ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইন্টারনেট অধিকার

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ইন্টারনেট অধিকার

জাতিসংঘের চলমান টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ইন্টারনেট একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ইতোমধ্যে এসডিজি ও আইসিটির একটি তুলনামূলক সম্পর্ক নিয়ে খোদ মহাসচিব একটি পর্যবেক্ষণ কাজ অনুমোদন করেছেন। এসডিজি অর্জনে ইন্টারনেট কী কী ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে এই পর্যবেক্ষণ প্রকল্পে তা ফলোআপ করা হবে। ২০১৮ সালের ৭৩তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের নিয়মিত বিতর্কে এবার যে কয়েকটি বিষয় চূড়ান্ত মীমাংসার দিকে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো এখন পর্যন্ত এসডিজি অর্জন লক্ষ্যমাত্রা বিবেচনায় রেখে দুনিয়াজুড়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন ও অঙ্গীকারের নির্দেশিত পথে দেশগুলোর ‘অগ্রগতি প্রতিবেদন’ পর্যালোচনা। যেখানে ‘সর্বজনীন ব্রডব্যান্ড’ প্রাপ্তিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই ‘অগ্রগতি প্রতিবেদন’ বিধি অনুযায়ী প্রতি বছর দিয়ে থাকে আঙ্কটাড (টঘঈঞঅউ)-এর বিশেষ কমিশন যা সর্বমহলে ‘কমিশন ফর সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলোজি ফর ডেভেলপমেন্ট (ঈঝঞউ) নামে ব্যাপক পরিচিত। এই কমিশন সকল সদস্য দেশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে প্রতিবছর মে মাসে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিনিধিদের নিয়ে জেনেভায় স্থায়ী দফতরে বার্ষিক সভা করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে মহাসচিবের মাধ্যমে সাধারণ পরিষদে প্রেরণ করে। ২০০৫ সালে দ্বিতীয় দফা তথ্য সমাজ শীর্ষ সম্মেলনের পর ২০০৭ সাল থেকে প্রতি বছর এই কমিশনের সভা বসে এবং কমিশন সদস্য ছাড়াও তিউনিস ঘোষণার অঙ্গীকারাবদ্ধ প্রায় সকল দেশেরই প্রতিনিধিত্ব এই সভাগুলোতে থাকে (বাংলাদেশ ছাড়া)। সরকারী পর্যায়ে কখনও বাংলাদেশ সরকার বা কোন মিশন কর্মকর্তা এই সভাগুলোতে নিয়মিত বা সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছেন এমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। সর্বশেষ ২০১৭ সালের যে প্রতিবেদন সাধারণ পরিষদে পর্যালোচনার জন্য গেছে তা উন্মুক্ত করা হয় নবেম্বরের ৬-৮ তারিখে অনুষ্ঠিত আঙ্কটাড ইন্টার-সেশনাল সভায়। এতে পরিষ্কারভাবে আহ্বান করা আছে যে, ‘ডিজিটাল বৈষম্য’ দূর করতে ‘কার্যকরী ব্যবস্থা’ নিয়ে ‘উদ্ভাবনমূলক অগ্রাধিকার পন্থা’ যেন সবাই অবলম্বন করে যাতে ‘সাশ্রয়ী সর্বজনীন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট’ সেবা নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশ ২০০৩ ও ২০০৫ সালের তথ্য সমাজ শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণাপত্র ও কর্ম কৌশল বাস্তবায়নের অঙ্গীকারাবদ্ধ দেশগুলোর অন্যতম। