ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শোভাময় উদ্যানে প্রাণপ্রবাহ এবং বইয়ের বিকিকিনি

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

শোভাময় উদ্যানে প্রাণপ্রবাহ এবং বইয়ের বিকিকিনি

সময়ের পায়ে কি রকেটের ইনজিন! এত দ্রুত কেন সে ছুটছে? এই তো সেদিন বইমেলা শুরু হলো আর দেখতে দেখতে তার অর্ধেকটাও পেরিয়ে এলাম! বাংলা একাডেমির এই বইমেলার একটি পোশাকি নাম রয়েছে- অমর একুশে গ্রন্থমেলা। একুশে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে ভাষার মাসের প্রথম দিন থেকে এটি শুরু হয়। ভাষার প্রতি ভালোবাসা এবং ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো- প্রধানত এই দুটি উপলক্ষ। কিন্তু সেই সঙ্গে যে এটি ভাষার প্রতি দায়বদ্ধতা, ভাষার বাহক বিচিত্র বইয়ের তাৎপর্যপূর্ণ জন্মদান- এই দুটি বিষয়ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটি অনেক সময় কিছু অংশে ম্রিয়মানও হয়ে পড়ে। তাই মানহীন বইয়ে সয়লাব হয়ে যায় বইমেলা। আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব হয়ে ওঠে ভাষা নিয়ে আলাপচারিতা। গাল ভরা বুলি শুনি, তার বাস্তবায়ন সারা বছরেও দেখা যায় না। তারপরও বইপ্রেমী এবং একদা বইয়ের আলো নিয়ে নিজেকে মানুষ হিসেবে চিনতে পারাÑ এমন শিক্ষিত মানুষের জন্যে বইমেলা রীতিমতো উৎসব। মানুষ প্রাণের টান অনুভব করেন, বইমেলায় ছুটে যান। আর তরুণসমাজও বইমেলা এবং তার চারদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ও সমগ্র উদ্যান ঘিরে এক আশ্চর্য জীবনের উৎসবে মেতে ওঠে। পহেলা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবস আসে এই ফেব্রুয়ারিতেই; অর্থাৎ বইমেলা চলার মাঝেই। তাই নতুন বইয়ের সৌরভ, নতুন চিন্তার আলো, সৃষ্টির আনন্দ, জীবনের স্ফূর্তি, ভালোবাসা দেয়া ও নেয়ার তাগিদÑ সব মিলিয়ে এবং সব কিছুর কেন্দ্রে থাকে বইমেলা। . হাঁটতে চলতে চাই সতর্কতা এবার বইমেলায় যারা গেছেন তাদের বহুজনের সঙ্গে কথা বলে আমার ভাবনার সাদৃশ্য পেয়েছি। সেটি হলো এবারের বইমেলা আরো বড়, আরো পরিচ্ছন্ন, আরো ছিমছাম। এক ঘণ্টা সময়ও বাড়ানো হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানটিকে মেলার জন্য বেশ নান্দনিকভাবেই সাজানো হয়েছে। উত্তর দিকে স্বাধীনতা টাওয়ার দেখার জন্য স্বচ্ছ প্রাচীর রয়েছে। ওদিকে তাকালে চোখ আরাম পায়, বেশ একটা সুবিস্তৃত পরিসর। হৈ হট্টগোল, জনারণ্যের ভিড়ে হঠাৎ করেই প্রশান্তিলাভ ঘটে। তখন অতটা লোকের ভিড় গায়ে লাগে না। আবার কিছুটা পথ চলতে চলতে যখনই মনে হবে যে একটু হাঁপিয়ে উঠেছি, তখনই তাকিয়ে দেখবেন কাছেই কয়েক সারি সুদৃশ্য সফেদ বেঞ্চ। অবশ্য কোনো কোনোটিতে পুলিশ ভাইয়েরাও জিরিয়ে নেন। কর্তব্য পালন অনেক সময় নিরস হয়ে উঠতে পারে কারো কারো কাছে। তাই বইয়ের ভিড়ে একজন অপাঠক বাধ্য হয়ে ডিউটিতে থাকলে তার জন্য সময় কাটানো মুশকিলই বটে। সে যাক, নয়নজুড়ানো কিছু প্যাভিলিয়ন রয়েছে উদ্যানে, দূর থেকে তাকিয়ে দেখতেও ভালো লাগে। শিশুরা মজা পায় ফোয়ারা দেখে। ছোট্ট ফোয়ারা তবু তাকে কেন্দ্র করে বৃত্ত বাড়ে শিশু ও অভিভাবকদের। ছবি তোলার দারুণ সুযোগ কেউই হাতছাড়া করেন না। সব মিলিয়ে কি মনে হচ্ছে না, এরকম একটি জায়গায় রোজ বিকেলে কেন বেড়াতে যাচ্ছি না? তবে কিঞ্চিত বিপদও রয়েছে। যারা একটু বয়স্ক, এবং দৃষ্টিশক্তির কিছুটা কমতি আছে, তাদের জন্য এই মেলায় হাঁটাচলা একটু বিশেষ সতর্কতা ও হিসেব দাবি করে বৈকি। বইমেলায় রয়েছে খানাখন্দ, গর্ত, অসমান পায়ে চলার পথ, ছড়ানো ছিটানো ইটের টুকরো ও অন্যান্য দ্রব্য- সব মিলিয়ে পা হড়কানো বা পা মচকানোর জন্য মোক্ষম জায়গা। গত বছরও এমনটাই ছিল নাকি? কী জানি! এ বছর আমি বোধহয় একটু বেশিই সতর্কতা দেখাচ্ছি অসমান সড়কে হাঁটার চড়া মাশুল দিয়েছি বলে। (১৩ ফেব্রুয়ারির একটি ছবি দেখুন, কীভাবে ছড়িয়ে রয়েছে ইট!) . অনন্য ব্যতিক্রমী বেশ কয়েক বছর নতুন একটা নিয়ম আমরা দেখছি। দেশের প্রধানমন্ত্রী বইমেলা উদ্বোধন করতে আসেনÑ এটি অবশ্য বহু বছর ধরে হয়ে আসছে। কিন্তু বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের হাতে তিনি পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন মেলা উদ্বোধনের আগেই বা বলা ভালো লেখকদের পুরস্কৃত করার পর লেখকসমাজের সৃজনশীল বা মননশীল সৃষ্টিসম্ভার প্রদর্শন ও বিক্রির দ্বার উন্মোচন হচ্ছেÑ এটি বিগত কয়েক বছর ধরে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। অবশ্যই সব মিলিয়ে এ এক অনন্য ব্যতিক্রমী ঘটনা। তবে এটা ঠিক যে, মলা উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব শেষ করে চলে না যাওয়া পর্যন্ত মেলায় সর্বসাধারণ প্রবেশ করতে পারেন না। তাই বইমেলার প্রথম দিন মানেই সন্ধ্যার পর প্রবেশাধিকার পাওয়া। সেদিন বহু স্টল নির্মাণের কাজ অসমাপ্ত থাকা স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। আধা ঘণ্টার জন্য সদ্য নির্মিত ‘কাঁচা’ বইয়ের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে না যাওয়া পর্যন্ত স্বস্তি মেলে না। গত কয়েকবারের মতো বইমেলা দু’খানা (একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) হলেও দুটোই আয়তনে/পরিমাণে যথেষ্ট বেড়েছে। তাই ‘দুইস্তরে বিন্যস্ত’ বইমেলা একদিনে আদ্যোপান্ত ঘুরে দেখা অসম্ভব। দশকের পর দশক ধরে মেলায় ঘোরার ‘পারদর্শিতা’ থেকে এটুকু বলতেই পারি যে প্রায় গোটা মেলাই এক ঝলক শুধু ঘুরে দেখতেই অন্তত দুটো দিন মেলায় যেতে হবে। আর বই বাছাই করার জন্যে কমপক্ষে চার-পাঁচ দিন মেলায় যেতে হবে। যদিও বহু মানুষ ফেব্রুয়ারির ২৮ দিনই যান বইমেলায়। এই নেশার হাত থেকে তাদের মুক্তি নেই। টিএসসি প্রান্ত দিয়ে বইমেলায় প্রবেশ করতে গেলে সার বাঁধা হুইল চেয়ার চোখে পড়ে। সেগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একদল অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে। বয়স্ক কিংবা হাঁটা চলায় সমস্যা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের কেউ কেউ এইসব হুইল চেয়ারে চড়ছেন- যদিও সংখ্যায় খুবই কম। তবু এই সুবিধাটি থাকা বইমেলা ব্যবস্থাপনার