ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গডফাদারদের ছত্রছায়ায় বিপথগামী হচ্ছে কম বয়সীরা

চট্টগ্রাম মহানগরীতে শিশু-কিশোর সন্ত্রাসী গ্যাং বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

চট্টগ্রাম মহানগরীতে শিশু-কিশোর সন্ত্রাসী গ্যাং বাড়ছে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বন্দর নগরী চট্টগ্রামে শিশু ও কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন এলাকায় গঠিত হয়েছে এক শ্রেণীর যুবকদের সশস্ত্র গ্যাং। এদের অনেকেই অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের সন্তান। চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য এলাকার মধ্যে শাহ আমানত ব্রিজ, টোল রোড, এয়ারপোর্ট রোড, অক্সিজেন অনন্য এলাকা, সিআরবি এলাকা, ফিরিঙ্গীবাজার থেকে মেরিনার্স রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় স্বল্প বয়সী তরুণদের গ্যাং বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। গত শুক্রবার এ ধরনের শিশু ও কিশোর বয়সী গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়েছে সিএমপির এএসআই আবদুল মালেক। রাতে গ্রেফতার হয়েছে দুই কিশোর। এরা দু’জনই এসএসসি পরীক্ষার্থী এবং নগরীর নামী-দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র এরা। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এলাকায় এরা নিজেদের এক ধরনের ত্রাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে উন্মুখ। সিনিয়র, জুনিয়র সন্ত্রাসীদের পর এদের অবস্থান। চট্টগ্রামে শিশু-কিশোরদের গ্যাং সৃষ্টি কেন বেড়েই চলেছে তা নিয়ে পুলিশ বা অন্যান্য কোন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকৃত কোন তথ্য মিলেনি। তবে এসব গ্যাং যে সৃষ্টি হচ্ছে তা স্বীকার করছে। সমাজের অন্যান্য অভিজ্ঞ সূত্রগুলো বলছে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে বর্তমানে ১৬ থানা রয়েছে। ওই ১৬ থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সঙ্গে রয়েছেন একজন তদন্ত কর্মকর্তা। এ দুটি পদই পরিদর্শকের। এছাড়া এদের নিয়ন্ত্রণ করছেন একজন কমিশনার, ৪ জোন ডিসি, ৩ এডিসি, ৮ এসি। এছাড়া রয়েছে গোয়েন্দা বিভাগ। এ বিভাগে নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন ২ ডিসি, ৪ এডিসি। এছাড়া রয়েছেন প্রয়োজনীয় সংখ্যক পরিদর্শক, উপ-পরিদর্শকসহ অন্যরা। অভিযোগ রয়েছে, সিএমপিতে গত ৫ বছরে কোন উদ্ধার অভিযান হয়নি। এছাড়া গডফাদারসহ সন্ত্রাসীদের কোন তালিকাও হালনাগাদ নেই। রাজনৈতিক ব্যানার ছাড়াও এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন নামে সন্ত্রাসী কর্মকা- কেবলই বেড়ে চলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ কি করছে। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, দেশের এই দ্বিতীয় বৃহত্তম মহানগরীতে পুলিশের বিভিন্ন পদে পোস্টিং পাওয়া কঠিন। মোটা অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করতে হয় পোস্টিং পেতে। আরও অভিযোগ রয়েছে, এ নগরীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পোস্টিং নিতে একজন পরিদর্শককে অর্ধলক্ষ টাকাও বিনিয়োগ করতে হয়। এর পরের অবশিষ্ট ১৫ থানায় গুরুত্ব অনুসারে অর্থ দিয়ে পোস্টিং পেতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় উপ-পরিদর্শক ও সহকারী উপ-পরিদর্শকদেরও অর্থ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ থানাগুলোতে