ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আজ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হতে পারে ॥ যুক্তরাজ্যে সরাসরি কার্গো পরিবহন

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

আজ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হতে পারে ॥ যুক্তরাজ্যে সরাসরি কার্গো পরিবহন

আজাদ সুলায়মান ॥ অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আজ (রবিবার ) আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা আসতে পারে ঢাকা থেকে যুক্তরাজ্যে সরাসির কার্গো পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের। ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশন নিজেই ঘোষণা দেবে- কি পরিস্থিতিতে, কেন এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল এবং কি কারণে শেষ পর্যন্ত সেটা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী শাহজাহান কামাল, সিভিল এ্যাভিয়েশন অথরিটির চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান, মেম্বার (অপস) এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার এ্যালিসন বেন্টিক উপস্থিত থেকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ও বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে সরাসরি আকাশপথে পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তথ্য তুলে ধরবেন। তবে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা এলেও বেশ কিছু শর্ত দেবে যুক্তরাজ্য। একটি সূত্র জানায়, শর্ত অনুসারে শাহজালালের নিরাপত্তা বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদে দুজন পরামর্শক নিয়োগ, এ্যাভিয়েশন সিকিউরিটিতে ইউকে মডেল অনুসরণ করা, ইউকে ও বাংলাদেশের যৌথভাবে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনর্মূল্যায়ন করা। এ বিষয়ে সাবেক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জানান, দীর্ঘ দুই বছর যুুক্তরাজ্যে ঢাকা থেকে সরাসরি কার্গোর ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সব কাজ শেষ। এখন শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাকি। এর জন্য অনেক খড়কুটো পোড়াতে হয়েছে। একদিনে এটা হয়নি। বলা যেতে পারে আজ জাতির অন্যতম অর্জনের দিন। এখন এটার মর্যাদা রক্ষা করার দায়িত্ব বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের। জানা গেছে, গত সপ্তাহেই যুক্তরাজ্যের ডিএফটি এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সুপারিশপত্রে স্বাক্ষর করে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সদস্য এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আর কোন বাধা রইল না। এখন শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বাকি। আজ রবিবার ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার মি. ব্ল্যাকসন আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দেবেন। এ বিষয়ে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ফারুক খান বলেন,নিষেধাজ্ঞা জারির পর যেভাবে নেতিবাচক সমালোচনা করা হয়েছে,তা প্রত্যাহার করা হলে ঠিক সেভাবেই ইতিবাচক মূল্যায়ন করতে হবে। এতে প্রমাণিত, বর্তমান সরকারের কূটনৈতিক সাফল্যের অন্যতম নিদর্শন হিসেবেই মূল্যায়ন করতে হবে এই প্রত্যাহারকে। উল্লেখ্য, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকার অজুহাতে ২০১৬ সালের মার্চে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সে দেশে সরাসরি পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাজ্য। এতে দেশ- বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিশেষ করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বিপুল কার্গো আয় থেকে বঞ্চিত হয়। এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে দুই বছর ধরেই অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক। যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট (ডিএফটি) সরাসরি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিকমানের নয় সাফ জানিয়ে দেয়। এই অজুহাতে ডিএফটির শর্তের বেড়াজালে পড়ে বাংলাদেশকে নিতে হয়েছে অনেক পদক্ষেপ। রেডলাইনের মতো কোম্পানিকে কোন ধরনের টেন্ডার ছাড়া কোটি কোটি টাকার প্রশিক্ষণ কাজে নিয়োগ দিতে হয়েছে। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ডিএফটি শাহজালালের নিরাপত্তায় বেশ কিছু যন্ত্রপাতি স্থাপনের সুপারিশ করে। সিভিল এ্যাভিয়েশানকে তাই মানতে হয়। এশিয়া মহাদেশের অনেক উন্নত দেশের বিমানবন্দরে ইডিএস না থাকলেও বাংলাদেশকে তা কিনতে বাধ্য করা হয়। যুক্তরাজ্যের পরামর্শ অনুযায়ী বিমানবন্দরে উড়োজাহাজের হোল্ডে রাখার মতো ভারি ব্যাগ তল্লাশির জন্য ডুয়েল ভিউ এক্স-রে স্ক্যানিং মেশিন, হ্যান্ডব্যাগ তল্লাাশির জন্য ডুয়েল ভিউ স্ক্যানিং মেশিন, লিকুইড এক্সপেন্টাসিভ ডিটেকশন সিস্টেম (এলইডিএস), আন্ডার ভেহিকল স্ক্যানিং সিস্টেম (ইউ ভি এস এস), ফ্যাপ ব্যারিয়ার গেট উইথ কার্ড রিডার, ব্যারিয়ার গেট উইথ আরএফআইডি কার্ড রিডার, এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম (ইডিএস), এক্সপ্লোসিভ ট্রেস ডিটেকশন (ইটিডি) যন্ত্রপাতি বসানো হয়। যুক্তরাজ্যের জুড়ে দেয়া শর্ত ও পরামর্শের অধিকাংশই অযৌক্তিক হলেও বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তা পরিপূরণ করার উদ্যোগ নেয়। যে কারণে