ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নোনাজলের বেহুলারা -দীপংকর গৌতম

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

নোনাজলের বেহুলারা -দীপংকর গৌতম

রাত দুপুরে ঘরের চালে প্যাঁচায় দিলো ডাক বেনবেলা কেন মাথার পরে কা কা করে কাক। শোনো তুমি মা বনবিবি বলিগো তোমারে অভাগিনি শরণ নেলে তোমারই চরণে। (ও মা) তোমারই চরণে সুন্দর বনের ত্রাতা বনবিবি। সুন্দরবনও তার আশপাশের মানুষেরা বনবিবির নাম নিয়ে, তাকে পূজা দেয়। তারপর বনে প্রবেশ করে। তারপরও শেষ রক্ষা হয় না। তবু বনজীবীদের স্ত্রীরা যুগ যুগ ধরে বনবিবিকে সন্তুষ্ট রাখতে এ গান গেয়ে চলে। তারপরও বনজীবীরা বনে যায়। ভয়, ডর ফেলেই যায়। হঠাৎ বাঘের মুখে পড়লে করার কিছুই থাকে না। সুবিধামতো পড়লে বাঘও বনজীবীদের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে যায়। তবে সে ঘটনা হাতে গোনা। বেশিরভাগই বাঘের পেটে যায়। খবর আসে। কান্নাকাটির রোল পড়ে যায়। দোষী সাব্যস্ত হয় মৃতের স্ত্রী। নাম হয় বাঘ বিধবা। সমাজের বোঝা, অপয়া, কুলটা, রাক্ষস কত নাম তার। কারও স্বামী মারা গেলে বউ তো বিধবা হবেই। আর বিধবা তো বিধবাই। এখানে আর এক কাঠি যোগ করে বলা হয়েছে বাঘ বিধবা। যদি কোন বিবাহিত পুরুষ বাঘের পেটে চলে যায় তখন বাড়িতে তার স্ত্রী-সন্তানের কি অবস্থা হয় সেটা বলার মতো না। . সংস্কার না কুসংস্কার সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলোর একটি বড় অংশ কুসংস্কারের আঁধারে ডুবে আছে। একসময় যখন স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রীকেও সহমরণে যেতে হতো বাঘ বিধবাদের অবস্থা দেখলে সে কথাই মনে হবে শুধু। সুন্দরবনে প্রবেশের আগে বনজীবীরা ‘বনবিবি’র পূজা করে। এটা সেখানের সংস্কৃতি। কিন্তু বাকিটা শুনলে জীবন বিভীষিকায় ভরে যাবে যে কারও। তাদের মধ্যে আরও অনেক কুসংস্কারই আছে। যেমন কারও স্বামী সুন্দরবনে গেলে সেই নারী অন্য পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না, চুল আঁচড়াতে পারেন না, শরীরে তেলও মাখতে পারেন না। স্বামী যতদিন বনে থাকে, ততদিনই আলগা মাথায় চলাফেরা বারণ এদের। বন্ধ রাখতে হয় শরীরে সাবান ঘষা। বা কোন প্রসাদন ব্যবহার। রান্নার জন্য মরিচ পোড়াতে পারে না তখন। সবধরনের ভাজা-পোড়া বন্ধ রাখতে হয়। এমনকি চাল বা ডাল ভাজিও করতে পারে না তাদের স্ত্রীরা। এরপরও কারও স্বামীকে বাঘে নিলে ধরে নেয়া হয়, তার স্ত্রীর হয়ত ব্রত পালনে কোথাও গাফিলতি হয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পর তাই সমস্ত দায় তাকে বহন করতে হয়। ‘অপয়া’ অপবাদ পাওয়া এ নারীদের বেশিরভাগেরই ঠাঁই মেলে না শ্বশুরবাড়িতে। সমাজে থেকেও তাই তাদের হয়ে থাকতে হয় ‘একঘরে’। তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও দোষটা ধর্ষকের চেয়ে বিধবাদের বেশি হয়। বিচার হয় তাদের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমন ঘটনাই ঘটে। একবিংশ শতকের সমসমস্ত অন্ধকার যেন এখানে সজাগ পাথরের মতো শুয়ে আছে। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ এলাকায় গিয়ে এমনই চিত্র দেখা গেছে। কথা হয়েছে কয়েকজন ‘বাঘ বিধাবা’র সঙ্গেও। তাঁরা বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রে জীবিত থেকেও মৃতের মতো জীবন কাটাতে হচ্ছে তাঁদের। নারী সংগঠন লিডার্সের তথ্য মতে, সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় প্রায় সাড়ে এগারো শ’ বাঘ বিধবা নারী রয়েছেন। ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাঘের আক্রমণে মারা গেছেন এক হাজারেরও বেশি বনজীবী। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাঘে আক্রমণে কারও নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। অনেকেই অন্যের পাস ব্যবহার করে প্রবেশ করেন সুন্দরবনে। তাঁরা সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মারা গেলেও তাঁদের নাম সরকারী হিসাবের তালিকায় ওঠে না। কোন সাহায্যও পায় না সরকারের কাছ থেকে। . বাঘ কেড়ে নিয়েছে তার স্বামীকে ‘বাঘ বিধবা’। স্বামীর মৃত্যুর পুরো দায়ই তাদের। আর সে কারণেই তাদের কপালে জোটে ‘স্বামীখেকো’ অপবাদ। সামাজিক কোন অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতিই যেন ‘অলুক্ষণে’। ‘অপয়া’ এসব নারীদের বেশিরভাগেরই তাই ঠাঁই মেলে না শ্বশুরবাড়িতে। সমাজে থেকেও তাই তাদের হয়ে থাকতে হয় ‘একঘরে’। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বাঘের আক্রমণে নিহত ব্যক্তিদের স্ত্রীদের এমনই পরিণতি বরণ করতে হচ্ছে সুন্দরবনের আশপাশের এলাকাগুলোতে। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ এলাকায় গিয়ে এমনই চিত্র দেখা গেছে। কথা হয়েছে কয়েকজন ‘বাঘ বিধাবা’র সঙ্গেও। তারা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে জীবিত থেকেও মৃতের মতো জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। . সোনামণি সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার আলোচিত মুখ সোনামণি। তার দুই স্বামীকে জীবন দিতে হয়েছে বাঘের আক্রমণে। তার মুখ দেখলে তাই কেউ শুভ কাজে বের হয় না বলে জানান তিনি। সোনামণি আরও বলেন, ‘সকালে উঠে যেন আগে আমার মুখ দেখতে না হয়, তাই শাশুড়ি আমাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখেন। এ জীবন তো মৃত্যুর মতোই। স্বামী গেল বাঘের পেটে, আমাকেও মেরে রেখে গেল।’ . বলি দেশাই আরেক ‘বাঘ বিধবা’ বলি দেশাই বলেন, ‘আমার স্বামী ২০০২ সালে সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়। এর জন্য আমাকেই দায়ী করে নির্যাতন করতে থাকেন শাশুড়ি। এক পর্যায়ে বাড়ি থেকেই তাড়িয়ে দেন। আমার বাবা মারা গেছে অনেক আগে। তাই ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে উঠি। কিন্তু ভাইও তো গরিব, তাই নদীতে রেণু পোনা ও কাঁকড়া ধরে সংসার চালাতে শুরু করি। এভাবেই ছেলে-মেয়েদের বড় করেছি।’ . বুলি দাসী কাঁদতে কাঁদতে বুলি দাসী বলেন, ‘আমার মতো এমন অনেক মেয়ে আছে, যাদের স্বামীরা বাঘের হাতে মারা যাওয়ার পর তাদের অপয়া বলে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমার স্বামীর ছোট ভাইও বাঘের আক্রমণে মারা যায়। তার বউ দিপালিকেও বাপের বাড়ি তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। . শাহিদা খাতুন শাহিদা খাতুন জানালেন, তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে শ্বশুরবাড়ি থেকে। নদীতে জাল টেনে আর অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালান এই নারী। . কমলা রানী মন্ডল স্বামী তো গেছেই, এক দেবরও খোরাক হয়েছে বাদাবনের বাঘের। তার শ্বশুর বাসুদেব ম-ল দুই ছেলেকে বাঘে খাওয়ার দুই ঘটনারই সাক্ষী। সন্তানদের বাঘের মুখে রেখে পালিয়ে আসার ঘটনায় এখন আর চোখ ভেজে না তার। শরীরে কুলোয় না বলে বনে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন বহু দিন। তার অবস্থা এখন বাঘ বিধবা বৌমার মতোই। . সীতা রানী সীতা রানীর স্বামীকেও বাঘে নিয়েছে বছর সাতেক হলো। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার যোগাড় করতে এখন দিনরাত অমানবিক খাটুনি দিতে হয় তাকেও। তাদের মতো বাঘ বিধবারা তো নিজেদের সমাজেরই চক্ষুশূল। যে পর্বের শুরু হয় স্বামী বনে যাওয়ার শুরু থেকেই। ওই মুহূর্ত থেকেই প্রতিক্ষণের জন্যই বাঘের কবল থেকে স্বামীকে রক্ষার প্রার্থনা করতে হয় এদের। . লবণ পানির নির্মম শিকার দক্ষিণ অঞ্চল যেখানে বীজ বুনলে সোনার ফসল ফলত, গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ছিল। কিন্তু লবণ পানির চিংড়ি চাষের কারণে এখানকার মানুষ নব্বইয়ের দশকে কৃষি থেকে উৎখাত হতে থাকে, ভূমিহীন হয়ে যেতে থাকে প্রান্তিক কৃষক, বেকার হয়ে পড়ে বর্গাচাষী ও কৃষি শ্রমিক। বিপদ সংকুল সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে থাকে এলাকার মানুষ। কাজের সন্ধানে এলাকার বাসিন্দারা এলাকা ছেড়ে চলে যেতে থাকে। পেশা পরিবর্তন করতে থাকে প্রান্তিক কৃষক, বর্গাচাষী ও কৃষি শ্রমিক। সমগ্র উপকূলীয় এলাকা লবণ মরুভূমিতে পরিণত হয়। সুন্দর বনের প্রান্তসীমায় হাজার হাজার বনজীবী বসবাস করে। সুন্দরবন প্রভাবিত উপজেলাগুলোর মধ্যে শ্যামনগর একটি উল্লেখযোগ্য জনপদ। এ উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের বেশিরভাগ জনগণ সুন্দরবনের সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। এ ইউনিয়নগুলোর মধ্যে গাবুরা, মুন্সীগঞ্জ ও বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি সুন্দরবন নির্ভরশীল জনগণ বসবাস করে। এখানের ৭০% পরিবার সুন্দরবন নির্ভরশীল। পেশায় এরা সুন্দরবনের জেলে বাওয়ালী, মৌয়ালী, পোনা সংগ্রহকারী। এ সকল পরিবারের আয়ক্ষম সদস্যরা যারা সুন্দরবনে যান তারা অনেকেই বাঘের ও কুমিরের আক্রমণের শিকার হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপন্ন এক জনপদ উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন গাবুরা ইউনিয়ন। গাবুরা ইউনিয়ের চারিধারে নদী। এই দ্বীপ জনগোষ্ঠীকে সুন্দরবন, নদী এবং লবণাক্ত কৃষি জমির ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয়। আইলা দুর্গত গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রামের বাঘ বিধবা ময়না বেগম। পরিবারের সদস্য ৩ জন। ময়না বেগম বলেন, ‘লবণ পানির চিংড়ি ঘের না হলে আমি বাঘ বিধবা হতাম না। আমার স্বামী দিন মজুরির কাজ করত। স্বামী-সন্তান নিয়ে খেয়ে পরে ভাল চলছিল। এলাকার কৃষি জমিতে দৈনিক কাজ করতে পারত। কিন্তু ১৯৯০ সালের পর থেকে গাবুরা ইউনিয়নের কৃষি জমিতে লবণ পানি তুলে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। ধীরে ধীরে চিংড়ি ঘের বিস্তার লাভ করে। আমার স্বামী কাজ হারাতে থাকে আর কপাল পুড়তে শুরু করে আমারও। স্বামী কোন কাজ না পেয়ে দিনের পরদিন বেকার বসে থাকে। সংসারে অভাব কষ্ট বাড়তে থাকে। কোন উপায় না পেয়ে সুন্দরবনে মধু কাটতে যায়। একদিন সকালে মধু কাটার সময় সে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়। এরপর থেকে নদী জাল টেনে দুই ছেলে নিয়ে কোনমতে বাপের ভিটেতে বসবাস করছি। নদীতে জাল টেনে চলে আমার জীবন। আইলা দুর্গত গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রামের বাঘ বিধবা খালেদা আক্তার। পরিবারের সদস্য ৬ জন। খালেদা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী দিন মজুরির কাজ করত। স্বামী সন্তান নিয়ে খেয়ে পরে ভাল চলছিল। কিন্তু এলাকার চিংড়ি ঘের বেড়ে যাওয়ায় আমার স্বামীর কাজের অভাব দেখা দেয়। কোন উপায় না পেয়ে ২০০৩ সালে সুন্দরবনে মধু কাটতে যায়। একদিন সকালে মধু কাটার সময় সে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়। ৪ ছেলে ও ১ মেয়ে নিয়ে শুরু হয় আমার কষ্টের জীবন। নদীতে জাল টেনে, অন্যের বাড়িতে কাজ করে, জোনমজুরি দিয়ে সংসারের খরচ জোগাতে থাকি। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় বাঁধ ভেঙে লবণ পানিতে আমার ঘর বাড়ি সবকিছু ভেসে যায়। আবারও নদীতে জাল টেনে ও জোনমজুরি দিয়ে জীবন বাঁচাতে থাকি। এই লবণ পানির আগ্রাসন মানুষকে তার পেশাচ্যুত করছে। ফলে তাকে অন্য পেশায় যেতে হচ্ছে। হচ্ছে বাঘ বিধবার। বিষয়টি ভেবে দেখার।
×