পোস্টিং নিতে হয়। এদের মধ্যে অনেক পুলিশ অফিসার রয়েছেন যারা এলাকাও চিনেন না। সন্ত্রাসী চেনা তো দূরের কথা। তারা নির্দিষ্ট কিছু সোর্সের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। কোন ঘটনা ঘটলেই সোর্সের পরামর্শ অনুযায়ী অভিযান চালান। এতে প্রকৃত কিছু সন্ত্রাসী মাঝে মাঝে ধরা পড়লেও অনেকেই পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আর রাজনৈতিক দলীয় গডফাদারদের আশীর্বাদ থাকলে ওই সব সন্ত্রাসীদের কেশাঘ্র স্পর্শ করাও কঠিন হয়ে যায়। পুলিশ সূত্রে এসব কথা সাধারণত প্রকাশ করা হয় না। যারা জানেন, তারা মুখে কুলুপ এটে থাকেন। কারণ চাকরি রক্ষা নিয়ে বিপদ থাকে সর্বক্ষণ। সূত্রে জানায়, পুলিশ ছাড়া দেশ যেমন এক মুহূর্তও চলবে না। তেমনি পুলিশের এই অনেক অসাধু সদস্য সন্ত্রাসী, মাদক, পাচারকারী, চোরাচালানীসহ বিভিন্ন গ্যাংস্টার গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে অনৈতিক পথে বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলছেন। বিভিন্ন অপরাধে পুলিশ সদস্যদের বড় ধরনের কোন শাস্তি হয়েছে এমন রেকর্ড চট্টগ্রামে নেই। বড় বড় কর্তা ব্যক্তিরা অফিসে বসে তদারকির কাজ চালিয়ে যান। দাবড়ে বেড়ান অধীনস্তদের। মূল চাপটি থাকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ওপর। ফলে উপরস্ত কর্মকর্তাদের বশে রাখতে তারা যার যার প্রয়োজন তা দিয়ে সন্তুষ্ট রাখেন। চট্টগ্রামে জনসংখ্যার সঠিক পরিসংখ্যান এখনও নেই। কেউ বলেন ৫০ আর কেউ বলেন ৬০ লাখ। যদি ৬০ লাখ ধরা হয় তাহলে প্রতি ১১শ’ মানুষের বিপরীতে পুলিশের সংখ্যা মাত্র ১ জন। আবার এসব পুলিশের মধ্যে অনেকের নির্ধারিত বিভিন্ন পয়েন্টে নিয়োগ থাকে। এছাড়া মন্ত্রীসহ দেশী-বিদেশী ভিআইপিদের নিয়েও থাকে পুলিশের একটি অংশের নিয়মিত স্কট দিয়ে আনা নেয়ার দায়িত্ব। অভিযোগ রয়েছে, সন্ত্রাসীদের সিনিয়ররা বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্যে এখন একটি অবস্থান করে নিয়েছে। পরেরগুলোও দলগত ও ব্যবসা বাণিজ্য সংহত করতে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত। এর পরেরগুলো শিশু-কিশোর বয়সী। এরা ব্যবসা-বাণিজ্যে নেই। আছে নিজেদের গ্যাং স্টারের সদস্য হিসেবে পরিচিতি করার তৎপরতায়। এদের হাতে চলে গেছে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র। অনেকে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক আসক্তও বটে। এতে দরিদ্র শ্রেণীর শিশু-কিশোরের চেয়েও অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের সদস্য সংখ্যায় বেশি। এক কথায় বিপরীত পক্ষকে ঘায়েল করা, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, খুন-খারাবি করে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়াসহ বিভিন্ন অপকর্ম নিয়ে এরা এগিয়ে যাচ্ছে। এদের মধ্যে যারা সিনিয়রদের চোখে পড়ে তাদের টেনে নেয়া হয়। ফলে এ শিশু-কিশোরদের মধ্যে সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটনা একটি প্রতিযোগিতাও রয়েছে। পুলিশের একজন শীর্ষ স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তা এ বিষয়ে শনিবার জানিয়েছেন, নগরীর প্রতিটি মানুষকে পাহারা দেয়া পুলিশ বিভাগের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রতিটি পরিবারকেও দেখতে হবে তাদের সন্তানরা কি করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, স্কুল-কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত যাচ্ছে