ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফাতেমার কৃতিত্ব

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ফাতেমার কৃতিত্ব

হতদরিদ্র সংসারে জন্ম নেয়া ফাতেমা মাত্র ৯ বছর বয়সে মা-বাবাকে ছেড়ে চলে আসে অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে। যে সময় কোন শিশু তার পিতা-মাতার স্নেহছায়ায় বড় হয়ে প্রাথমিক শিক্ষার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছার শুভ সূচনা করে। কৃষিনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির শৃঙ্খলে বাঁধা সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর জীবন আর কর্মপ্রবাহের যে সাংঘর্ষিক অবস্থা সেখানে সন্তানের লেখাপড়ার কথা ভাবাও এক রকম বিলাসিতা। ছেলেমেয়ের প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে গিয়েও বাবা-মাকে হিমশিম খেতে হয়। ফলে সন্তানকে নিজের কাছে রাখাও এক রকম অসম্ভব হয়ে পড়ে। পারিবারিক এমন বিপন্ন অবস্থার শিকার ফাতেমাকে এক সময় অন্যের বাসায় গিয়ে গৃহশ্রমে নিযুক্ত হতে হয়। সেখানে দুই বছর তাকে থাকতে হয় স্বল্প মজুরিতে। মাত্র ১১ বছর বয়সে তাকে নিজ গ্রামে নিয়ে আসা হয় বিয়ে দেয়ার জন্য। মা-বাবাই পারিবারিকভাবে এই বিয়ের বন্দোবস্ত করে। আবারও সামাজিক অভিশাপের কোপানলে পড়া! বাল্যবিয়ের মতো একটি দুঃসহ অবস্থাকে মোকাবেলা করতে গিয়ে ফাতেমা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। কিন্তু এক অবোধ গ্রাম্য বালিকা নিজের একার সিদ্ধান্তে এত বড় একটা আয়োজন বানচাল করতে পারে সে শক্তি তার আসলে ছিল না। কিন্তু সেই দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়ায় কুমার বিশ্বজিত বর্মণের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘আশার আলো পাঠশালা।’ এই মহৎ প্রতিষ্ঠান শুধু যে তাকে বাল্য বিয়ের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি দিল তা কিন্তু নয়, পাশাপাশি তার শিক্ষাকার্যক্রমেরও যাবতীয় দায়-দায়িত্ব বহন করতে এগিয়ে এলো। প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা তো ছিলই, তার চেয়েও বেশি ছিল ফাতেমার নিজের অদম্য সাহস। পিএসসি এবং জেএসসিতে এ-প্লাস পেয়ে ফাতেমা শিক্ষাজীবনে তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে। বুদ্ধিমতী ও মেধাবী ফাতেমার নজর গিয়ে পড়ে বিকাশমান তথ্য প্রযুক্তির বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলের প্রতি। সেই লক্ষ্যে ডিজিটাল স্কিল কোর্সে নিজেকে সম্পৃক্ত করে সে। লেখাপড়ার জগতে পা দিয়েই সে বুঝতে পারে আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তির ছোঁয়া পেতে গেলে ইংরেজী ভাষায় দখল থাকা অত্যন্ত জরুরী। সেখানেও তার মেধা ও মননের বিকাশ হতে সময় লাগেনি। এক সময়ে ইংরেজীতে পারদর্শী ফাতেমা আশার আলো প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ‘ইয়ং বাংলা আইসিটি’ প্রশিক্ষণ নিয়ে মাইক্রোসফটে দক্ষতা অর্জন করে। এরপর শুধুই সামনের দিকে তাকানো। এক সময় মাইক্রোসফট বাংলাদেশ তাকে তাদের ব্র্যান্ড এ্যাম্বাসেডর মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। ফাতেমা মনে করে সুযোগ-সুবিধা পেলে সবাই সব বিষয়ে পারদর্শী হয়ে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারে। তার আন্তরিক ইচ্ছা সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য সাধ্যমতো সবরকম প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো শক্তি অন্য কিছুতে নেই। সেই শক্তি হতভাগ্য কিশোরীদের স্বাবলম্বী জীবনের নিশ্চিত চাবিকাঠি। ফাতেমাকে এই পর্যায়ে আসতে তথ্যপ্রযুক্তির যে গুরুত্বপূর্ণ সূচক তা পার হয়ে আসতে হয়েছে। বর্তমানে ফাতেমা পিছিয়ে পড়া মেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ করার আন্তরিক লক্ষ্যে তাদের ডিজিটাল দক্ষতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার রামখাশ ইউনিয়নের নাখারগঞ্জের ‘আশার আলো পাঠশালার’ আইটি ল্যাবটি মাইক্রোসফট বাংলাদেশের অনুদানে পরিচালিত। সারাদেশে আটটি ল্যাব এই ‘মাইক্রোসফট বাংলাদেশের’ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। সেখানে সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের তথ্যপ্রযুক্তিতে যুক্ত করে বিশেষভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে। আশার আলো পাঠশালার অধীনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে অসহায় এবং পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের প্রয়োজনীয় সমস্ত সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। ৬৫ জন মেয়ের বাল্যবিয়ে ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। এই ধরনের কার্যক্রম আরও বাড়াতে পারলে ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরিতে তা সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে।
×