ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মেলায় প্রকাশিত তিনটি বই নিয়ে আলোচনা করেছেন নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

 মেলায় প্রকাশিত তিনটি বই নিয়ে আলোচনা করেছেন নাজনীন বেগম

নীল পাড়ের শাড়ি ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮ তে প্রকাশ পায় মাহবুবুর রহমানের গল্প সঙ্কলন নীল পাড়ের শাড়ি। গ্রন্থটির প্রকাশনার দায়িত্বে আছে দাঁড় কাক। প্রচ্ছদ শিল্পী সঞ্জীব পুরোহিত। গ্রন্থকার একজন চিকিৎসক এবং হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হৃদয়ের কাটা ছেঁড়া করতে করতে গল্পকার এক সময় ফিরে তাকান হৃদয় নিঃসৃত অনুভবের শৈল্পিক সুষমায়। নগরকেন্দ্রিক কোলাহল জীবনের নিয়মতান্ত্রিক কর্মজীবন ফিরে পেতে চায় দূর শৈশবের স্মৃতিমাখা মনের নিভৃতে জায়গা করে নেয়া সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার এক অবিমিশ্র স্বাপ্নিক জগৎ। চলমান জীবন গতিময়তায় যতই নিরন্তর হোক স্মৃতির মিনারে জ্বলজ্বল করা যদিও এখন তা নিশ্চল, নিশ্চুপ শৈশবে আজও হৃদয়াবেগে তাড়িত হয়, নান্দনিকবোধে জেগে ওঠে। ভূমিকাতে সেই ধারণাই ব্যক্ত হয়েছে মাহবুবুর রহমানের অতি ক্ষুদ্র বয়ানে। আর সেই বোধেই গল্পের উপজীব্য কাহিনী সম্ভার শৈল্পিক বৈভবে ঋদ্ধ হয়েছে। গল্পগুলো পড়তে পড়তে পাঠকদের বুঝতে অসুবিধা হয় না আপন অভিজ্ঞতার আলোকে গল্পে রূপকারের নিজস্ব অভিব্যক্তিতে সমৃদ্ধ অবয়ব তৈরি করা হয়েছে। নৈসর্গিক সম্ভারের লীলাভূমি গ্রামবাংলার স্রোতস্বিনী নদী থেকে শুরু করে ঘন সবুজের বেড়াজালে আবদ্ধ মাটি আর মানুষের মিলিত সত্তাও গল্পের আঙ্গিককে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। আবহমান বাংলার রূপসৌন্দর্য যেভাবে গল্পের নিজস্ব গতিপথ তৈরি করে নিয়েছে একইভাবে অসহায়, নির্বিত্ত মানুষের প্রতিদিনের জীবন ও কর্মপ্রবাহের এক স্পষ্ট চালচিত্র ও কাহিনীর অঙ্গসৌষ্ঠবে নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করেছে। গল্পগুলো মূলত দক্ষিণ বাংলার বাগেরহাটের মানুষ আর প্রকৃতির লীলাবৈচিত্র্যের যে মহামিলন তাকেই মূলশক্তি হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়েছে। ১৯টি গল্পের সংযোজনই শুধু নয়, সব শেষে একটি ছোট্ট কবিতাও যোগ করা হয়েছে। ‘আমার জন্মভূমি’ নামে। শুরু করা গল্পটি ‘নীল পাড়ের শাড়ি’ যা বইটির নামও বটে। স্মৃতিবিজড়িত শৈশব হাতড়ে কতজনের নাম যে মনের নিভৃত আঙিনা থেকে তুলে আনা হয়েছে তা সত্যিই বিস্ময়ে মুগ্ধ হওয়ার মতো। তেমনই একটি নাম আমেনা বুবু যাকে নিয়ে ‘নীলপাড়ের শাড়ি’ গল্পটির বিষয় ও আঙ্গিক তৈরি হয়েছে। দেশের প্রতি বিশেষ দায়বদ্ধতায় গল্পের বিষয়বস্তুতে যেভাবে শৈল্পিকবোধ কাজ করে তা মূর্ত হয়ে আছে ‘১৯৭৪’ সাল গল্পটিতে। ১৯৭৪ সালের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলা আর দুর্ভিক্ষের কোপানলে পড়া অসংখ্য মানুষের জীবন ও জীবিকায় যে বিভীষিকাময় অবস্থা তৈরি হয় তাকে গল্পের রসদ করে লেখক নিজের প্রতিভাদীপ্ত মননের গভীরবোধ পাঠকের সামনে হাজির করেন। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ মাহবুবুর রহমান তার চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিষয়কেও গল্পের উপজীব্য করে নিজের সৃজন ক্ষমতাকে প্রমাণ করেছেন। ‘কালের গ্রাস’ সেই মাত্রারই একটি গল্প যেখানে হার্ট আক্রান্তের মতো একটি ভয়ঙ্কর শারীরিক অসুস্থতা মানুষের জীবনকে কতখানি দিশেহারা করে দিতে পারে। আবার তা যথার্থ চিকিৎসায় নিরাময়যোগ্যও। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সফল অর্জনও এই চিকিৎসাবিদকে উদ্বুদ্ধ করে। প্রতিটি গল্পে আছে সাধারণ মানুষের জীবন প্রণালির এক সহজ স্বাভাবিক অবস্থার সাথে সমন্বিত গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সম্পদের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। যা খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠীর জীবনকেই পাঠকের সামনে স্পষ্ট করে না;বরং পল্লীবালার অপরিমেয় রূপ-মাধুর্যও গল্পের গাঁথুনিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। আপন দেশের সম্ভাবনায় ঐশ্বর্য আর মানুষ গল্পকারের উদ্দীপ্ত চেতনা আর শৈল্পিক শৈলীতে যে রসবোধ তৈরি করে তা যেমন উপাদেয় পাশাপাশি কঠিন বাস্তবতার উপরও দাঁড়ানো। ‘সুলতান চোরা’, ‘মাটির পুতুল’, ‘মৌলবি সাহেব’ কিংবা ‘নূরা পাগলা’ গল্পগুলো সামাজিক বাস্তবতা নির্মম কশাঘাতে পিষ্ট গ্রামীণ মানুষের জীবন আর কর্মের এক কষ্টকর অনুভূতি। যা সব সময়ই কোন না কোন ঘটনার আড়ালে ঘটতে থাকে। শুধু সেখান থেকে বের করে আনার দিব্য দৃষ্টি আর সৃষ্টিশক্তি থাকাই বিশেষ জরুরী। গল্পের লেখক সেই প্রচেষ্টায় নিজের সৃজন ক্ষমতাকে নিবেদন করেছেন। যা অভিনন্দনযোগ্য। ‘আমার জন্মভূমি’ কবিতা দিয়ে শেষ করা হয় পুরো বইটি। কাব্যিক অনুভবও লেখকের ভিন্নমাত্রার শৈল্পিক শৌর্য। প্রেম ভালবাসা, স্মৃতির শৈশব, নদীর কলতান, নৈসর্গিকতার মুগ্ধ আবহ সব মিলিয়ে যেমন গল্পগুলো একইভাবে কবিতাটিও তার আপন আঙ্গিক তৈরি করে, এগিয়ে যাওয়ার গতিময়তায় পরিণতিও নিজস্ব ধারায় শেষ হয়। শব্দ চয়ন আর বাক্য গঠনের সহজতা গল্পগুলোর অন্যতম শক্তি। এবং সহজবোধ্য গ্রন্থটি পাঠক সমাজে আদৃত হবে এই আশায় বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি। মাহবুবুর রহমান প্রকাশক : দাঁড় কাক প্রচ্ছদ : সঞ্জীব পুরোহিত . ডোম ॥ এবারের বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে কবি গিরিশ গৈরিক এর কাব্যগ্রন্থ ‘ডোম’। ডোম শব্দটির মধ্যেই এর গভীরতা এবং ব্যাপ্তি প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। শুধু তাই নয় শবযাত্রার শেষকৃত্যের নির্ণায়কের ভূমিকায় থাকা এই অদভূৎ, অস্পৃশ্য গোষ্ঠীর জীবনও জীবিকার উপর কবির সংবেদনশীল অনুভব পাঠককেও নিয়ে যায় এক আলো আঁধারি জগতের অদৃশ্য আঙিনায়। যেখানে নিষ্প্রাণ মৃতদেহের ওপরও কবির স্পর্শকাতর চৈতন্য পাঠককে অন্য রকম জাগতিক এবং পারলৌকিক বিধি কবির সৃজনীশক্তিকে যেভাবে তাড়িত করে তা শুধু বিস্ময়াভিভূত হওয়াই নয় তার চেয়েও বেশি জীবনের এক কঠিনতম সত্যকে নির্মমভাবে উপলব্ধি করারও তাগিদ জীবন চলমান এবং নির্দিষ্ট সময়ের গ-িতে আবদ্ধ আর মৃত্যু গতিহীন, চির স্থবির সাথে সীমাহীন পথের যাত্রায় এক দুর্গম ঠিকানা। এমন একটি রূঢ় আর চিরসত্যকে নিয়ে কবির ডোমের যে কাব্যিক আখ্যান তা জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বিরাজমান অনভিপ্রেত এক অভিনব কৌশল। যা পাঠককে কোন এক দুঃসহ জগতের ঠিকানার দ্বার উন্মোচিত করে পাশাপাশি এই বেদনা বিধূর অনুষঙ্গের যারা অংশীদার তাদের দুঃসহ জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতারও মুখোমুখি করায়। মৃত্যু অনাকাক্সিক্ষত অপ্রত্যাশিত। সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষরাও এই নিষ্ঠুর প্রাকৃতিক নিয়মকে মেনে চলতে পারে না। ফলে অগ্যস্তা গমনকে নিয়ে কাব্যিক অনুভব এর আগেও সাহিত্যের আঙিনাকে নাড়া দেয়ার তাগিদ আমরা দেখেছি। রবীন্দ্র সাহিত্যে মরণকে শ্যামের সাথে একীভূত করে অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়েছে। এই সুন্দর পৃথিবীতে মৃত্যু’র মতো মরণ কামড়কে রবীন্দ্রনাথ কোনভাবে মেনে নিতে পারেননি। তবে শবদেহ এবং তাদের পরিচর্যাকারীদের নিয়ে এমন নির্মোহ কঠিন যন্ত্রণা এবং ভিন্ন মাত্রার অনুভব সত্যিই অকল্পনীয়। পুরো কাব্যগ্রন্থটি ৩টি পর্বে গোছানোর মধ্য দিয়ে কবির সুচিন্তিত সম্মোহনী আবেগ উপস্থাপিত হয়েছে বা শুধু বৈশিষ্ট্যম-িতই নয় এক ধরনের বিশেষায়িতও বলা যায়। কারণ পর্বত্রয় বিশেষ বিশেষ অনুভবে শবদেহ এবং সৎকারকারীদের যে ভিন্ন মাত্রার প্রবাহ তুলে ধরে তা সত্যিই কবির মননশীলতারও স্পষ্ট অভিব্যক্তি। গিরীশের ‘ডোমে’র প্রথম পর্বে ‘কবিপর্ব’ অধ্যায়টি মোট ১৫টি কবিতা গুচ্ছের অলঙ্কারে বিধৃত। সূচনাপর্বেই শুরু করছেন লাশ ঘরে কবি স্থবির হয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত অবস্থায় ডোমের করাল হস্তের নির্মম চালনায় কাটানছুড়ার প্রাণহীন দেহের অসাড় যন্ত্রণা। আসলে ‘কবি পর্বে; আছে কাব্যিক দ্বন্দ্বে শবদেহের নিঃসাড় অনুভূতির অব্যক্ত শুভ্রতায় স্পন্দনহীন আত্মার অন্য রকম নন্দনতত্ত্ব। এই অসাড় চৈতন্যের শৈল্পিক বোধে তাড়িত কবি জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে উজ্জীবিত যেমন একইভাবে নির্লিপ্ত অভিমানে অনন্ত যাত্রার ধ্যানেও নিমগ্ন। ‘গন্ধপর্ব’ কাব্যগ্রন্থটির