ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ॥ বিমানে যুক্তরাজ্যে সরাসরি কার্গো পরিবহন

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ॥ বিমানে যুক্তরাজ্যে সরাসরি কার্গো পরিবহন

আজাদ সুলায়মান ॥ কোন ধরনের শর্ত ছাড়াই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি আকাশপথে পণ্য পরিবহনে (কার্গো) নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করল যুক্তরাজ্য। রবিবার দুপুরে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এবং বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশন যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেয়। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল ও ব্রিটিশ হাইকমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনে যৌথভাবে এ ঘোষণা দেন। যুক্তরাজ্যের এ সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশের অন্যতম অর্জন ও কূটনীতিক সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর ফলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ইচ্ছে করলে- আজ থেকেই লন্ডনে সরাসরি কার্গো ফ্লাইট চালু করার ক্ষেত্রে আর কোন বাধা রইল না। তবে অন্য এসিসি-৩ এর মেয়াদ নবায়ন না করা পর্যন্ত শীঘ্রই বিমান কার্গো ফ্লাইট চালু করছে না। দীর্ঘ দুই বছর পর আবার লন্ডনে সরাসরি ফ্লাইট চালু করার সুযোগে লোকসানের ধারা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে বিমান। এতে বাংলাদেশের এভিয়েশন সেক্টরের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা উজ্জ্বল। এ সংবাদ সম্মেলনে বিমানমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল বলেন, গত দুই বছর ধরে কার্গো নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মন্ত্রণালয়, সিভিল এভিয়েশন, বিমানসহ বিভিন্ন সংস্থার আন্তরিক সহযোগিতায় সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় যুক্তরাজ্য সন্তোষ প্রকাশ করে এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার এলিসন ব্লেকও বর্তমান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে কিছু শর্ত দেয়া হয়েছিল। সেগুলো বাস্তবায়িত হওয়ায় আমরা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলাম। যুক্তরাজ্য তাদের এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়ায় অস্ট্রেলিয়াও তাদের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবে, এমনটা আশা করা যায়। বিমানমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল বলেন, নিষেধাজ্ঞার সময় যুক্তরাজ্য সরকার নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে কিছু জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করে। এর আলোকে সরকার রেড লাইন নামে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একটি এভিয়েশন সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানকে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেয়। ওই প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় বেবিচক শাহজালালে সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য ইউরোপীয় মানদ-ের আলোকে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও চালু করে। রফতানি কার্গো কমপ্লেক্সটি ইউরোপীয় মানে উন্নীত করার জন্য কার্গো স্ক্রিনিং সার্টিফিকেশন প্রশিক্ষণ চালু করা হয়। রফতানি কার্গোতে বর্তমানে তিন স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। বর্তমানে শাহজালালে কার্গো পণ্য স্ক্রিনিংয়ে এ্যাভসেক ও বিজিবির ডগ স্কোয়াড কাজ করছে। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন দিয়েও ডগ স্কোয়াড নামানো হয়েছে। সর্বশেষ সংযোজন করা হয় অত্যাধুনিক এক্সপ্লোাসিভ ডিটেকশন সিস্টেম (ইডিএস)। তাতে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন যতগুলো শর্ত দিয়েছিল সব শর্ত পূরণ হয়। তিনি বলেন, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন ইউরোপ-আমেরিকা মানের। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিটিশ হাইকমিশনার এ্যালিসন ব্লেক বলেন, ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, কারিগরি (টেকনিক্যাল) বিষয়। নিরাপত্তার বিষয়ে কোন শর্ত নেই। তবে এটি নিয়মিত নজরদারির (মনিটরিং) আওতায় থাকবে। এ নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশের অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে বিশেষ করে বিমানের, সেটা বিবেচনায় নিয়ে কোন ধরনের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি যুক্তরাজ্য বিবেচনা করবে কিনা দৈনিক জনকণ্ঠের এমন এক প্রশ্নের জবাবে হাইকমিশনার এ্যালিসন ব্লেক বলেন, ইতোমধ্যে আমি বলেছি কোন পরিস্থিতিতে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। কাজেই ক্ষতিপূরণের সম্ভাবনা নেই। এ সময় ব্রিটিশ হাইকমিশনার বলেন, কঠোর পরিশ্রম ও দুই দেশের আন্তরিক সহযোগিতার কারণেই সমস্যা চিহ্নিত করে সেখান থেকে উত্তরণ সম্ভব হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশ সরকার বিশেষ করে সাবেক বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের আন্তরিক প্রচেষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ব্লেক