মাত্র দু’বছরের মধ্যেই শাহজালালের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় আনা হয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আন্তর্জাতিকমানেই চোখ ধাঁধানো সাজে সজ্জিত করেছে এই কার্গো হাউজ। এক সময় কার্গোর ভেতর ও বাইরে যত্রতত্র কার্টুন পড়ে থাকত। কোন শৃঙ্খলা ছিল না, নিয়মনীতি ছিল না। এখন সেই চিত্র পাল্টে দেয়া হয়েছে। ঢেলে সাজানো হয়েছে কার্গোর অবকাঠানো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বসানো হয়েছে বর্তমান বিশ্বের অত্যাধুনিক ইডিএস ও ইডিটি। আছে ডুয়েল ভিউ এক্সরে। সঙ্গে ডগ স্কয়াড। যাতে কখনও অন্য দুটো বিকল হলেও ডগ স্কোয়াড দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়। এভাবে বহুধাস্তরে সাজানো হয়েছে কার্গো স্ক্যানিং ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সিভিল এ্যাভিয়েশানের বর্তমান মেম্বার অপারেশান এয়ার কমোডর মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল বিশেষজ্ঞের দিবা রাত্রি অক্লান্ত প্রচেষ্টার দরুণ নিধার্রিত সময়ের আগেই সম্পন্ন করা হয়েছে ইডিএস প্রক্রিয়ার সব কাজ। তিনি বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নৌপথে পরিবর্তের আকাশপথে বিনাভাড়ায় ইডিএস মেশিন এনে বিপুল অংকের সাশ্রয় করেন। ইডিএস স্থাপনের পর ইতোমধ্যে আরএস-৩ এর স্বীকৃতি মিলেছে। এরপর নভেম্বরে পরিদর্শনে আসেন য্ক্তুরাজ্যের ডিএফটি-এর বিশেষ টিম। তারা সরজমিনে কার্গো হাউজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শনের পর সন্তোষ প্রকাশ করে । এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ২০১৬ সালের মার্চে সরাসরি কার্গো ফ্লাইট পরিচালনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির পর যুক্তরাজ্যের পরামর্শে শাহজালালের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া হয় ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান রেড লাইনকে। প্রতিষ্ঠানটি সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তা কর্মীদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশিসহ বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজনের পরামর্শ দেয়। এ সব শর্ত ও সব প্রস্তুুতি সম্পন্ন করার পর ডিসেম্বরের শেষের দিকে তৎকালীন বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাজ্য গমন করেন। সেখানে তিনি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ঢাকার সব প্রস্তুতি থাকা সত্তেও কেন এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা যাবে না তা সুস্পষ্টভাবে জানতে চান। এতে ডিএফটি প্রতিনিধিরা মেননের দাবি যৌক্তিক বলে স্বীকৃৃতি দিলে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কথা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করলেও জোর আশ্বাস দেয়া হয়। তখন মšী¿ সুনির্দিষ্টভাবে সময়সীমা জানতে চান। তখন তাকে অনেকটাই নিশ্চিত করা হয় নতুন বছরের শুরুতেই এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে ডিএফটি। যদিও এরপর আবারও কয়েকটি পর্যবেক্ষণ জুড়ে দেন। এরমধ্যে ছিল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদে দুজন পরামর্শক নিয়োগ, এ্যাভিয়েশন সিকিউরিটিতে ইউকে মডেল অনুসরণ করা,শাহজালালে ২১ ও ৮ নং গেটে আরও নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা ও ইউকের একক নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ। এসব পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে তৎকালীন বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জনকণ্ঠকে বলেন- যুক্তরাজ্য মনে করেছিল এগুলো মিট-আপ করা দরকার। সেভাবে আমরা তাদের জবাব দিয়েছি। আমরা তাদের কাছে কিছু ক্ল্যারিফিকেশন চেয়েছি। তাদের বলেছি আগে এম্বার্গো তুলে নাও। এছাড়া, যুক্তরাজ্যে আমার সফরের সময় ডিএফটিকে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়ন বিষয়ে অবহিত করা হয়েছিল। বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজ সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা আসছে। এটা জাতির জন্য অনেক বড় অর্জন। জানা যায়, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে আলোচনার জন্য গত ২৭ নবেম্বর যুক্তরাজ্য সফরে যান তৎকালীন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের ৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ২২ নবেম্বর থেকে ২৭ নবেম্বর পর্যন্ত শাহজালালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ ও সিভিল এ্যাভিয়েশন অথরিটির সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে বৈঠক করেন। তৎকালীন বিমানমন্ত্রীর সঙ্গে ইউকে ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্টের (ডিএফটি) বৈঠকের পর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। কার্গো নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা আসার মধ্যেই ফের শর্ত দেয় যুক্তরাজ্য। এসব শর্ত নিয়ে আলোচনা চলে মন্ত্রণালয় ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে। শেষ পর্র্যন্ত যুক্তরাজ্য শাহাজালাল বিমানবন্দরেরর সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় আর তেমন কোন ত্রুটি দেখতে না পেয়ে এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে আজ ঘোষণা দেয়া হচ্ছে ঠিক কবে, কোন্ শর্তের বেড়াজালে তা প্রত্যাহার করা হচ্ছে।
×