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতি, আইন, বিধি ও কৌশল প্রবর্তন করে বর্তমান সরকারের আমলে এসে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচী গ্রহণ করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, জাতিসংঘের পদক্ষেপের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়েও বাংলাদেশ অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে। অপর দিকে একটি জাতির সম্ভাবনাময় তরুণ শক্তির জন্য আমাদের অনেক পদক্ষেপই অনুপ্রেরণামূলক হয়ে ওঠেনি। তার অন্যতম কারণ হলো ইন্টারনেট ব্যবহারের শক্তিকে পুঁজি করে জাতীয় উন্নয়নের জন্য একটি পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনার অনুপস্থিতি। এই অনুপস্থিত নির্দেশনার প্রধান প্রধান পটভূমি তৈরি হয়েছে আমাদেরই কিছু ভুল বা সীমাবদ্ধতার জন্য, যেমন- ১. যেসব প্রস্তাবনা ও সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিভাগগুলো নেয় সেখানে বাংলাদেশের ক্রমাগত অনুপস্থিতি। আমরা মনে রাখি না যে, এই রাষ্ট্রপুঞ্জ সংস্থাটি আমাদেরই এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে সকল কর্মকাণ্ডের অংশীদার। আমাদের যথাযথ অংশীদারি ভূমিকার অভাবে গৃহীত পদক্ষেপ, আর্থিক বিবেচনা আর অগ্রগতির সূচক বিন্যাসে আমরা ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছি আর এর পরিণতিতে আমরা আন্তর্জাতিক অংশীদারি কর্মকাণ্ডে দুর্বলতার পরিচয় দিচ্ছিÑ যার প্রতিফলন পড়ছে দেশের নীতি গ্রহণে ও বাস্তবায়নে। ২. দেশের অভ্যন্তরে ‘তথ্যপ্রযুক্তি নীতি’ ও এর ‘কর্ম কৌশল’ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়নি তার প্রধান কারণ এই নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ কর্মযজ্ঞ সরকার নিয়ন্ত্রিত পরিষেবা প্রদানে বিন্যস্ত হয়েছে। ‘উদ্ভাবন’ বলে সরকার যেটাকে দেখছে তা আন্তর্জাতিক রীতি-সংস্কৃতির পরিপন্থী। ‘ডিজিটাল সম্পৃক্তি’ (উরমরঃধষ ওহপষঁংরড়হ) আর ‘ডিজিটাল উদ্ভাবন’ (ওহহড়াধঃরড়হ)-কে এক করে ফেলে সরকারী দফতরগুলোর কর্মকাণ্ডকে এমনভাবে সামনে এনে ফেলা হয়েছে তাতে তরুণদের একটি বড় অংশ মনে ভেবে বসে আছে, ‘আমাদের হয়ত আদৌ আর কিছু করণীয় নেই, যা করার তা সরকার করবে!’ অপরদিকে সৃজনশীল তারুণ্য বিকাশে আমাদের দুর্বল ইন্টারনেটই একটি বড় অন্তরায়। সরকারকে এটা ভাল করে না বোঝা পর্যন্ত আমাদের হতাশায় থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আমাদের কাছে যে পরিমাণ ‘ব্যান্ডউইথ’ আছে বা যে উচ্চ গতির ইন্টারনেট আমরা ইতোমধ্যে পেয়েছি তার মূল্য পরিশোধ করেছে এই জাতি। ফলে স্বাভাবিক যে এই ইন্টারনেট পাবার অধিকার এই জাতিরই বেশি। কিন্তু তা না করে সরকার কখনও কখনও চিন্তা করছে বিদেশে ‘ব্যান্ডউইথ’ রফতানি করার যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক! অপরদিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রাপ্তির প্রক্রিয়াও এমনভাবে জটিল করে রাখা হয়েছে যে, বিটিসিএলের অফিসে এসব জানতে গেলে বিস্মিত হতে হয়! কাগজে যেসব প্রক্রিয়া বলা আছে তা এতই জটিল যে, কোন সৃজনশীল তরুণ সহজে এই পথে ইন্টারনেট পেতে যাবে না। কিন্তু বিকল্প কি? সরকার সযতনে ইন্টারনেট দিয়েছে মোবাইল কোম্পানিগুলোকে যারা উচ্চমূল্যে অত্যন্ত ধীরগতির জটিলতর ইন্টারনেট সেবা দেয়। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সরকারের এই ক্রমাগত নিয়ন্ত্রণকামী অভ্যস্ততার কারণে আমাদের দেশের কাম্য ‘উদ্ভাবন’ আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হতে পারছে না। যেসব সম্পূরক বেসরকারী সংস্থা সরকারকে নানাভাবে সহায়তা করে বলে প্রচলিত এদের মনোসংযোগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত ও সরকারের নীতি বাস্তবায়নের চেয়ে তল্পিবাহক হিসেবেই বেশিরভাগ দায়িত্ব পালন করে। ফলে সরকারের পক্ষে তার নীতিগুলো সম্পর্কে জনমানসের ভাব জানা কঠিন হয়ে পড়ে। সারা দুনিয়ায় এখন ইন্টারনেটকে জনগণের অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। জাতিসংঘের মহাসচিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অঙ্গ সংস্থা আইটিইউ আর ইউনেস্কোর উদ্যোগে বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ সমন্বয়ে ‘ব্রডব্যান্ড কমিশন ফর ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট’ গঠন করা হয়েছে। ২০১০ সালে এই ব্রডব্যান্ড কমিশন ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ব্রডব্যান্ড অর্জন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে শতকরা ৪০ ভাগ গৃহস্থালি। এর জন্য করে নিতে হবে একটি সর্বজনীন ‘ব্রডব্যান্ড নীতি’ যা বাংলাদেশের জন্য অতি জরুরী। ২০৩০ হতে আর বেশি বাকি নেই, বাংলাদেশ কতদূর এগিয়েছে? বাংলাদেশে এখনও উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার ব্যয়বহুল। এমনকি সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সংযোগ প্রক্রিয়া অতি জটিল ও হাস্যকর নিয়ন্ত্রণের অধীন! প্রতিবেশী দেশ ভারত বা শ্রীলঙ্কা এমন কি ভুটানও নিজেদের জন্যে সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট মূল্য নির্ধারণ করে তা দ্রুততম সময়ে প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। আর আমরা এখনও একটি ‘তরুণ-বান্ধব ইন্টারনেট বিতরণ নীতি’ পর্যন্ত তৈরি করতে পারিনি। আমাদের বিশ্বাস সরকার ‘ইন্টারনেট অধিকার’ বিষয়টি সম্যক অনুধাবন করে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও চলমান প্রক্রিয়াগুলোর সঙ্গে নিজেকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করবে। সারাদেশে বিশেষ করে তরুণদের জন্যে উচ্চ গতির ইন্টারনেট উন্মুক্ত করে সৃজনশীল আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে তাদের উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ নেবে। ব্যাংকগুলো যেন সহজতর প্রক্রিয়ায় বিদেশ থেকে টাকা পেতে ছেলেমেয়েদের সহজ সুযোগ করে দেয় তার জন্যও উদ্যোগ দরকার। এই ক্ষেত্রে কর দেয়া-নেয়া নিয়ে চলছে এক আজব অরাজকতা! কেউ যেন কিছুই বুঝতে চাইছে না! আমাদের মিশনগুলো মুখ দেখে কথা বলে। কখনও কোন আগ্রহী তরুণের কাজ পেতে সামান্য সহযোগিতা এরা করে না! এই দেশের মানুষ কখনও কোন দূতাবাস বা মিশন থেকে একটিও উদ্যোগের খবর পায়নি। অথচ ভারত বা শ্রীলঙ্কায় খোলা হয়েছে বিশেষ ‘প্রবাসী’ জানালা যা দিয়ে শুধু তরুণদেরই কাজের খোঁজখবর পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী প্রতি বছর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক যান। এই বিষয়গুলো এই সময়ে নানাভাবে তাঁর সামনে চলে আসে যখন দেশগুলো নিজেদের অগ্রগতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা বা বিতর্ক করে। আমরা আশা করতে চাই, এ সরকার গ্রাম-শহর নির্বিশেষে উদ্যমী, উৎসাহী তরুণদের সৃজনশীল কাজের জন্যে সহজে উচ্চগতির ইন্টারনেট প্রাপ্তিকে সম্মানের সঙ্গে বিবেচনা করবে। আমরা এটাও আশা করব তিনি সকল ভুল পরামর্শ স্বাধীনভাবে বর্জন বা উপেক্ষা করবেন। লেখক : পরিচালক আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প r্[email protected]
×