ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আলী যাকের

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

 মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পূর্ব প্রকাশের পর) বয়সটি কুড়ির দশক পেরিয়ে যখন ৩০-এর দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলো তখন মনে হলো সকল রোমান্টিকতার বাইরে বেরিয়ে এখন বোধহয় সময় এসেছে জীবনের পরবর্তী ধাপ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার। প্রসঙ্গত বলে রাখি এক হিসাবে আমি সত্যিকার অর্থেই একটু সনাতনপন্থী। এখনও আমি নিজ বাসভূমে প্রচ- বিশ^াসী। বিশে^র যেখানেই যাই না কেন, যত মনোরম সেই জায়গা হোক, মন ফিরে আসতে চায় আপন ঘরের কোনে। আমার এক বিদেশী বন্ধুর একটি প্রশ্নের জবাবে আমি একবার বলেছিলাম, ‘ঐড়সব রং যিবৎব ও নবষড়হম’ ঘরই আমার প্রধান আকর্ষণ। ঘরেই আমি সবচেয়ে স্বস্তি খুঁজে পাই। কিন্তু ঘরে তো মানুষও থাকতে হয়। সেই বাল্যকাল থেকে ঘরের আকর্ষণের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন বাবা-মা এবং দিদি। তাঁরা একে একে চলে গেলেন। তারপর ছিলেন আমার বড় ভাই এবং ছোট বোন। এরাও নিজ জীবনের সঙ্গে ব্যস্ততায় জড়িয়ে পড়লে প্রাণস্পন্দনহীন কক্ষটিই আমার যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। যেন দুহাত তুলে আলিঙ্গন করত আমায় যখনই ফিরে আসতাম ঘরে। কোন দিন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডায় নিমগ্ন থাকার পর অধিক রাতে বাড়ি ফিরলে ঘরটি যেন নীরব অভিমানে আমার কানে কানে বলত, ‘এত দেরিতে ফিরলি?’ হঠাৎ মনে হলো এই ঘরকে আরও একজন সঙ্গী দেয়ার প্রয়োজন হয়েছে এখন বোধহয়। যে সঙ্গীটি হবে আমার আদর্শের পথে হাতে হাত ধরে হাঁটার সাথী। যে আমার আনন্দে উদ্বেলিত হবে, দুঃখে ভারাক্রান্ত, পরাজয়ে ম্লান, বিজয়ে উজ্জ্বল- তাকে কী করে পাই? যুক্তিবাদী আমি, সঙ্গত চিন্তায় বুঝি জীবন সঙ্গীর ব্যাপারে আমার রোমান্টিক চিন্তা-ভাবনা হয়ত বাস্তব সম্মত নয়। কিন্তু মানুষের তো আশার শেষ নেই! এ সবই ছিল তারুণ্য প্রসূত আদর্শগত ভাবনা। কিন্তু আমরা জানি এই ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের মিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকে না। অতএব, আমার স্বপ্নের সেই নারী অধরাই থেকে যায় আমার কাছে। অথচ বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে? এ রকম হতেই পারত যে, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, একাই থাকব চিরকাল। কিন্তু যে যুগের মানুষ আমরা তখন একটি ঘর এবং একজন সঙ্গী না থাকলে জীবনটাকে সম্পূর্ণ মনে হতো না। এসব চিন্তার দোলাচলে যখন আমি হাবুডুবু খাচ্ছি তখন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম চিরসঙ্গী হিসেবে আমারই সহযাত্রী সারাকে। একদিন সাহসে বুক বেঁধে প্রস্তাবও দিলাম তাকে। সারা বলল ভেবে দেখবে। ভেবে দেখবারই কথা। কেননা আমার যৌবন তখন পেরিয়ে যাচ্ছে আর ওর কেবল যৌবনের শুরু। একান্তে বলে রাখি আমাদের বয়সের ফারাক দশ বছরের। এইভাবে পেরুলো কিছুদিন। আমি হাল ছাড়িনি। একদিন কোন এক শুভক্ষণে আমার সে প্রস্তাবে রাজি হলো সে। আমি যেন হাতে স্বর্গ পেয়েছিলাম সেই দিন। অবশেষে ভবিষ্যতের একটা গতি হলো। এখানে সারা সম্বন্ধে কিছু কথা বলা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এই কথাগুলো আগে কখনও বলা হয়নি এবং কথাগুলো অনুচ্চারিত থাকলে অনেকেই হয়ত ভাবতে পারে যে আমি এ কথাগুলো না বলে তার প্রতি অবিচার করেছি। এই অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ বৈধ নয় এই কারনে