একটি ইতিবাচক দিক। পথ তো কম নয়। অবশ্য মেলার গেটে নামলেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকতে গেলে বেশকিছুটা পথ হাঁটতেই হবে। তারপর ভেতরে আবার উদ্যানের অনেকটা জায়গা নিয়ে বইমেলা। পুরোটা এক চক্কর দেয়া সত্তরোর্ধ বহুজনের পক্ষেই অসম্ভব। অথচ কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নেয়া প্রবীণদেরই পাঠের অবকাশ তুলনামূলকভাবে বেশি। শুধু তারাই তো নন, ঢাকায় থেকেও অনেক পাঠকের পক্ষে মেলায় আসা সম্ভব হয় না নানা কারণেই। ঢাকার বাইরের পাঠকদের কথাও বলতে হবে। তাদের পাঠপিপাসা মেটাতে মেলায় গিয়ে যাচাই বাছাই না করতে পারার কারণে পত্রপত্রিকা আর টিভি মিডিয়ার ওপরেই নির্ভর করতে হয়। হাজার হাজার নতুন বইয়ের ভেতর মানসম্পন্ন ভাল বইগুলো নির্বাচন করা খুব সহজ নয়। এই দায়িত্বশীল কাজটি সাংবাদিকের কাছ থেকে অবশ্য আশাও করতে পারি না। এটা সাহিত্য সম্পাদক ও বোদ্ধা লেখক-সমালোচকরা পারেন। এমনিতেই আমাদের ভেতর বই কেনার প্রবণতা কম। বই কিনে কেউ ঠকলে একজন সম্ভাব্য ক্রেতা-পাঠক হারানোর ঝুঁকি থাকে। তাই বই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বয়স্ক অভিজ্ঞ ব্যক্তি সেক্ষেত্রে বই নির্বাচনে সহায়ক হতে পারেন। নিরাপত্তার স্বার্থে সড়ক বন্ধ রাখা হলেও যাতে বয়স্কজনেরা একেবারে উদ্যানের প্রধান ফটক পর্যন্ত না হেঁটে কিভাবে মেলায় আসতে পারেন সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখার অনুরোধ জানাই। . বইয়ের ব্যাগও ফেলনা নয় বই তো বিক্রি করলেন, সেটি ক্রেতাকে তুলে দেয়ার জন্য চাই প্যাকেট ও ব্যাগ। এ থেকেও রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে। কাগজের প্যাকেটে বিজ্ঞাপনের হাওয়াও এসে লেগেছে। সময় প্রকাশন প্যাকেটে শুধু এক পাশের পুরোটাই নয়, সামনের পাশেও কলম কোম্পানির বিজ্ঞাপনের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। ব্যাগের ভেতরে ৪০০ পাতার বইও নিতে হয়। সেক্ষেত্রে ব্যাগের নিচে মানে তলায়ও কয়েক ইঞ্চি প্রস্থ থাকা জরুরি। গোটা মেলায় এমন ব্যাগ দেখলাম শুধু পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সেই। পাটের তৈরি ব্যাগও শুধু তাদেরই। বিনি পয়সার পাওয়া ‘বিকাশের ব্যাগ’ দেদার ব্যবহার করার প্রবণতা দেখছি কিছু নামী প্রকাশনা সংস্থার ভেতরেও। তাতে প্রকাশনার ব্র্যান্ডিং হচ্ছে না। কোন কোন প্রকাশক নিজেদের সেøাগান দিয়ে ব্যাগ তৈরি করে নিয়েছেন। যেমন আগামী প্রকাশনী গেরুয়া বরণ সিনথেটিক ব্যাগে ‘মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তচেতনা/দুয়ের প্রত্যয়ে আমাদের প্রকাশনা’ কথা কয়টি লিখে দিয়েছে। প্রতিটি মেলায় বড় বড় প্রকাশকেরা ৫০ থেকে ১০০ নতুন বই নিয়ে আসেন। এছাড়াও থাকে পুরনো বহু বই। অথচ সেই বই কিভাবে পাঠক বাড়ি নিয়ে যাবেন সেটি বিশেষভাবে ভাবা হয় না। ব্যাগও যে গুরুত্বপূর্ণ, তার প্রতিফলন খুব একটা দেখা যায় না। এটা দুঃখজনক। . আড্ডার পরিবেশ অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়নের সামনে পয়লা ফাল্গুন কয়েকজন তরুণ লেখক আড্ডা দিচ্ছিলেন। একজন কফি খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু উপায়হীন সবাই। এক পাঠিকা প্রস্তাব করলেন, চলুন সবাই মিলে মহাপরিচালককে অনুরোধ করি যাতে এই মেলার ভেতরে অন্তত কয়েকটি কফি কর্নারের ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। তবে একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। বড় বড় সব প্রকাশনা সংস্থা তাদের স্টলের ভেতর ফ্লাস্কে চা রাখছেন, সঙ্গে নাস্তাও। লেখকদের আপ্যায়ন করছেন তারা। মাওলা ব্রাদার্স, এ্যাডর্ন, জার্নিম্যান বুকস-সহ কয়েকটি প্যাভিলিয়ন/ স্টলের সামনে বা ভেতরে বেশ ফাঁকা জায়গা। সেখানে লেখকরা বসছেন, গল্প করছেন এবং চা-নাস্তা খাওয়াও চলছে। এ্যাডর্ন প্রকাশক প্রতিদিনই তাঁর স্টলের সামনে দিয়ে যাওয়া কবি-লেখকদের কাউকে কাউকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন ফেসবুক লাইভে। তিনি প্রকাশক থেকে সাক্ষাতকার গ্রহণকারীর ভূমিকা নিচ্ছেন। মন্দ নয়। একুশে ফেব্রুয়ারির কথা আলাদা। সেদিন থাকে মহাভীড়। বাদবাকি দিন মেলায় গায়ে গা লাগিয়ে চলা, ঠেলাঠেলি এসব সাবেক হয়ে গেছে। এখন বিস্তৃত সুপরিসর। এমন স্পেসও মেলায় রয়েছে যেখানে সান্ধ্যকালীন হাঁটাহাঁটিও সেরে নেয়া যায় ইচ্ছে করলে। তাতে অন্য কারোরই বিন্দুমাত্র অসুবিধে হবে না। সত্যিকারের বইপ্রেমী ও ক্রেতাদের জন্য এবারের মূল মেলাটি প্রকৃত বান্ধব হয়ে উঠেছে। এই যে আমি ‘মূল মেলা’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করলাম, তাতে মনে হতে পারে দশকের পর দশক ধরে চলা মেলার ভেনু বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণটিকে গৌণ করে তুলছি। তা নয়, মানি আর নাই মানি মেলা এখন স্পষ্টত দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। শুধু বই আর অন্যান্য প্রকাশনার জন্য একাডেমি প্রাঙ্গণেও পাঠককে যেতে হচ্ছে। কেননা ওখানে আছে নবীন-তরুণ লেখকদের আত্মপ্রকাশ ও দাঁড়াবার মাধ্যম লিটল ম্যাগাজিন বা ছোট কাগজ। যদি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বইমেলার ভেতর সংকুলান করা যেত লিটল ম্যাগাজিনের স্টলগুলোকে তবে অক্ষরকেন্দ্রিক মেলাটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতো উদ্যানে। আর কথা ও গানকেন্দ্রিক আয়োজনটি হতে পারতো একাডেমি প্রাঙ্গণে। এমনটা হলে আর বিভক্ত বা বিচ্ছিন্ন মনে হতো না মেলাকে। যারা বইয়ের জন্য বইমেলায় যান তাদেরও সুবিধে হতো, আর যারা শুধু ঘোরাফেরা, গান শোনা উৎসব-উৎসব পরিবেশের মধ্যে আনন্দ পেতে চান তাদেরও সুবিধে হতো। . বই নির্বাচনের সুবর্ণ সময় এখনই মেলার শেষ দিনগুলোতে পড়ুয়ারা বেছে বেছে বই কেনেন। নিজ পাঠপ্রবণতা অনুযায়ী উৎকৃষ্ট বইটি সংগ্রহের জন্যে একুশ-পরবর্তী ছিমছাম ভিড়হীন মেলা বেশ উপযুক্ত। যারা বইমেলাকে ভালোবেসে মেলার সর্বাঙ্গীণ সৌন্দর্য ও সুস্বাস্থ্য সম্বন্ধে ভাবেন এবং লেখায় বা আলাপনে তার প্রকাশ ঘটান, তাদের অনেকেই চান বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে বই কিনে না ঠকতে। মেলায় নবাগত প্রকাশকদের কথাও বলা