ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এখন আর একুশের সঙ্কলন চোখে পড়ে না -মুহম্মদ শফিকুর রহমান

প্রকাশিত: ০৪:২২, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

এখন আর একুশের সঙ্কলন চোখে পড়ে না -মুহম্মদ শফিকুর রহমান

এখন আর একুশে সঙ্কলন চোখে পড়ে না। সেকালে একুশে সঙ্কলন প্রকাশ এবং একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালন ছিল একান্তই সামাজিক এবং শিক্ষাঙ্গনের বাধ্যবাধকতা। কখনও কখনও এটি উৎসবের আমেজ বয়ে আনত, প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে প্রতিযোগিতা হতো কার সঙ্কলন বেশি সুন্দর, বেশি গুরুত্ববহ। একটা সময় ছিল যখন হাজার হাজার ‘একুশে সঙ্কলন’ বের হতো। এমন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, ক্লাব-সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল না যারা একুশে সঙ্কলন বের করত না। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলন শুরুর পর থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকা- পর্যন্ত সেই ধারা অব্যাহত থাকে। সেবার বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের প্রতিবাদে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়?’ শিরোনামে একুশের যে সঙ্কলনটি বের করেছিল তা ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদী ভাষা। অবাক করার মতো ঘটনা ছিল তখন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও একুশে ফেব্রুয়ারি দেয়াল পত্রিকায় গল্প-ছড়া লিখত, ছবি আঁকত। একুশের প্রভাতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি...’ গাইতে গাইতে খালি পায়ে স্ব-স্ব স্কুলের শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাত। তারপর থেকে খুব দ্রুত একুশে সঙ্কলন হারিয়ে যেতে থাকে। মিলিটারি শাসকদের বেয়নেটের খোঁচায় ক্ষত-বিক্ষত একুশের চেতনা বাঙালিয়ানা সব। মিলিটারিদের হাতে রোপণ হয় জঙ্গীবাদের বিষবৃক্ষ, যা আজ ডালপালা গজিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে ব্যঙ্গ করছে এবং যার ছায়ায় বসে অক্সিজেন নিচ্ছে মিলিটারির ডালপালা বিএনপি-জামায়াত-শিবির। হারিয়ে যেতে থাকে আমাদের সচেতনতার একুশে। তারপরও বলব টানেলের শেষ প্রান্তে যে আলোকরশ্মি এখনও দেখা যায় তাতে ইচ্ছে করলেও কেউ আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দিতে পারবে না। তারপরও বলতে হয় আজকাল একুশে গ্রন্থমেলায় শত শত নতুন গ্রন্থ আসে, কোন কোনবার হাজার ছাড়িয়ে যায়, যার বেশিরভাগই নতুনদের। বলতে দ্বিধা নেই এসব বইয়ের (৯৫%) মান আমাদের ছেলেবেলার একুশে সঙ্কলনের মতও নয়। আমরা যারা শৈশব-কৈশোর তারুণ্য পাড়াগাঁয় কাটিয়েছি তারাও ফেব্রুয়ারি এলে দল বেঁধে দেয়াল পত্রিকা হাতে লেখা সঙ্কলন বের করতাম, যা একুশে সঙ্কলন সাহিত্য নামে পরিচিত ছিল। আমাদের সেই আন্দোলন ‘একুশে সঙ্কলন সাহিত্য’ নামে খ্যাতি অর্জন করে, যার ঢেউ পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা, অসম প্রভৃতি অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছিল। তখন কিন্তু আমরা নিজেরা ৪ আনা ৮ আনা করে জমিয়ে একুশের সঙ্কলন বের করতাম। চাঁদাবাজি কাকে বলে জানতাম না। অন্যের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সঙ্কলন বের করাটাও ঘৃণার চোখে দেখতাম। যেসব প্রতিষ্ঠান আজকাল একুশে সঙ্কলন বের করে তা করে অর্থ সংগ্রহ প্রকল্প হিসেবে। একটা সঙ্কলন বের করা মানে বিজ্ঞাপন আকারে চাঁদাবাজি। কিছু আছে এভাবে তাদের সংসার চালায়, গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়। আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারি এখন। এই সুবাদে একটা প্রসঙ্গ টানতে চাই, যা সচেতন নাগরিকদের মর্মবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান বিশ্বের অল্প কয়েকজন শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনেতার অন্যতম আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সুযোগে বেশ কিছু প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেল ও বেতার তরঙ্গ কাজ করছে। এতে নাটক, ধারাবাহিক বা স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দেখানো হয়, যেগুলোর ভাষা রীতিমতো গায়ে জ্বালা ধরায়। উপস্থাপনার নামে কিছু তরুণ-তরুণী কথায় কথায় বাংলা বাক্যের মাঝে একটা-দুটা ইংরেজী শব্দ ঢুকিয়ে বা একটি বাক্যে আধা বাংলা আধা ইংরেজী এভাবে এমন খিচুড়ি ভাষার অবতারণা করে যা রীতিমতো অশ্লীল এবং আমাদের তরুণ ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য দুঃসংবাদ বটে। আঞ্চলিক ভাষা খুবই মধুর, কিন্তু তাও এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যাতে একটি গম্ভীর বক্তব্যেও হাসির খোরাক জোগায়। এই একুশে তাই সকল পক্ষের কাছে আবেদন প্রমিত না হয় হলো, কিন্তু শুদ্ধ করে পরিবেশনে দোষ কি? এ প্রসঙ্গে একটা স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠল। তখন সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষ অনার্সে (বাংলা) ভর্তি হয়েছি। ছাত্রলীগ করতাম। হয়ত বাংলার ছাত্র বলে হাজী মুহম্মদ মহসিন হলের সহ-সাহিত্য সম্পাদক হলাম। সামনে ১৯৬৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সঙ্কলন বের করতে হবে। সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন মীর শাহাবুদ্দিন মাহমুদ (সাবেক সচিব)। সঙ্কলন প্রকাশের ভার পড়ল আমার ওপর। আমি শিল্পী হাশেম খানের কাছ থেকে নামকরণ ও প্রচ্ছদ আঁকিয়ে নিলাম। হাশেম খান (আমার চাচা) সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার লাইন দিয়ে নামকরণ করলেন -‘উতল সাগরের অধীর ক্রন্দন।’ তখন বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা এবং ঊনসত্তরের ছাত্র গণঅভ্যুত্থান শুরুর কাল। নির্ধারিত দিনের সঙ্কলনটি বের করতে হবে। দিনও ঘনিয়ে এসেছে। এতো সঙ্কলন বেরোত যে, লেখা জোগাড় করা দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। কি আর করা, তখন নিজেই একটা কবিতা লিখে ফেললাম। একটা পাতা অন্তত ভরাতে পারলাম। তাছাড়া আমি সম্পাদনা করছি অথচ আমার একটা লেখা থাকবে না এটা কি হয়? শহীদ দিবস শেষ হলো। দু’দিন পর এক বিকেলে হলের পাটোয়ারী ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছি। আকাশবাণী চলছিল। হঠাৎ কানে এলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর (সম্ভবত) সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় আমাদের শহীদ দিবসের ওপর আলোচনা করছেন। তিনি বলছিলেন (কথাটা এ রকম) মায়ের ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করে এমন উদাহরণ ঢাকা তথা পূর্ব বাংলায়ই রচিত হলো। বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা রাজপথে নেমে বুকের রক্ত ঢেলে দিল, এমন নজির কোথাও নেই। সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারের রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হলো। সেই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। তারা সেখানেই থেমে থাকেনি। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদদের স্মরণে একুশে সঙ্কলন বের করে আসছেÑ শত শত, কখনও কখনও হাজারও ছাড়িয়ে যায়। অন্যান্যবারের মতো এবার কয়েকটি একুশে সঙ্কলন হাতে এসেছে। সবার আগে যেটি আমার হাতে এসেছে তা কবি সুকান্তের কবিতার লাইন দিয়ে নামকরণ করা হয়েছে। এতে প্রবন্ধ, ছোট গল্প, কবিতা স্থান পেয়েছে। তিনি প্রথমেই ‘অশ্রুত যন্ত্রণা’ শিরোনামের কবিতাটি পাঠ করলেন এবং তার ওপর কয়েক সেকেন্ড আলোচনা করলেন। অবাক হলাম- ওটি আমার লেখা কবিতাটি, যা ভরাট করার জন্যে লিখে ছেপে দিয়েছি। আরেকটি মধুর স্মৃতি হলো ১৯৬৯ সালে ফেব্রুয়ারির এক তারিখ থেকে ইউওটিসির ট্রেনিং শুরু হলো। আমিও ইউওটিসি করতাম। আগেরবার আমাদের ট্রেনিং হয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। দেড় মাসের ট্রেনিং। লেফট-রাইট থেকে শুরু করে এলএমজি পর্যন্ত অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী একটি ক্যাম্প করলে জুনিয়র মিলিটারি সায়েন্স পরীক্ষা দেয়া যায়। আমি পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম। পরের বছর ১৯৬৯ আরেকটি ক্যাম্প করে সিনিয়র মিলিটারি সায়েন্স পরীক্ষা দেয়া যাবে। এদিকে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেছে। যাব কি যাব না অনেক ভেবে অবশেষে এক সকালে ব্যাগ গুছিয়ে চলে গেলাম টাঙ্গাইলের সফিপুর। এখানে এবারের ইউওটিসির ট্রেনিং ক্যাম্প। ট্রেনিং শুরু হলো। একুশে ফেব্রুয়ারি এলে আগের রাতে আমরা কয়েকজন খায়রুল আলমের (সাবেক এমডি, ইবিএল) তাঁবুতে একত্রিত হলাম। আমাদের মধ্যে সিদ্ধান্ত হলো একুশে ভোরে আমরা বুট না পরে খালি পায়ে প্যারেড করব, তাতে করে প্রভাতফেরির মতো হবে। বিকেলের পিটিতেও আমরা খালি পায়ে যাব। এবার সবার পকেটে যে কোন একটা ফুল থাকবে এবং আমরা একটা নির্দিষ্ট স্থানে ফুল রাখব অর্থাৎ শ্রদ্ধা জানাব। এখানে একটা কথা বলা দরকার, যতদিন আমরা, অর্থাৎ ইউওটিসি ক্যাডেটরা ক্যাম্পে ট্রেনিং-এ থাকব ততদিন সম্পূর্ণ পাকিস্তান আর্মি রুলস অনুযায়ী থাকতে হতো। প্যারেড থেকে শুরু করে পিটি, অস্ত্রের ট্রেনিং, মহড়া সবই করাত পাকিস্তান আর্মির জোয়ান-অফিসাররা। ইউওটিসির নিজস্ব যে সেট আপ থাকত তা নামমাত্র। সবই পাকিস্তান আর্মির হুকুমে চলত। বিকেলে পিটি থেকে তাঁবুতে এলে দেখি প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের যে অস্ত্র দেয়া হয়েছিল তা নেই, আর্মি তুলে নিয়ে গেছে। শোনা গেল আমি, আলমসহ কয়েকজনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করার কথা ভাবা হচ্ছে। কথাটা সব তাঁবুতে ছড়িয়ে পড়ল এবং কোন রকম রাত কাটিয়ে ভোরে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সবাই আর্মিকে তোয়াক্কা না করে সোজা সাভারের রাস্তায় এসে যে যেভাবে পেরেছি ঢাকা ফিরেছি। প্রত্যেকটি ক্যাম্প ছিল দেড় মাসের। এক মাস ৫ দিন পরই আমরা চলে আসি। আমাদের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় বলতে হয়- ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। কে আমাদের বহিষ্কার করে? আমরাই ওদের বহিষ্কার করে দিলাম। ঢাকা ॥ ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×