ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপি কোন্ পথ বেছে নেবে? -ওয়াহিদ নবি

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বিএনপি কোন্ পথ বেছে নেবে? -ওয়াহিদ নবি

‘কয়লা ধুলে ময়লা যায় না’। অমার্জিত ভাষায় বা কেউ বলবেন কর্কশ ভাষায় বলা হয়েছে যে, কারও স্বভাবের পরিবর্তন হয় না। অনেকেই কথাটি বিশ্বাস করেন না। উদাহরণ হিসেবে তারা বলবেন বাল্মীকির তো স্বভাব পরিবর্তিত হয়েছিল। কিন্তু কথা হচ্ছে, বাল্মীকি আর ক’জন! বাংলাদেশে নির্বাচন আসি আসি করছে। এই বছরের শেষ দিকে অথবা আগামী বছরের শুরুতেই নির্বাচন হয়ে যাবে। নির্বাচন আসছে মনে করে বিএনপি নেতৃবৃন্দ নির্বাচন সম্পর্কে তাদের বক্তব্য বলতে শুরু করলেন। তারা বললেন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। বেগম জিয়া ঘোষণা দিলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচন হতে পারে না। নির্বাচিত দলের নেতৃবৃন্দের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশে। বাংলাদেশেও তাই হবে এমনটাই সবাই আশা করে। কিন্তু সমস্যা হছে এই যে, এখানে নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল এবং এমনটা ঘটেছিল আওয়ামী লীগের দাবিতে। বিএনপি সমর্থকরা হয়তো ভাবেন, যদি আওয়ামী লীগের দাবিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়ে থাকে তবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে গত ’৯৬ সালের নির্বাচনের পটভূমি জানতে হবে। আজ যাদের ২০ বছর বয়স ’৯৬-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাদের জন্মের আগে। মানুষ ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা করে তার নিজের উৎসাহের ওপর নির্ভর করে। মাগুরার নির্বাচনের ঘটনাবলীর কথা স্মরণ করলেই বুঝা যায় কেন সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়েছিল। এরপর আর তেমন ঘটনা ঘটেনি। আওয়ামী লীগ সরকারের সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে সেসব পরিষ্কার হয়েছিল। কাজেই গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়, সে পদ্ধতিতে নির্বাচন হতে বাংলাদেশে আর কোন বাধা রইল না। কিন্তু বিএনপি সমর্থকদের মনে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের প্রতি একটা সন্দেহ থাকবে সেটি স্বাভাবিক। তারা নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। বিএনপি দাবি করে বসল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ সেটা দিতে অস্বীকার করে বসল। দুটি দল একে ওপরের মুখোমুখি হলো। বিএনপি ও জামায়াত সমর্থকরা ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হলো। ভাঙচুর ও অগ্নিকা-ে নিয়োগ করল নিজেদের। কোথাও কোথাও রেললাইন উপড়ানো এবং রেলে অগ্নিসংযোগে মন দিল তারা। উপায়ান্ত না দেখে শান্তিরক্ষা বাহিনী উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। প্রায় চারশত মানুষ প্রাণ হারায়। বিএনপি জোট নির্বাচন বয়কট করায় আওয়ামী লীগ জোট সংসদে বিপুলসংখ্যক আসনে জয়লাভ করে। বিএনপি জামায়াত জোট প্রতিবাদ জানাবার ধ্বংসাত্মক পন্থা অবলম্বন করলে বহু মানুষ প্রাণ হারায়। তাদের কার্যকলাপে ভারত তাদের নীতির দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করে। একদিকে তারা অবিরল ভারতের নিন্দা করে থাকে, অন্যদিকে তারা নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাত পাবার জন্য হন্যে হয়ে পড়ল। শেষপর্যন্ত মোদির সাক্ষাত পেলে মোদি খালেদা জিয়াকে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন যা খালেদা জিয়ার জন্য ছিল এম্বেরাসিং। কয়লার বিশেষত্ব প্রসঙ্গে বিএনপির জন্ম। ’৭৫ সালের ১৫ ও তাদের প্রথম দিকের কার্যকলাপ সম্পর্কে এটি সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল সেনা কর্মচারীর হাতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রায় সব সদস্য-সদস্যা নিহত হন। নবেম্বর মাস পর্যন্ত অদ্ভুত সরকার চলে। ক্যান্টনমেন্টে একটি সরকার আর প্রেসিডেন্ট চ্যবনে আর একটি সরকার। ৭ নবেম্বর ঘটে আর একটি ঘটনা। বলা হয় সেদিন সিপাহী-জনতার মিলিত অভ্যুত্থান ঘটে। আসলে জনতার সেখানে সামান্যই ভূমিকা ছিল। কোন কোন সেনাকর্তার কয়েকজন সিভিলিয়ন অনুসারী ছিল মাত্র। এই অভ্যুত্থানে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে তিনি ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন সরকারী টাকা ও সরকারী সংগঠনের সাহায্যে। সেনাবাহিনীর ভিতরে চরম নিষ্ঠুরতা চলতে থাকে। প্রায় ২০টির মতো অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা চলে সেসময়। সমস্ত ঘটনাটি সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানের গতানুগতিক ইতিহাস। ক্যু সম্বন্ধে আজকাল অনেক বক্তব্যই পাওয়া যায়। সেগুলো পড়লেই লেখকের কাছে সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। আইয়ুব খানের রাজত্ব আমরা দেখেছি। সেনাকর্তারা প্রথমদিকে জনপ্রিয় থাকেন। এর কি কারণ, সেটা আমাদের বুঝবার চেষ্টা করা উচিত। একজন সেনাশাসকের শাসনকালের প্রথম দিক চলে দমননীতি। তার পক্ষে চলে একতরফা প্রচার। তার বিরুদ্ধে কিছুই বলবার অনুমতি দেয়া হয় না। আর বিরতিহীনভাবে বলা হতে থেকে, যে তিনি ক্ষমতা চান না, দেশটা একটু ভাল হয়ে এলেই তিনি ক্ষমতা ফেরত দেবেন। কিন্তু এমনটা আর হয়ে উঠে না। জিয়াউর রহমানের আমলে চলে তার সততার প্রচার। তার ভাঙ্গাবাক্স আর ছেড়া গেঞ্জির গল্প শুনতে হয়েছে? ঠিক যখন নির্বাচন ঘনিয়ে এলো তখন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ হলো। বিচারে তার পাঁচ বছরের জেল হলো। কোন কোন বিএনপি নেতা কাঁদলেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, ‘তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন কি? সমর্থকরা মিছিল করেছে। কিন্তু খুব একটা জমেনি। আগের চেয়ে তার সমর্থক বেশি। জয়লাভের সম্ভাবনা না থাকলে তারা আহত বা নিহত হবার ঝুঁকি নিতে যাবে না। এদিকে নির্বাচন আসছে নির্বাচন বয়কটের অভিজ্ঞতা বিএনপির আছে। এবার নির্বাচন বয়কট করলে বিএনপিই ক্ষমতার বাইরেই থেকে যাবে। এতে করে দলে বিদ্রোহ দেখা দেবার সম্ভাবনা। এতসব চিন্তা করেই বিএনপিকে তার পথ বেছে নিতে হবে। লেখক : রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের একজন ফেলো.
×