চাই। মিডিয়ায় দেখছি কেবল বড় বড় প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধারদের ছবি আর বক্তব্য। ‘ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের’ দিকে কারো নজর নেই। সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশকে পেশা হিসেবে যারা গ্রহণ করছেন, কিংবা বলতে পারি মূল পেশার বাইরে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকির বিষয়টি জানা সত্ত্বেও গ্রন্থ প্রকাশকে যারা দায়িত্বশীল কাজ বলে মনে করছেন তাদের দুয়েকজনের বক্তব্য মিডিয়ায় আসা দরকার। তার পাশাপাশি খেদের সঙ্গেই বলতে চাই, ইতোপূর্বে জনকণ্ঠের নিয়মিত কলাম ‘ঢাকার দিনরাত’-য়েও কিছুটা বলেছি, সিনিয়র প্রকাশকদের ভেতর টাকা নিয়ে মানহীন বই বের করার মানসিকতা। প্রবাসে দীর্ঘকাল লেখালেখি করেও যেসব লেখক ন্যূনতম মানসম্পন্ন লেখক হয়ে ওঠেননি এমন অনেকেরই পকেটের টাকায় দেশের নামী-দামী প্রতিষ্ঠান থেকে স্বরচিত বইটি বেরিয়ে আসছে। এটা দুঃখজনক। বছর তিনেক আগে আমরা জনকণ্ঠে কিছু গঠনমূলক প্রস্তাব রেখেছিলাম। লিখে যে কিছু কাজ হয় না, এটা ঠিক নয়। আমরা লেখার পর কাজ তো কিছু হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তথা বইয়ের মূল মেলায় শিশুতোষ বইয়ের প্রকাশকদের পৃথক প্রাঙ্গণ করা হয়েছে। সেখানকার পরিবেশ শিশুদের আকর্ষণও করছে। . নতুন বইয়ের খবর জানাতে ফেসবুক প্রকাশকদের পাশাপাশি আজকের লেখকেরা নিজের সদ্যপ্রকাশিত বইয়ের প্রচারের জন্য ফেসবুক ব্যবহার করছেন ভালোভাবেই। কথাসাহিত্যিক-অনুবাদক আফসানা বেগমের ফেসবুক পোস্টে লেখকদের নতুন বইয়ের বিজ্ঞাপন ও খবর ফলাও করে প্রচার এবং তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে একটা চিত্র পাওয়া যায়। এতে যেমন রয়েছে রঙ্গরস, তেমনি রয়েছে ব্যঙ্গবিদ্রƒপ। ‘ফেসবুকের মেলা (যার জন্য প্রযোজ্য)’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন : ‘কেউ বলেন, ফেসবুকে যত লাইক, তার দশ ভাগের এক ভাগ লোকও যদি বইটা কিনত! হায় হায়, লাইক ছুঁলেই যদি বই কিনতে হয়, তাহলে কি প্রচ্ছদের নিচে (অন্তত আমারটায়) একটাও লাইক থাকত? তবে আশার কথা হলো, এখনো এমন দিন আসেনি যে মেলার স্টলে গিয়েও পাঠক কেবল বইগুলোতে আঙুল ছুঁয়ে লাইক দিয়ে আর চড়া অথচ আবেগী গলায় ‘অভিনন্দন, হে,’ বলে রাস্তা মাপছেন... ইস্! বিভিন্ন প্রচ্ছদের নিচে প্রচুর অভিনন্দন আর শুভকামনা দেখে কেউ বিরক্ত। আশ্চর্য, আপনি কি ধরে নিয়েছেন নতুন বই বেরিয়েছে বলে অভিনন্দন জানালেই আপনার বইটা কিনতে হবে? মানুষ আনন্দ-বেদনায় তাল মেলাচ্ছেন, ভার্চুয়ালি ‘আহা বেশ বেশ বেশ’ বলছেন, সেটা দেখতেই বাস্তবে এত প্রত্যাশা (বা লোভ) গজিয়ে গেল? একজন লেখক নিজের বই বুকে চেপে ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, চাতকের মতো চেয়ে আছেন মাইক্রোফোনের দিকে, লাইনের পিছনের দিক থেকে অপেক্ষারত অন্য লেখকের ধাক্কা আসছে, সুযোগ পেতেই লেখক বইটা তুলে ধরে নিজের গুণগান করছেন... এরকম কুৎসিত দৃশ্য বলতে গেলে কমই হয়। চোখের সামনে পড়লে মিলিয়ে নিতে পারেন।’
×