এতে ব্রিটেনের জিডিপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দর্শকদের মধ্য থেকে এক মহিলা তাকে পাল্টা মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছিলেন : ‘আরে রাখুন আপনাদের জিডিপি। ওই জিডিপি আমাদের নয়।’ ব্রিটেনের মতো আমেরিকায়ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে সরকারী তথ্য পরিসংখ্যান মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে সর্বদা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। বলা হচ্ছে, মার্কিন অর্থনীতিতে তেজীভাব এসেছে। গত দুই প্রান্তিকে জিডিপি বেড়েছে ৩ শতাংশের বেশি, শেয়ারবাজারে দর বাড়ছে এবং বেকারত্ব ১৭ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে এসে ৪.১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অনেক মানুষ অবশ্য এসব তথ্যে মোটেও উৎফুল্ল বোধ করছে না। কারণ, ধারণা ও বাস্তবতার মধ্যে একটা ব্যবধান আছে। আরও ব্যাপক পরিসরে হিসাব করে দেখলে দেখা যাবে, সংবাদ শিরোনামের সংখ্যা যা বলে তার চেয়ে বেকারত্বের পরিসংখ্যান বেশি। কারণ, অনেক লোক চাকরি খোঁজা বাদ দিয়ে বসেছে কিংবা যখন তারা পূর্ণাঙ্গ সময়ের কাজ চাইছে তখন তাদের খ-কালীন চাকরি করতে হচ্ছে। জিডিপির অন্যতম প্রধান ত্রুটি হলো গড় ও সমষ্টি নিয়েই এর কারবার। সমষ্টি অসাম্যের তারতম্যকে লুকিয়ে ফেলে। আর গড় হিসাবও আমাদের আদৌ বেশি কিছু বলে না। গুটি কয়েক মন্দার কথা বাদ দিলে বলতে হয় যে, ১৯৫০-এর দশক থেকে মার্কিন অর্থনীতির উর্ধমুখী যাত্রা চলছে। তথাপি পিউ রিসার্চ সেন্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৪ সালে সে দেশে নন ম্যানেজমেন্ট প্রাইভেট সেক্টরের কাজের জন্য ঘণ্টাওয়ারি গড় মজুরি ছিল ২০ দশমিক ৬৭ ডলার। মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয় করলে ১৯৬৪ সালে ওই কাজের মজুরি যা ছিল তার চেয়ে মাত্র ১ দশমিক ৪৯ ডলার বেশি। এ এক বাস্তব সত্য যে, আমেরিকায় সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষ আগের চেয়ে আরও বেশি ধনী হয়েছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আগের চেয়ে আরও গরিব হয়েছে। জিডিপিকে উন্নয়নের ব্যারোমিটার বা মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করার একটা সমস্যা হলো, এটা এই অসাম্যকে আড়াল করে রাখে। ১৯৩০-এর দশকে আমেরিকায় উদ্ভাবিত জিডিপি শব্দটা কারখানা শিল্প যুগের ফসল। ভৌত উৎপাদন পরিমাপে এই মাপকাঠি অতি উত্তম। তবে, আধুনিক অর্থনীতিতে যেখানে সার্ভিসের প্রাধান্য সেখানে সার্ভিসকে পরিমাপ করার উত্তম মাপকাঠি এটা নয়। জিডিপি দিয়ে একটা এলাকার মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার কিংবা ডে কেয়ার সার্ভিসের গুণগত মান পরিমাপ করা সম্ভব নয়। জিডিপি শব্দটি কার্যত উদ্ভাবন করেছিলেন বেলারুশের অর্থনীতিবিদ সিমন কুজনেৎস। নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে তার নিজেরই সন্দেহ ছিল। তিনি এ বিষয়টি পছন্দ করেননি যে, এতে অস্ত্রশস্ত্র ও আর্থিক ফটকাবাজকে ইতিবাচক উৎপাদন হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। সর্বোপরি, তিনি বলেছেন যে- জিডিপিকে সামষ্টিক কল্যাণের সঙ্গে এক করে গুলিয়ে ফেলা চলবে না। কুজনেৎসের এই কথাগুলো ছিল হুঁশিয়ারি যা উপেক্ষা করা হয়েছে। তিন শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ও একাডেমিক ব্যক্তি এতে একমত প্রকাশ করে বলেছেন- জিডিপি একটা দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য পরিমাপের দুর্বল বা ত্রুটিপূর্ণ কৌশল। তাই এ কাজটা করার জন্য এক নতুন কৌশল খুঁজে বের করা প্রয়োজন। তিন অর্থনীতিবিদ হলেনÑ নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ, এমআইটির অধ্যাপক এরিক ব্রাইনিজোলফসন ও আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টিন লাগার্ড। স্টিগলিজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি প্রতিবছরই বাড়ছে। অথচ অধিকাংশ আমেরিকানের আর্থিক অবস্থা ৩০ বছর আগে যা ছিল তার চেয়েও খারাপ। জিডিপি বৃদ্ধির সুফল অতি শীর্ষ ভাগের লোকজনের ঘরে চলে গেছে। সমাজের তলার দিকে যারা আছে তাদের প্রকৃত মজুরি আজকের দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করলে ৬০ বছর আগে তারা যা পেত এখন পায় তার চাইতেও কম। এই অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য হচ্ছে, যে দেশের জিডিপি যত বেশি সেই দেশটির তত বেশি উন্নত হওয়ার কথা। তেমনি আবার, জিডিপি যে দেশের যত কম সেই দেশটির তত অনুন্নত হওয়ার কথা। কিন্তু প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন দুটো দুই ভিন্ন জিনিস। প্রবৃদ্ধি উন্নয়নের নির্দেশক এটা সর্বদা সত্য নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলো মূলত হিসাবরক্ষণের একটা ব্যবস্থা। এর দ্বারা পরিমাপ করে দেখা হয় অর্থনীতিতে কি পরিমাণ অর্থ হাতবদল হচ্ছে। অর্থনীতিতে বাণিজ্যিক লেনদেনের মূল্য ও সংখ্যা বেড়ে গেলে প্রবৃদ্ধি ঘটে। যেমন ধরুন, আপনি বাড়িতে রান্না করছেন, এতে জিডিপি বাড়ে না। কিন্তু আপনি দোকানে বসে খেলে জিডিপি বাড়ে। একইভাবে বাবা-মায়েরা সরাসরি নিজেরা বাড়িতে সন্তান লালন-পালন করলে জিডিপি বাড়ে না। কিন্তু তারা তাদের সন্তানদের ডে কেয়ার সেন্টারে দিলে জিডিপি বাড়ে। কাজেই জিডিপি হচ্ছে অর্থনীতিতে বাণিজ্যিক লেনদেনের সংখ্যা বৃদ্ধির একটা হিসাব মাত্র। এটা সমাজের উন্নয়ন অনুধাবন করার উত্তম কোন ব্যবস্থা নয়। অন্যদিকে উন্নয়ন একটি রাজনৈতিক শব্দ, যার অর্থ এক এক ব্যক্তির কাছে এক এক রকম। একে সংজ্ঞায়িত করার একটা উত্তম উপায় হলো এই যে- উন্নয়নের পরিণতিতে ব্যক্তির জীবনমান বৈষয়িকভাবে, সামাজিকভাবে, মনস্তাত্ত্বিকভাবে, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে বেড়ে যায়। প্রত্যেক ব্যক্তিরই সম্ভাবনাময় ক্ষমতা ও সামর্থ্য থাকে। উন্নয়ন মানুষের সেই সম্ভাবনাময় ক্ষমতা ও সামর্থ্যকে উন্মোচন ও কাজে লাগানোর পথে বাধাগুলো দূর করে দেয়। এই বাধাগুলো হলো দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, অদক্ষতা, অপুষ্টি, স্বাস্থ্যহীনতা, সব রকমের বৈষম্য ইত্যাদি। কাজেই উন্নয়ন বলতে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বোঝায় না। উন্নয়ন বলতে বোঝায় উত্তম সমাজ নির্মাণ। উত্তম সমাজ হলো এসব সমাজ যেখানে মানুষ সমৃদ্ধ, শিক্ষিত, অতিমাত্রায় দক্ষ, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং বৈষম্য ও রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার নয়। তাহলে, প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের মধ্যে সম্পর্ক কি? প্রবৃদ্ধি হচ্ছে উন্নয়ন অর্জনের বেশ কিছু উপায়ের মধ্যে একটি উপায় মাত্র। প্রবৃদ্ধি এককভাবে উন্নয়ন ঘটাতে পারে না। প্রবৃদ্ধি শুধু বৈষয়িক সমৃদ্ধিই আনতে পারে। জিডিপি উৎপাদনশীল ও ধ্বংসকারী ক্রিয়াকলাপের মধ্যে পার্থক্য টানে না। অস্ত্র ও পারমাণবিক সামগ্রীর বিস্তার, ফাস্টফুডের ভোগ ব্যবহার বৃদ্ধি, ক্রেডিট কার্ডের ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধি, শেয়ার বাজারে উর্ধগতি, প্রাকৃতিক সম্পদ নিঃশেষ হওয়া- এগুলোও জিডিপির বৃদ্ধি ঘটাতে অবদান রাখে। জিডিপি ‘সম্পদের’ পরিমাপক মোটেও নয়। জিডিপি হচ্ছে আয়ের পরিমাপক। আগে একটা নির্দিষ্ট সময়ে কি পরিমাণ পণ্য ও সার্ভিস উৎপাদিত হয়েছে তার মূল্যের পরিমাপ করে জিডিপি। সেই একই পরিমাণ পণ্য ও সার্ভিস আগামী বছর উৎপাদন করা যাবে কি না সে সম্পর্কে জিডিপি কিছু বলতে পারে না। তার জন্য ব্যালেন্সশিট অর্থাৎ সম্পদের পরিমাপক দরকার। কোম্পানিগুলোর ব্যালেন্সশিট ও আয়ের বিবরণী থাকে। রাষ্ট্রের থাকে না। তেলের দর চড়া থাকার সময় নাইজিরিয়া চড়া দামে বিশ্ববাজারে তেল বিক্রির কাজে ব্যস্ত ছিল। তখন এ দেশের জিডিপি বাড়ছিল। কিন্তু সম্পদ হ্রাস পাচ্ছিল। কারণ তেলের মজুদ কমে যাচ্ছিল। তেল বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থ ভবিষ্যতের আয় সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে মানবিক, ভৌত ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর কাজে বিনিয়োগ করা হয়নি। তেমনিভাবে আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোর জিডিপি বাড়ছে কিন্তু তাই বলে সর্বক্ষেত্রে সম্পদ বাড়ছে না। তাই জিডিপি একটা দেশের সাফল্যের নির্ভুল মাপকাঠি নয়। সূত্র : ইকোনমিস্ট ও অন্যান্য
×