ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্যসম্মত করা গেলে আছে অপার সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৫:১০, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

স্বাস্থ্যসম্মত করা গেলে আছে অপার সম্ভাবনা

ওয়াজেদ হীরা ॥ বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে রাস্তার খাবার নিয়ে নানা দুশ্চিন্তা বা সমস্যা থাকলেও উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও পথখাবার এক সম্ভাবনার নাম। পরিকল্পিত পদ্ধতি, একটু বাড়তি সচেতনতা আর পরিচ্ছন্ন পরিবেশনের মাধ্যমে দেশের পাশাপাশি বিদেশের মানুষও আকৃষ্ট হবে এই খাবারের দিকে। এছাড়া অর্থনৈতিক পরিবর্তনেও এই স্ট্রিস্ট ফুডের ভূমিকা আরও বাড়তে পারে। সংশ্লিষ্টদের মতে, উন্নত দেশের আদলে উন্নত চিন্তার মাধ্যমেই এই খাবারের সেক্টরকে আরও সম্ভাবনাময় করে তোলা সম্ভব। ‘নিরাপদ খাদ্যে ভরবো দেশ-গড়বো সোনার বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে এ বছরই প্রথম ‘জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস-২০১৮’ পালিত হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য দিবস পালিত হলেও প্রতিদিনের খাদ্য কতটুকুই বা নিরাপদ সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। তবে কর্তৃপক্ষের চেষ্টার ত্রুটি নেই বলেও জানা গেছে। এছাড়াও অর্থনীতিবিদরাও মনে করছেন পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নত খাবার পরিবেশন আর খাবারের মান উন্নয়ন করা গেলে এটি হতে পারে বাংলাদেশের সম্ভাবনা খাতের একটি। রাজধানীর ব্যাংকপাড়া হিসেবে খ্যাত মতিঝিলে কর্মরত জাহিদুল হোসেন একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। দুপুরের খাবার প্রায়ই বাসা থেকে নিয়ে আসেন। তবে যেদিন আনা হয় না সেদিন মাঝে মধ্যেই খান পথের খাবার। এতে করে কয়েকবার পেটের পীড়ায় ভুগে এখন ইতি টেনেছেন এই খাবারে। এই মতিঝিলে অনেক ব্যাংকারই আছেন যাদের হয় বাসা থেকে খাবার আনতে হয় নয়তো উন্নতমানের গলাকাটা দামের খাবার খেতে হয়। যদিও কেউ কেউ পথখাবারও খান। একাধিক ব্যাংকারের মতে, বিদেশের বিভিন্ন দেশে পথেরখাবার আমাদের দেশের উন্নত হোটেলের মতোই মনে হয়। তবে আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা মানের চেয়ে লাভ খোঁজেন বেশি। অবশ্য একাধিক ব্যবসায়ীও এ কথা অস্বীকার করেননি। ফকিরাপুলের এক জুস বিক্রেতা জসিম বলেন, মান ভাল হলে খরচও বেশি হয়ে যায়। সবাই বেশি দামে এই জুস খান না। আমার পাশের দোকানেই যখন কম দামে পাবেন আমার এখানে কেন বেশি দামে খাবেন? তাই খাবারের মান অনেক সময় ঠিক থাকে না বলেও জানান তিনি। এছাড়াও বাংলাদেশে ‘পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯’ রহিত করে জনগণের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা। এছাড়াও খাদ্য উৎপাদন আমদানি অর্থাৎ মাঠের উৎপাদন থেকে ভোক্তার হাত পর্যন্ত সব শৃঙ্খলে সমন্বয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ এবং দক্ষ কার্যকর কর্তৃপক্ষ হিসেবে ২০১৫ সালে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে। জানা গেছে, এই নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বর্তমানে ১৮ মন্ত্রণালয় এবং ৪৮৬ স্থানীয় সরকার সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষও আশা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, একটি নিরাপদ খাদ্যের দেশ হবে বাংলাদেশ। বর্তমান খাদ্য আইনে মানবস্বাস্ব্যের জন্য