বলেন, নিষেধাজ্ঞা দেয়া বা প্রত্যাহার কোনটাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল না। সম্পূর্ণ নিরাপত্তার কারণেই এটা করা হয়েছিল। নিরাপত্তার অজুহাতে ২০১৬ সালের মার্চে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাজ্য তার দেশে সরাসরি কার্গো পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাজ্যের পর অস্ট্রেলিয়া পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশও নৌ ও আকাশপথে সরাসরি কার্গো পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইইউ’র টিম বাংলাদেশকে সরাসরি কার্গো রফতানির ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। জানা গেছে, ২০১৬ সাল থেকে নিষেধাজ্ঞার ফলে বছরে বিমানে ৩০ হাজার ৪০০ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হুমকির মুখে পড়েছিল। ব্যাহত হয়েছিল দেশের ভাবমূর্তি। ধস নেমেছিল বিমানের কার্গো ব্যবসায়। তবে এতদিন অন্য দেশের মাধ্যমে রি-স্ক্যানিং করে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয় কার্গো রফতানি অব্যাহত ছিল। এ অবস্থায় ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন দুদিনের সফরে গত ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন। সফরকালে তিনি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত না দিলেও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য সিভিল এভিয়েশনকে ডিএফটি যেসব শর্ত দিয়েছিল- তার সব শর্ত বাংলাদেশ পূরণ করেছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তবে যুক্তরাজ্যকে সন্তুষ্ট করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় তৎপর ছিল সিভিল এভিয়েশন। বেবিচকের মেম্বার অপারেশন এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী টিম গত দুবছর ধরে এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। সাবেক বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেননও এ নিয়ে দুদেশের মধ্যে ব্যাপক কূটনৈতিক সংলাপ ও দেনদরবার করেন। সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান দায়িত্ব নিয়েই বিমানের সরাসরি কার্গো পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তিনি এ নিয়ে মাঠে নামেন। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে বছরে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলারের (১ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা) পণ্য রফতানি হচ্ছে। যার বড় অংশ হচ্ছে তৈরি পোশাক। এর মধ্যে বিমানে পরিবহন করা হয় ১৮-২০ শতাংশ। টাকার হিসাবে এর পরিমাণ ৩০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। প্রথম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র আর দ্বিতীয় স্থানে আছে ইইউ। এ বিষয়ে এয়ার কমোডর মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, দীর্ঘ দুই বছর পর এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আগে সিভিল এভিয়েশনকে অনেক খড়কুটো পোড়াতে হয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রতিটি পর্যবেক্ষণ বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেনি বেবিচক। কার্গো রফতানি কার্গো উড়োজাহাজের নিরাপদ চলাচলের জন্য যথাপোযুক্ত ম্যানুয়েল, এসওপি, প্রটোকল, এবং কার্গোতে কর্মরত সব জনবলের জন্য চার্টার অব ডিউটিজ তৈরি করা হয়েছে যা আন্তজার্তিক মানে। এসব কাজ চলমান থাকার পরও গত জুনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে ইউরোপগামী সব এয়ার কার্গো ও মেন কনসাইনমেন্টকে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। এটা উত্তরণের জন্য ইডিএস ও ইডিডি স্থাপনের পর কার্গো স্ক্যানিং করার জন্য সুপারিশ করে। এবং বেবিচক সে শর্তও পূরণ করে। এসব স্থাপনের পর ইইউ তাদের এসিসি-৩ এর ভেলিডেশান সম্পন্ন করে। এবং সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় সন্তুষ্ট প্রকাশ করে। এ ছাড়া গত সেপ্টেম্বরে আইকাও কর্তৃক পরিচালিত ভেলিডেশান মিশনে বাংলাদেশ শতকরা ৭৭ দশমিক ৪৬ ভাগ অর্জন করে যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। উল্লেখ্য নিরাপত্তার অজুহাতে ২০১৬ সালের মার্চে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাজ্য তার দেশে সরাসরি কার্গো পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাজ্যের পর অস্ট্রেলিয়া পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশও নৌ ও আকাশপথে সরাসরি কার্গো পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইইউর টিম বাংলাদেশকে সরাসরি কার্গো রফতানির ক্ষেত্রে উচমাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এ সময় বিমান সচিব এসএম গোলাম ফারক, সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাইম হাসান, মেম্বার অপারেশন এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান, পরিচালক শাহজালাল গ্রুপ ক্যাপ্টেন ইকবাল করিম, পরিচালক ফ্লাইট সেফটি এ্যান্ড রেগুলেশান উইং কমান্ডার চৌধুরী জিয়াউল কবীর, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এমডি ক্যাপ্টেন অব. মোসাদ্দিক আহম্মেদ, এভিয়েশন কনসালটেন্ট নিয়াজ আহমেদ ও রেড লাইন সিকিউরিটির শীর্ষ কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
×