ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রাস্তার সস্তা খাবার ২

সবাই খাচ্ছে- শিক্ষিত অশিক্ষিত, আয় কম বেশির বালাই নেই

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সবাই খাচ্ছে- শিক্ষিত অশিক্ষিত, আয় কম বেশির বালাই নেই

ওয়াজেদ হীরা ॥ কর্মব্যস্ত রাজধানীতে নিম্ন আয়ের মানুষই নয় বরং উচ্চ আয়ের লোকজনের পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষিত ধনাঢ্য মানুষও ‘স্ট্রীট ফুড’ বা পথ খাবার খেয়ে অভ্যস্ত। এসব খাবার খেলে ভয়ঙ্কর সমস্যা হতে পারে জেনেও শিক্ষিত মানুষ প্রতিনিয়তই খেয়ে যাচ্ছেন মুখ রোচক বাহারি সব পথ খাবার। শিক্ষিত ব্যক্তিরা এসব খাবার মূলত শখ করে খেলেও এটিই একটা আসক্তিতে পরিণত হয়েছে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের মোড়ে, রাস্তার ধারে ফুচকা-চটপটি কিংবা ঝালমুড়ি খেতে দেখা গেছে বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ধনাঢ্য পরিবারের লোকদেরও। যাদের অনেকেই এসব খাবার পথের ধুলোবালিসহ না খেয়ে একটা ভাল রেস্টুরেন্ট বা হোটেলে বসে খেতে পারেন। জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ১৩০ পদের খাবার পাওয়া যায় রাস্তার। এর মধ্যে রয়েছে ফুচকা, চটপটি, শিঙ্গাড়া, সমুচা, ছোলাভাজি, বেগুনি, আলুর চপ, ডালপুরি, ভেলপুরি, পাকুড়া, হালিম, ঝালমুড়ি, জিলাপি, লেবুর শরবত, আখের রস। বাড়তি খাবার হিসেবে থাকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আলু সিদ্ধ, স্যুপ, পোড়া পেঁয়াজ ও মরিচ, সালাদ, নুডলস ও হরেক রকম মিষ্টান্ন। রাস্তার খাবারের পুষ্টিগুণ থাকে অতি সামান্য এবং শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব থাকে অতি বেশি। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে দেখা গেছে অনেক সময় মা-বাবারাও তাদের সন্তানকে এসব খাবার কিনে দেন এবং খেতে উৎসাহিত করছেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অবস্থিত ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে প্রতিদিনই পথ খাবারের হাট বসে। সন্ধ্যার সময় উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিরা তাদের সন্তানদের এখানে ইংরেজী শেখাতে নিয়ে আসেন। একাধিক অভিভাবকের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, আসলে খাওয়ার সময় পরিবেশনটা একটু দেখি। আর সন্ধ্যায় একটু হালকা নাস্তা করতে হয়, তাই করা। তবে এর ক্ষতিকর বিষয়টি নিয়ে তারা সচেতন, সেটিও বলেন। ইসমত আরা তার সন্তানকে নিয়ে পথ খাবার খেতে খেতে জনকণ্ঠের এই প্রতিবেদককে বলেন, অসুখটা দ্রুতই আমরা দেখি না। তাই বার বার খাই। আসলে খাওয়া উচিত নয়। তবে আমরা না খেয়েও থাকতে পারি না। টিএসসির পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান গেটে গরম গরম তেলে বেগুনি ও চপ ভাজা হচ্ছে। ক্রেতার সংখ্যাও কম নয়। যারা অধিকাংশই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ফাহিম ও তার বন্ধুরা একত্রে বেগুনি খেতে খেতে বলেন, দীর্ঘদিন খেতে খেতে পচা খাবারই আমাদের পেটে সয়ে গেছে। এখন ভাল খাবার পেটে সয়না। খাবারের মান নিয়ে বলেন, আসলে এই এলাকায় সবাই বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আর যারা এসব বিক্রি করে তারাও চেষ্টা করে একটু ভাল করার। কড়াইয়ের ওপর গরম কালো তেল দেখিয়ে দিলে কোন কথাই বলেননি ওসব শিক্ষার্থী। একই চিত্র বিশ^বিদ্যালয়ের হাকিম চত্বরে। সুজানা, তানিয়া, রুমানা আর ইয়াসমিন এসেছেন একটু হালকা খাবার খেতে। আর সেই হালকা খাবার হলো পথ খাবার। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন এই শিক্ষার্থীদের প্রায় শেষ। পথ খাবার নিয়ে বলেন, বিশ^বিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হয়েছি তখন প্রায়ই অসুস্থ হতাম। এখন আর তেমনটা নয়। তবে এখনও অনেকের পেটের পীড়া দেখা যায়; সেটিও তারা স্বীকার করেন। বিশ^বিদ্যালয়ের অনেক জায়গায় কাঁচাকলা, কাঁচা বরই পিষে ভর্তা করা হয়। অনেক শিক্ষার্থীর কাছে এটি প্রিয় হলেও এসব পণ্য ধোয়ার জন্য একই পানি বার বার ব্যবহার করতেও দেখা গেছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক পুষ্টিবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন জনকণ্ঠকে বলেন, খাদ্যের প্রতিটি জায়গায় সতর্ক হওয়া উচিত। খাবার তৈরির প্রক্রিয়া বা এর মান আরও উন্নত হওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। শিক্ষিত মানুষের পথ খাবারের বিষয়ে বলেন, এটি এক ধরনের আসক্তি। কারণ, আমরা জেনেও এ ধরনের খাবার খাচ্ছি। ‘আমড়া, আমড়া’ বলে পাবলিক বাসে উঠে হাঁকডাক দিচ্ছেন বিক্রেতা তোজাম্মেল। বেসরকারী এক কর্মজীবীর ইশারায় বোতলে থাকা দেখতে নোংরা পানি দিয়ে ধুঁয়ে তার হাতে দিলেন। আবু হোসাইন নামের ওই কর্মকর্তা বলেন, আসলে অনেক সময় আমড়া খাই না তবে কখনও কখনও এসব খাবার ভালই লাগে। রাজধানীর একাধিক ছোট ছোট গলিতে বিভিন্ন পথ দোকানের ভাজা-পুড়া নানা খাবার খাওয়ার দৃশ্যও দেখা গেছে। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের খাবার তো আছেই। ঢাকা মেডিক্যালের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শহীদুল বাশার জনকণ্ঠকে বলেন, শিক্ষিত মানুষের এই ধরনের খাবারের প্রতিও একটা আসক্তি আছে। আসলে সবাই এসব খাবার খেয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। অশিক্ষিতদের চেয়ে বর্তমানে শিক্ষিতরা বেশি খাচ্ছেন। আমাদের মেডিক্যালের শিক্ষার্থীরাও খাচ্ছেন। এসব খাবার স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও খাচ্ছেন। তাদের অভ্যাসে পরিবর্তন প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের অধ্যাপক মুনীরউদ্দিন আহমদের মতে, বিকেল থেকেই শহরের রাস্তার ধারে ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান বসে যায়। ব্যয়বহুল রেস্তরাঁয় পাওয়া যায় এমন অনেক খাবার এসব দোকানে পাওয়া যায়। ঢাকায়ও রাস্তার ধারে এখন স্ট্রীটফুডের পসরা সাজিয়ে বসতে দেখা যায়। নগরীর অনেক এলাকায় রাস্তার খাবারের অস্থায়ী দোকান বসে। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত এসব দোকান খোলা থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে ঝালমুড়ি, ফুচকা-চটপটির দোকান তো আছেই। বিদেশের স্ট্রীট ফুডের সঙ্গে বাংলাদেশের স্ট্রীট ফুডের পার্থক্য এই যে: বিদেশে এসব খাবার তৈরি ও পরিবেশন করা হয় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে; কিন্তু বাংলাদেশে এসবের বালাই নেই। একটি লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে মুনীরউদ্দিন আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির এক পরীক্ষায় জানা গেছে, ঢাকা শহরের শতকরা ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ ভেলপুরি, ফুচকা ও ঝালমুড়িতে কলেরার জীবাণু ই-কোলাইয়ের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পাঁচটি ভেলপুরি ও তিনটি ঝালমুড়ির নমুনায় টাইফয়েডের জীবাণু সালমোনেলা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ৩০টি ফুচকার নমুনায় শতভাগ, ১২টি ভেলপুরির নমুনায় শতকরা ৭৫ ভাগ, ঝালমুড়ি ১৩টি ও চারটি আচারের নমুনায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় ইস্ট পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, আমাদের সব সময় মনে রাখা উচিত, অসুস্থ হওয়াটা বিরাট অভিশাপ। সুস্বাস্থ্যই সব সুখের মূল। সুস্থ থাকার জন্য আমাদের সদা সচেষ্ট থাকা দরকার। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা সচেতন করতে অনেক পদ্ধতি গ্রহণ করেছি। আর যারা সচেতন তাদের ক্রমে এসব পরিহার করতে হবে এবং যারা সচেতন নয় তাদের সচেতন করতে হবে। বর্তমানে শিক্ষিত মানুষের এসব খাবারে বিশেষ আগ্রহ আছে। তবে এক সময় থাকবে না বলেও মনে করেন চেয়ারম্যান। জীবনের প্রয়োজনে খাবার অতীব জরুরী। তবে জীবনকে ধ্বংস করে দেয় সেসব খাবার কৌশলে পরিহার করাই উত্তম বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব খাবার খাওয়া এক ধরনের অভ্যাসে পরিণত হওয়ায় ধীরে ধীরে এসব অভ্যাস পরিবর্তনের পক্ষেও মত সংশ্লিষ্টদের। নিজেদের সুস্থতার প্রয়োজনেই এই অভ্যাস গড়তে হবে।
×