দ্বিতীয় অধ্যায়। মৃত ব্যক্তিকে অতি সত্বর সৎকার করার অন্যতম একটি লক্ষ্য থাকে প্রাণহীন দেহকে যথার্থভাবে অন্তিম যাত্রায় সম্পৃক্ত করা। তা না হলে শবদেহের শরীরে পচন ধরে। কিন্তু কবি এই চিরায়ত প্রচলিত ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে ‘গন্ধপর্বে’র সূচনাতেই যা বলেন তা হলোÑ দক্ষিণা বাতাসে লেবুগন্ধের মতো ভেসে আসে চিতার ঘ্রাণ যেন কাফনের অন্ধকারে চিতায় শুয়ে আছে আমার প্রাণ। এভাবে গন্ধপর্ব জুড়েই আছে বসন্তের দক্ষিণা বাতাসের মতো স্নিগ্ধ সুবাসিত কোমল মনমাতানো সৌরভ যা গত হওয়া সময়ের সমস্ত ধারণাকে বদলে দেয়। এখানেও আছে সুশোভিত কবিতার স্নিগ্ধতা, হৃদয় ভোলানো সুগন্ধের মধুময় আবহ। প্রেম, ভালবাসা, আনন্দ, আবেগ মিলিয়ে এক অনাবিল আচ্ছন্নতা। আসলে শবদেহ আর ডোমকে কেন্দ্র করে কবিতাগুলোর শৈল্পিক শৈলী নির্মিত হলেও আকাক্সিক্ষত ও আলোকিত জীবনের জয়গান ও কবির নান্দনিকবোধে অনবদ্য হয়ে ওঠে। জীবন আছে বলেই মৃত্যু অবধারিত। আর প্রাণহীন মৃতদেহের শেষ ক্রিয়ায় যাদের ভূমিকা অনবদ্য তারাও জীবনের গতি প্রবাহের অবিচ্ছিন্ন, এক সুতায় বাঁধা। এই চিরায়ত সত্যকে মেনে নিয়েই গিরীশ গৈরিকের কাব্যিক আবহ, শৈল্পিক শৌর্য আর নান্দনিক মহিমা। সবশেষ পর্ব ‘সূর্য পর্বে’ আছে আলো আর অন্ধকারের এক অবিমিশ্র সম্মিলন। এখানেও আছে সমাজজীবনের হরেক রকম টানাপোড়ন, ধর্মীয় বিভাজনের এক অশুভ অপশক্তি সর্বোপরি মরণের পরেও মানুষে মানুষের ফারাকের এক অদম্য উন্মাদনা। কারণ সমাজের সবচাইতে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ধর্মীয় আবহে মানুষের জীবন চলে, এক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে গতিময়তা পায়, কর্মে স্থিতি আসে। শুধু তাই নয় মরণকালে সেই বিভাজনই তার অনন্ত যাত্রার মূল নির্ণায়ক হয়। মাঝে মধ্যে এর ব্যত্যয়ও ঘটে অপশক্তির স্বেচ্ছাচারিতায়। এমন অনেক শবদেহ আসে যাদের গায়ে ধর্মীয় কোন চিহ্ন থাকে না। তারা কারা? অসহায়, নির্বিত্ত সাধারণ মানুষ। যারা অন্যায়-অবিচার কিংবা অত্যাচারের শিকার হয়ে নিজের মূল্যবান জীবনকে বলি দিতে হয়েছে। শুধু ধর্মীয় বিভাজনই নয়, অর্থনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত শ্রেণী বৈষম্যও এখানে কবির শৈল্পিক চিত্তকে তাড়িত করে। আর সেই বোধেই তিনি তার কাব্যিক শৈলীকে সুনির্দিষ্ট গতিপথে ধাবিত করেন। সমাজসচেতন কবি গিরীশের এই এক অনন্য সাম্যবাদী বোধ যা তাকে দারুণভাবে তাড়িত করে সমাজের এই অনাচার আর অসংহতির বিপক্ষে। সব মিলিয়ে কবিতাগুলো সহজবোধ্য এবং সুখপাঠ্য। পাঠক সমাজে আদৃত হওয়ার মতো সমস্ত কাব্যিক আর ছান্দিক আবহ কবিতার অঙ্গ সৌষ্ঠবকে যে মাত্রায় নিয়ে যায় তা পাঠককেও আগ্রহান্বিত করে তুলবে এ আশা ব্যক্ত করাই যায়। পাঠক হৃদয়ে এই কাব্যগ্রন্থটি জায়গা করে নেবে এই কামনায় বইটির বহুল প্রচারের প্রত্যাশায়- গিরীশ গৈরিক প্রকাশক : বেহুলা বাংলা প্রচ্ছদ : আইয়ুব আল আমিন . অনার্তবা ॥ এসএম সুলায়মান কাজলের ‘অনার্তবা’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে এবারের বইমেলায়। প্রচারবিমুখ এই সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব নিজের মধ্যেই নিবিষ্ট থাকতে পছন্দ করেন। শৈশব, কৈশোর অতিক্রান্ত করে। যৌবনে পা দেয়ার সুবর্ণকালে গ্রাম বাংলা আর নাগরিক জীবনের অসম বিকাশ তার সৃজনবোধে যে যুগান্তকারী প্রভাব রাখে তার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর তার ‘অনার্তবা’ কাব্যগ্রন্থটি। সঙ্গতকারণে আবহমান পল্লীবালার নান্দনিক সম্ভার যেমন তার কবিতার অনুষঙ্গ হয়েছে একইভাবে নাগরিক জীবনের হরেক রকম টানাপোড়েন আর বিত্তবৈভবের অভিঘাত তার কাব্যগজগতকেও সমৃদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের গ্রাম আর শহরের নিরবচ্ছিন্ন বৈপরীত্যে কবি হৃদয়ের বিচিত্র অনুভূতি পাঠক সমাজকে মুগ্ধতার জায়গায় নিয়ে যাবে এ কথা বলাই যায়। নির্মল, বিশুদ্ধ আবহে হৃদয় থেকে উৎসারিত আবেগাচ্ছন্ন শৈল্পিক চৈতন্যে কবিতাগুলোর যে দীপ্ত মহিমা তা কবিরই সাবলীল সৃজনসৌধের অনন্য সুষমা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভবের দুঃখ, কষ্ট আর আনন্দের স্পর্শকাতরতায় আচ্ছন্ন কবির ভালবাসার জয়গানে কবিতাকে পূর্ণ করার যে আর্তি তাতেই ¯্রষ্টার শৈল্পিক মহিমা পাঠকের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। ‘অমর একুশ’কে নিয়ে নিবেদন করা কবিতায় ভাষা শহীদদের মর্যাদা নিয়ে কবির হৃদয়ে ক্ষতবিক্ষত এবং মর্মাহত। পূর্ণিমা-৪ কবিতায় নাগরিক জীবনের বহুতল ভবনের ফাঁকফোকরে সূর্যের মৃদু আলোকরশ্মি আলতোভাবে পরশ বুলিয়ে দেয়ার আবহ মূর্ত করা হয়েছে। ঝলমলে বৈদ্যুতিক আলোক ধারায় জ্যোৎ¯œা রাতের ¯িœগ্ধতাকে তুলে ধরার চেষ্টায় কবির আন্তরিক আবেদনও স্পষ্টতা পায়। ‘পূর্ণিমা’ এই অর্থে বিশ্বব্যাপী প্লাবিত এই আলোকের ¯িœগ্ধ ধারাই চিরন্তন যেখানে কবি নিজেকে চিরস্থায়ীভাবে সমর্পণ করেন। ভালবাসার অকৃত্রিম মহিমায় আচ্ছন্ন কবিতা গুচ্ছ, প্রেম, পূজা আর নিবেদনের এক অম্লান দীপ্তি। প্রকৃতির অপার সম্ভাবনায় নিবেদনের স্তুতিও হয়ে ওঠে নিঃশর্ত প্রেমিক হৃদয়ের অনাবিল সৌরভ। শব্দ আর বাক্যের অপূর্ব মিলনমেলায় পঙ্ক্তিগুলোর যে অনন্য আবেদন তা কবিতাপ্রেমিকদের জন্য অনবদ্য উপহার। সহজ কথা সাধারণভাবে উপস্থাপন করার কৃতিত্বের দাবিদার কবিকে সশ্রদ্ধ অর্ঘ্য। সৈনিকের কঠোর কর্মযজ্ঞের সঙ্গে সৃজন প্রতিভার অদ্ভুত সমীকরণ কবিকে যে মাত্রায় নিয়ে যায় তা সত্যিই বিস্ময়ের এবং প্রশংসনীয়। বইটির সর্বাঙ্গীণ সফলতা কামনা করছি। এসএম সুলায়মান প্রকাশক : তৃপ্তি প্রকাশ কুঠি প্রচ্ছদ : হেলাল আহমেদ মূল্য : ২০০ টাকা
×