কিনা। আর পড়ালেখাতে তারা নিয়ম অনুযায়ী অগ্রসর হচ্ছে কিনা। এ বিষয়ে যেসব পরিবার অনাগ্রাহী তাদের সন্তানদের অধিকাংশ বিপদগামী হচ্ছে। শুধু একা পুলিশের পক্ষে সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে। এর আগে চট্টগ্রামে কলেজিয়েট স্কুলের যে ছাত্রটি খুন হয় তাও শিশু-কিশোর গ্যাং সদস্যদের হাতে ঘটেছে। শুক্রবার ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকায় চেকপোস্টে যাদের তল্লাশি করা হচ্ছিল এরা কোতোয়ালি এলাকায় একটি খুনের পরিকল্পনা নিয়ে অস্ত্রসহ যাচ্ছিল বলে পুলিশ সূত্রে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। কিন্তু পাঁচলাইশ থানার এএসআই আবদুল মালেক চেকপোস্টে তল্লাশি চলাকালীন মোটরসাইকেল আরোহী সন্ত্রাসীরা কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ ওই এএসআই আশঙ্কামুক্ত রয়েছেন। কেন পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করা হলো এর উত্তরে জানা গেছে, মোটরসাইকেল আরোহী ওই সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র ছিল। তল্লাশিতে ধরা পড়ার আগেই গুলি করে পালিয়ে যায়। পরে এদের মধ্যে রাতেই দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের বয়স ১৫-২০ বছরের মধ্যে। বিভিন্ন সূত্রে আরও জানা গেছে, এলাকাভিত্তিক এসব শিশু-কিশোর বয়সীরা মোটরসাইকেল নিয়ে অধিকাংশ সময় শোডাউন দিয়ে থাকে। শোডাউন দিয়ে তারা তাদের শক্তির মহড়ায় প্রদর্শন করে থাকে। অন্য গ্রুপের সঙ্গে যে কোন ঘটনা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা মনোমালিন্য সৃষ্টি হলে এরা অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করছে না। এতে করে অপরাধ জগতে তাদের কদর আরও বেড়ে যায়। এলাকাভিত্তিক নিয়ন্ত্রণকারী গডফাদাররা এদের নিজ কক্ষে টেনে নেয়। ফলে এরা শীর্ষ স্থানীয় বা মাঝারি গোছরের গডফাদারদের নাম ব্যবহার করে এলাকায় এলাকায় চাঁদাবাজিও চালায়। চট্টগ্রাম মহানগরীতে এমন কোন এলাকা নেই যেখানে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য নেই। এ বিষয়ে শনিবার জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, সহসা তিনি তার এলাকাকে সন্ত্রাসী তৎপরতামুক্ত করার পদক্ষেপ নেবেন এবং জানান দেবেন তার এলাকায় কোন সন্ত্রাসী কার্যক্রম হতে পারবে না। অনুরূপভাবে নগরীর ৪১ ওয়ার্ডে নির্বাচিত কাউন্সিলর, রাজনৈতিক দলীয় নেতৃবৃন্দ, সংসদ সদস্যগণ নিজ নিজ এলাকাকে সন্ত্রাসী তৎপরতা মুক্ত করতে পদক্ষেপ নিলে সমাজ যেমন উপকৃত হবে তেমনি নিজ নিজ দলও সুখ্যাতি যে অর্জন করবে এতে কোন সন্দেহ নেই বলে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহলগুলোর ধারণা। অপরদিকে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের মাঝেও শুদ্ধি অভিযান চালানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। র‌্যাব, পুলিশের কিছু সদস্য ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব সংস্থার কয়েক সদস্য ধরাও পড়েছে। চট্টগ্রামে দুই সেনা সদস্যও ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয়েছে। এতে নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এসব নিয়ে মানুষের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা যেমন বাড়ছে, বিপরীতে এ জাতীয় অপরাধ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি তেমন লক্ষ্যণীয় নয়। ফলে নগরবাসীর মাঝে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
×