ক্ষতিকর অথবা বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক দ্রব্য বা এর উপাদান, কীটনাশক বা বালাইনাশক, খাদ্যের রঞ্জক বা সুগন্ধি বা অন্য কোন বিষাক্ত সংযোজন দ্রব্য বা প্রক্রিয়া সহায়ক কোন খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণে ব্যবহার বা অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদ- এবং সর্বোচ্চ দশ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এছাড়াও ভেজাল খাদ্য উৎপাদন বা বিক্রয় বিষয়ে তিন বছর কারাদ- ও সর্বোচ্চ ছয় লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, আসলে এটি একটি বিশাল সেক্টর। মানুষকে সচেতন করতে আমরা ইতোমধ্যেই অনেক কার্যক্রম শেষ করেছি আরও করছি। জেলা পর্যায়ে আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে। তবে এটি একটি কঠিন কাজও বলেন তিনি। বর্তমানে সবশ্রেণী পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে খাবারের মান উন্নয়ন তথা এই খাবারকে কি করে অর্থনৈতিক ভূমিকায় কাজ করানো যায় সে বিষয়েও চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি। খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আরও বলেন, আমাদের ৬৪ জেলায় বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত এবং মেট্রোপলিটন সিটিতে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত রয়েছে। খাদ্য নিরাপদ করতেই এসব নানা কার্যক্রম চালু আছে বলেও জানান তিনি। খাবারের মান বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে ঢাকা মেডিক্যালের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শহীদুল বাশার জনকণ্ঠকে, পারিবারিকভাবে ছোটবেলা থেকেই পরিচ্ছন্ন খাবারের প্রতি শিশুদের আগ্রহী করতে হবে। তাহলে নোংরা খাবার এক সময় উঠে যাবে আর পরিচ্ছন্ন খাবারের পরিবেশ তৈরি হবে। এদিকে, অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন এই পথ খাবারও একটি বড় সেক্টর অর্থনীতিতে। মানুষের আগ্রহও আছে আরও আগ্রহ তৈরি করতে হবে। অর্থনীতিবিদ ও পিকেএসএফ চেয়ারম্যান ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, মানুষ এই খাবারটি এখন বাধ্য হয়ে খায়। মানুষকে বোঝাতে হবে এটি ক্ষতিকর। নোংরা অবস্থা থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আনতে হবে। পথখাবার নোংরা হলেও এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত। এই খাতে অর্থনৈতিক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা যায়। এক্ষেত্রে আমার, গণমাধ্যম, ব্যবসায়ী সবার ভূমিকাই প্রয়োজন। পিকেএসএফ চেয়ারম্যান আরও বলেন, মানুষকে বিষয়টি নিয়ে অনেক বোঝাতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আনতে হবে। থাইল্যান্ডের উদাহরণ দিয়ে বলেন, থাইল্যান্ডে সকালে কেউ বাসায় খায় না। অফিসের নিচে সবাই লাইন দিয়ে কার্ড নিয়ে আসে এবং খায়। আমাদের দেশেও এটি হতে পারত। এটি সম্ভব তখনই যখন এটিতে পরিবর্তন আনা যাবে। আর তখনই এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক ড. নাজমা বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দেশের মানুষ যে হারে এই খাবার খায় তাতে নিঃসন্দেহে এটি সম্ভাবনাময় শুধু নয়, উজ্জ্বল সম্ভাবনাময়। বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক নারীরা কাজ করছে। তাই নারীদের বাসায় কাজ করার সময় কমে গেছে। সেই সঙ্গে বাইরের খাবারের চাহিদাও বেড়েছে। একই সঙ্গে এই খাবারের ক্রেতা কিন্তু সব শ্রেণীই। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা। তাই তাদের স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখার পরামর্শ দেন তিনি। একই সঙ্গে অধ্যাপক ড. নাজমা বেগম বলেন, আগামীতে মানুষের আরও কর্মসংস্থান বাড়বে। এই খাবারের আরও গুরুত্ব বাড়বে। তাই যারা কিনবে এবং বিক্রি করবে দুজনেরই সচেতনতা বাড়াতে হবে সেই সঙ্গে বিষয়গুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণও করতে হবে। এই খাত আরও উন্নত করতে সরকার ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থাও করতে পারেন আর্থিক এবং পারিপার্শিক উভয়ভাবে দেখভাল করার পরামর্শও দেন অর্থনীতির এই অধ্যাপক। প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে রাজধানীতে মানুষ আসছে। সেই সঙ্গে এই খাবারের চাহিদাও বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ একটু অল্পমূল্যের খাবারের পেছনেই ছুটে। পরবর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভাবার সময়ও নেই ব্যস্ত শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের অধ্যাপক মুনীরউদ্দিন আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, রাজধানী ঢাকায় প্রায় ৬০ লাখের ওপর মানুষ স্ট্রিট ফুড বা রাস্তার খাবার খায়। স্বল্পমূল্য ও মুখরোচক বলে এ ধরনের খাবার জনপ্রিয়। একই সঙ্গে অর্থনীতির বিকাশে অবদান রাখছে। যে কোন দেশের পর্যটনের বিকাশে সে দেশের স্ট্রিট ফুড ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। সাশ্রয়ী হওয়ায় বিশ্বজুড়েই পর্যটকরা রকমারি খাবারের স্বাদ নিতে স্ট্রিট ফুড বেছে নেয় বলেও জানান তিনি। বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে বলেন, জাপানের টোকিও, মরক্কোর মারাকেশ, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, চীনের পেচিং, ইন্দোনেশিয়ার বালি, থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্কক, ভারতের মুম্বাই ও কলকাতার স্ট্রিট ফুড বা পথখাবার এসব দেশের তো বটেই, বাইরে থেকে সেখানে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদেরও অন্যতম আকর্ষণ। বিদেশের মতো বাংলাদেশে স্ট্রিট ফুডের অনেক পার্থক্য। তাই দেশের খাবারের মান বাড়ানোর পরামর্শও দেন। পথখাবার বন্ধ করা যাবে না উল্লেখ করে অধ্যাপক মুনীরউদ্দিন আহমদ বলেন, রাস্তার খাবার উপেক্ষা করা বা বন্ধ করা যাবে না। যতই খারাপ বা অস্বাস্থ্যকর হোক তা এ দেশের মানুষ তা খাবে। এসব খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে জানা সত্ত্বেও মানুষ রাস্তার খাবার খাবে। এটা এ দেশের মানুষের অভ্যাস ও সংস্কৃতির অঙ্গ। এসব খাবার তৈরি ও পরিবেশন যাতে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে হয়, সেদিকে এখন দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, রাজধানীসহ পর্যটন এরিয়ার পথখাবারগুলোর মান উন্নয়ন দরকার। নিজেদের প্রয়োজনেই দরকার। আমরা সুস্থ থাকব, মানুষের ব্যবসাটাও ভাল হবে অর্থনৈতিক উন্নয়নও হবে। এখন যাদের এই খাবারের আগ্রহ নেই সেসব শ্রেণীর মধ্যেই আগ্রহ তৈরি হবে যদি পরিবেশন বা মানটা ভাল হয়। তবে পর্যটন এলাকায় এখনই অধিক গুরুত্ব দেয়ার কথাও বলেন তিনি। পুষ্টিবিজ্ঞানীরাও এই খাবার উন্নত করার পক্ষে মতো দিয়েছেন। অর্থনীতিবিদ, পুষ্টিবিজ্ঞানী কিংবা সমাজকর্র্মী সবাই কম বেশি পরামর্শ দিয়েছেন এই পথখাবার উন্নত করে এই সম্ভাবনাময় খাতকে আরও এগিয়ে নিতে। তার মধ্যে একাধিকবার এসেছে সচেতনতা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি।
×