যে ভুলে গেলে চলবে না আমরা একটি শিল্পকর্মের মেঠো কর্মী কেবল এবং শিল্প চর্চায় নিয়োজিত যে কোন মানুষের প্রধান ভূষণ হলো বিনয়। আমরা কেমন, কি করছি বা আমাদের অবদান কতটুকু সে সম্বন্ধে বলবেন বাইরের মানুষেরা। তবুও যখন কোন কাজ ইতিহাসে পরিণত হয় তখন সেই ইতিহাস সৃষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষদের ভেতরের কথাগুলো খুলে বলা বোধহয় প্রয়োজনীয়। এই ভূমিকাটুকু রেখে আমি এখানে সারা যাকেরের সম্বন্ধে কিছু কথা বলতে চাই। সারা যখন মঞ্চ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয় তার কিছুদিন আগেই সে তার বড় ভাইকে হারিয়েছে। তার বড় ভাই, আলাউদ্দীন মোহাম্মদ যাহীন মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ছাত্র ছিল। একদিন সকালে বাবা-মার অনুমতি নিয়ে সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য ঘর ছাড়ে তারপর আর ফিরে আসেনি। স্বাধীনতার পর অনেক খোঁজ করেও তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। যাহীন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থাতেই তুখোড় অভিনেতা ছিল। যাহীনের সেই অভিনয়ের দক্ষতা এবং ভালবাসা স্পৃষ্ট করেছিল ওর ভাই-বোন, মা-বাবা সবাইকে। বোধহয় অভিনয়ে অংশ নেয়ার উদ্দীপনা এবং উৎসাহ হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল সারাকে। যেদিন প্রথম সারা আমাদের মহড়া কক্ষে এলো সেই দিনই ওর চোখে এই নাট্য উন্মাদনার একটি অভিব্যক্তি আমি লক্ষ্য করেছিলাম। এরপর যখন সে মহড়া শুরু করল তখন তার একাগ্রতা, শৃঙ্খলাবোধ, নাটকের প্রতি ভালবাসা এবং অভিনয়ের দক্ষতা আমাদের সকলকে চমৎকৃত করে। যে কোন চরিত্রই তাকে দেয়া হোক না কেন সে অক্লান্ত পরিশ্রম করত সেই সব চরিত্রের প্রতি যথাযথ সুবিচার করতে। ১৯৭৫ এর ২০ জুন আমাদের বিয়ে হয়। সারা ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে। বিজ্ঞান বিভাগের ভাল ছাত্রী। অতএব, ছোট-খাটো এক বৈজ্ঞানিক হবে এটাই ছিল আশা। তবে নাটক ছাড়বে সে ধরনের কোন চিন্তাও কোনদিন করেনি সে। আমাদের বিয়ের আগে থেকেই বের্টল্ট ব্রেশটের সৎ মানুষের খোঁজে নাটক করার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম দল থেকে। ওই নাটকে সেন্তি এবং সুইতা (নারী এবং পুরুষ) নামের দ্বৈত চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল সারা। বাংলা রূপান্তরে ওই চরিত্র দুটির নামকরণ করা হয়েছিল ফুলি এবং ফুল মোহাম্মদ। বেশ শ্লথ গতিতে চলছিল মহড়া। এই কারণে যে ওই নাটকে ছিল অনেক চরিত্রের সমাহার। এত কুশীলব খুব সহজে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। নাটক অবশেষে তৈরী হলো। বাংলা নাম সৎ মানুষের খোঁজে। মঞ্চে যখন নাটক নামল তখন সারা অন্তঃসত্ত্বা। মনে পড়ে ওই অবস্থাতেই আমরা সৎ মানুষের খোঁজে নিয়ে গিয়েছিলাম চট্টগ্রামে। সেটা ছিল ১৯৭৬ সালের মার্চ মাস। সেখানে সেন্ট মেরীস মিলনায়তনে আমরা ৩টি নাটকের ৫টি প্রদর্শনী করেছিলাম । প্রথম দুই দিন বাকি ইতিহাস এবং ভেঁপুতে বেহাগ। আর তৃতীয় দিনে সকাল ১১টা, বিকেল ৪টা এবং সন্ধ্যা ৭টায় সৎ মানুষের খোঁজে’র তিনটি প্রদর্শনী। শরীরের ওই অবস্থা নিয়েও অনবদ্য অভিনয় করেছিল সারা। সেই সব দিনগুলোর স্মৃতি সময়ের আবর্তে ধূসর হয়ে এলেও এখন, তখন নানা কথা মনে আসে এবং অশ্রু ভারাক্রান্ত হয় হৃদয়। এই অশ্রু আনন্দের। এই অশ্রু সাফল্যের। মনে পড়ে একদিনে সৎ মানুষের খোঁজে’র তিনটি শো, প্রত্যেকটিতেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে চট্টগ্রামের নগরবাসী টিকেট সংগ্রহ করেছিল। তখন নাটকের দর্শকও ছিল এ রকম, ভাল নাটক হলে ধরেই নেয়া হতো যে হলভর্তি দর্শক আসবে। বস্তুতপক্ষে, সৎ মানুষের খোঁজে’র মঞ্চায়নের পরদিন যেখানেই গেছি সবাই আমাদেরকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। সারা’র অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অত পরিশ্রম করে নাটক করার সংবাদটি পৌঁছে গিয়েছিল ওর ডাক্তারের কাছে। মনে পড়ে চট্টগ্রাম থেকে ফিরে এসে তার সঙ্গে যখন দেখা করতে গেলাম তখন তিনি আমাদের মহা বকুনি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমাদের সৌভাগ্য যে কোন দুর্ঘটনা তখন ঘটেনি। এখন, দীর্ঘদিনের নানা অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি যে মানুষ যে কাজটি করতে ভালবাসে তাতে তার কোন বিপদ হয় না। আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি এই কথা, আমি প্রচ- অসুস্থতা নিয়েও অনেক অসম্ভব কাজ করেছি কেবল ভালবাসার জোরেই। অপ্রাসঙ্গিক হলেও এখানে একটি স্মৃতির কথা উল্লেখ করতে চাই। নুরলদীনের সারা জীবন নিয়ে কুমিল্লায় গিয়েছিলাম অভিনয় উপলক্ষে। সকাল ৮টায় যখন ঢাকা ছাড়ি তখন আমার প্রচ- জ্বর। বাসে বসে জ্বরে কাঁপছি। কুমিল্লা টাউন হলে গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন আমার জ্বর ১০৪ ডিগ্রী। কুমিল্লার তৎকালীন জেলা প্রশাসক সার্কিট হাউসে একটি বিলাসবহুল কক্ষ বরাদ্দ করে দিলেন বিশ্রম নেয়ার জন্য। কিন্তু জ্বর তো আর কমে না। জ্বর কমানোর সব রকম ওষুধ খেয়েছি কিন্তু সামান্যই কমেছে শরীরের তাপমাত্রা। বিকেলে হলে যাবার সময় যখন হলো তখনও বুঝতে পারছি না যে শেষ পর্যন্ত অভিনয় করা হয়ে উঠবে কিনা। তবুও কম্বল জড়িয়ে হলে গেলাম। আমার নাট্য বন্ধুদের মুখ ম্লান। নুরলদীনের সারা জীবনের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করি আমি। বিশাল এক ভূমিকা। এই অবস্থায় কি করে আভিনয় করা সম্ভব। অবশেষে তিনটে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট গিলে নেমে পড়লাম মঞ্চে। আমার নাটক শুরুর প্রথম সংলাপ, ‘কাঁই কইলে নাই? কাঁই কইলে নাই? নুরলদীন কি সামনে তোমার নয়?’ নুরলদীন কি সামনে তোমার নয়? তবে কান্দেন কেনে ভাই? এই সংলাপ উচ্চারনের সঙ্গে সঙ্গে দিব্যি ভুলে গেলাম যে আমি একজন জ্বরাক্রান্ত ব্যক্তি। স্বর্গ থেকে যেন উড়ে এসে এক উদ্দীপনা আমার উপর ভর করল। এই নগণ্য আমি যেন জাদুর স্পর্শে হয়ে উঠলাম নুরলদীন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো একের পর এক দৃশ্য পেরুতে লাগল। কখন নাটক শেষ হলো, সেই অমোঘ সংলাপ আমার মুখে উচ্চারিত হলো, ‘এক এ নুরলদীন যদি চলি যায় হাজার নুরলদীন তবে আসিবে বাংলায়।’ তারপর নুরলদীনের পতন এবং মৃত্যু। শেষ হলো নাটক, আমি তখন ঘেমে নেয়ে উঠেছি। কোথায় গেছে জ্বর। আমি যেন এক নতুন মানুষ। মুহুর্মুহু করতালিতে উঠে দাঁড়ায় আমি। অভিবাদন করি দর্শককে। যে কাজটি করছি তার প্রতি হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা না থাকলে কি কখনও এটা সম্ভব হয়? প্রসঙ্গত দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে আমার নিজস্ব দুই একটি কথা না বললেই নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, দুটো মানুষ যখন এক সঙ্গে বাস করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন প্রত্যেককেই তার চাওয়া থেকে কিছু ছাড় দিতে হয় এবং এই ছাড় দেয়ার মাধ্যমে উভয়ের একটি বোঝাপড়ায় পৌঁছুতে হয়। নিজের পছন্দের সবকিছু সম্বন্ধে নাছোড় বান্দা হলে তখনই পারস্পরিক সংঘাতের সৃষ্টি হয়। ’৭৬ এর নবেম্বরে আমাদের প্রথম সন্তান পুত্র ইরেশের জন্ম। (চলবে)
×