ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনী বছরের অর্থনীতি ॥ কালো টাকার মহড়া হবে কি?

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

নির্বাচনী বছরের অর্থনীতি ॥ কালো টাকার মহড়া হবে কি?

২০১৮ সালটি নির্বাচনের বছর। মাননীয় অর্থমন্ত্রী সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, এ বছর ‘কালো’ টাকার খেলা হতে পারে। প্রশ্ন, যদি হয় তাহলে অর্থনীতির অবস্থা কী দাঁড়াবে, সাধারণ মানুষের অবস্থাইবা কী হবে? বিপরীতে ‘কালো’ টাকার খেলা যদি না হয় তাহলে অর্থনৈতিক অবস্থা কী দাঁড়াবে? বলাবাহুল্য, এসব এখন আলোচনার বিষয়। অতএব, দেখা যাক ২০১৮ সাল কেমন যাবে। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে নয়, অর্থনৈতিকভাবে। ঘটনাক্রমে ২০১৮ ক্যালেন্ডার বছর। অর্থনৈতিক বছর আমাদের ভিন্ন। সেই হিসাব হয় জুলাই-জুন ধরে। জুলাই মাসে আর্থিক বছর শুরু হয়, জুনে হয় শেষ। অতএব, বলাইবাহুল্য ২০১৮ সালে দুটো অর্থবছর পড়বে। জানুয়ারি থেকে জুন পড়বে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের মধ্যে এবং নির্বাচনের কাছাকাছি সময় পড়বে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর জুলাই মাসে শুরু হবে। এর কিছুই আমরা এখনও জানি না। কিঞ্চিৎ জানি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের অবস্থা। এই অর্থবছরের ৭ মাস চলে গেছে। এখন ফেব্রুয়ারি মাস, তাও যায় যায়। মোটামুটি এই ৮ মাসের পরিস্থিতি বিচারে যা মনে হচ্ছে তাতে বলাই যায় বছরটি মোটামুটি স্থিতিশীল। অর্থনীতির বড় সূচকগুলোতে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না, যা দিয়ে বলা যায় আমরা অস্বস্তির মধ্যে পড়েছি। বরং দুই-একটা ঘটনা বেশ অনুকূলেই। যেমন ‘রেমিটেন্স’। ‘রেমিটেন্স’ অনেকদিন খারাপ অবস্থায় থেকে জানুয়ারি মাসে বেশ বেড়েছে। এর অনেক কারণ। একটি কারণ অবশ্যই ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। ডলারের দাম এখন ৮৪-৮৫ টাকা। এতদিন এর দাম ছিল ৮০-৮১ টাকার মতো। ডলারের উচ্চমূল্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিগুলোতে তুলনামূলক স্বস্তি নেমে আসায় রেমিটেন্সের পরিমাণ আবার বৃদ্ধির দিকে। অবশ্য এই বৃদ্ধির বিষয়টি আরও কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে রফতানি আয়েরও উন্নতি হয়েছে। অবশ্য রফতানি আয় আমাদের মোটামুটি উপরের দিকেই স্থিতিশীল। রেমিটেন্স এবং রফতানি আয় বাদে আরেকটি সূচকের অবস্থাও সরকারীভাবে ভাল। আর সেটা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির অঙ্কও সহনশীল পর্যায়ে আছে, যদিও খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। বিশেষ করে এই ফাল্গুন মাসে চালের দাম বাড়তির দিকে। সবজির দাম কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। মজার বিষয়, শীত শেষে বসন্তের সময় তা হয়েছে। এখনও দুই-আড়াই মাস বাকি নতুন বাংলা বছরের। বৈশাখের দিকে বোরো উঠতে শুরু করে। অতএব, এই সময়টা চালের সরবরাহের দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। চালকলের মালিকরা ওঁৎ পেতে বসে থাকে- কখন একটা ‘দান’ মারা যায়। সরকারের হাতে যেহেতু এখন ভাল পরিমাণ চালের স্টক আছে এবং যেহেতু মাছ-মাংসের সরবরাহ পরিস্থিতি ভাল তাই সঙ্কটাবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা খুব বেশি সফল হবে বলে মনে হয় না। তবে দুটো খবর ভাল নয়। একটি হচ্ছে আমদানি এবং আমদানি সংশ্লিষ্ট ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্টের’ খবর। দ্বিতীয়টি হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধির খবর। আমাদের রফতানি যেভাবে বাড়ে সাধারণভাবে আমদানি বাড়ে তার চেয়ে অনেক বেশি। গত ৮ মাসে আমদানি বেড়েছে অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের কিছুটা উর্ধগতি, চাল আমদানি, সরকারী মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি এবং রূপপুর আণবিক কেন্দ্রের জন্য বড় একটি আমদানি ঋণপত্র খোলা ইত্যাদিই আমদানি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কারণ। কিন্তু এর ফল হয়েছে দুটো: ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’-এর নেতিবাচক অবস্থান। বহুদিন আমরা ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্টে’ উদ্বৃত্ত ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে তা আবার ঘাটতিতে পর্যবসিত হয়েছে। এসব কারণে নির্বাচনের বছরের প্রথমদিনেই মূল্যস্ফীতির ওপর বড় চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে হাজির হয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যা। জাতিসংঘ বলছে মাসে ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা দরকার। এই টাকা দাতাদের দেয়ার কথা। কিন্তু তাদের মধ্যে উৎসাহের এখন ভাটা পড়েছে। তার মানে এর বোঝা বাংলাদেশের ওপর পড়বে। এমনিতেই সরকারের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হচ্ছে না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের খাওয়ানো-পরানোর জন্য মাসে মাসে চলে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে এই চাপ সরকারকে সামলাতে হচ্ছে। দৃশ্যত সরকারের অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সরকারের হাতে রয়েছে অনেক অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মেগা প্রকল্প। এর মধ্যে পদ্মা সেতু অন্যতম। এর জন্য বিপুল টাকার ঋণপত্র খুলতে হয়। অতএব, বলাই যায় এই চাপ নিয়েই ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষ হবে। অবশ্য সরকার কিছুটা স্বস্তি পাবে। আইটি খাতে তরঙ্গ নিলাম করে সরকার হাজার পাঁচেক কোটি টাকা আয় করতে পারবে বলে খবর বেরিয়েছে। নির্বাচনের বছরের শেষের ছয় মাস যখন ২০১৮-১৯ অর্থবছর চালু থাকবে তখনকার অবস্থা এই মুহূর্তে বলা একটু কঠিন। তবে উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়েই আগামী জুলাই মাসে নতুন অর্থবছর শুরু হবে। নির্বাচনের বছর সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের চাপ বাড়ে। তারা তখন সবাই চায় এলাকার জন্য বেশি বেশি বরাদ্দ। নানা ধরনের প্রকল্প তারা তৈরি করে। এর অর্থ এসব গৃহীত হলে বাজেটের আকার বড় হবে। অর্থমন্ত্রী এমনিতেই বড় বাজেট দেন। সংসদ সদস্যদের সন্তুষ্টির জন্য তিনি আগামী বছর আরও বড় বাজেট দিতে পারেন। বড় বাজেটে কোন অসুবিধা নেই। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্য বাজেট আরও বড় হতে পারে বৈকি! কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। নির্বাচনের বছরে অর্থমন্ত্রী নতুন কর আদায়ে উদ্যোগী হতে পারবেন না। বাজেটকে হতে হবে জনপ্রিয় বাজেট। ভ্যাট থেকে নতুন কিছু আশা করার কারণেই এই আইন বাস্তবায়নের সময় পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্য নানা কারিগরি ‘রাজস্ব বোর্ডের’ কাছে থাকে। তারা ‘কায়দা’ করে ভ্যাট আইনের নানা পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে পারে। কিন্তু তবু নির্বাচনের বছরে বেশি রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করা কঠিন। বরং প্রায় সকলকেই কিছু না কিছু স্বস্তি দিতে হতে পারে। অতএব, বড় বাজেটের টাকা যোগাড় করা কঠিন হবে। অবশ্য পথ একটা আছে। ‘ঘাটতি ফিন্যান্সিং’ বৃদ্ধি করা। এটা আর্থিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। সরকার এদিকে যাবে কিনা তা চিন্তার বিষয়। চিন্তার বিষয় আরেকটি আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে অনেক হিসাবই নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা আন্তর্জাতিক বাজারের তেলের কম মূল্যকে একটা বড় ‘ডিভিডেন্ড’ হিসেবে এতদিন পেয়েছি। এখন দেখা যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি একটু নড়াচড়া করছে। মার্কিন অর্থনীতির একটু উন্নতি হচ্ছে। জিনিসের দাম কিছুটা বাড়তে পারে যদি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পায়। অবশ্য দুশ্চিন্তার বিষয় আরেকটি আছে। আগামী মাসের দিকে বাংলাদেশ ‘নি¤œ মধ্যম আয়ের’ দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে বলে ব্যাপক আশাবাদ আছে। এটা ভীষণ আনন্দের কথা। আমাদের কূটনৈতিক বিশ্বের কুষ্মান্ড হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিল ‘বটমলেস বাসকেট’। সেই ‘বটমলেস বাসকেট’ হচ্ছে ‘বাসকেটফুল’। এটা ভীষণ ভীষণ আনন্দের খবর। যদিও এই খবরের সঙ্গে লুকিয়ে আছে কিছু চ্যালেঞ্জের বিষয়। সাহায্য ও ঋণ প্রাপ্তিতে আমাদের এখন থেকে সুদ বেশি দিতে হবে। রফতানি ক্ষেত্রে আমরা যেসব সুবিধা পাই ধীরে ধীরে তার অবলুপ্তি ঘটবে। হিসাব করে বলা হচ্ছে পাঁচ শতাংশের মতো রফতানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এসবের চাপ কিন্তু নির্বাচনের বছরই শুরু হবে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা অবশ্য ‘এক্সেস লিক্যুইডিটি’। যারা নির্বাচন করবেন তারা টাকা নিয়ে নামবেন। আমরা জানি নির্বাচনের টাকার কোন হিসাব নেই। এসব টাকা ‘কর পরিশোধিত’ টাকা নয়। যে কারণে অর্থমন্ত্রী কালো টাকার কথা বলেছেন। এই টাকা বাজারে খরচ করা হবে। কালো টাকা বা কর পরিশোধ না করা টাকা বাজারে সব সময়ই আছে। বস্তুত বাজারে খরচের টাকার একটা বড় অংশই কর পরিশোধিত নয়। নির্বাচনের প্রাক্কালে ওই টাকা বাজারে আসবে আরও বেশি। কত টাকা? এর হিসাব দেয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তবে একটা অনুমান করা যায়। ৩০০ আসনে যদি ‘জাঁদরেল’ প্রার্থী থাকে তিনজন করে, তাহলে প্রার্থী হয় ৯০০। প্রত্যেকে এক কোটি করে খরচ করলেও খরচ হয় ৯০০ কোটি টাকা। আমরা জানি বাংলাদেশে এক কোটি টাকার নির্বাচন হয় না। কেউ বলে ১০ কোটি টাকা লাগে, কেউ বলে ২০ কোটি টাকা লাগে। যদি ১০ কোটি ধরা হয় তাহলে ৯ হাজার কোটি টাকা নির্বাচনে খরচ হবে। বিশাল পরিমাণ টাকা। শোনা যায় এই টাকা খরচ এখনই শুরু হয়ে গেছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা এলাকায় যোগাযোগ শুরু করেছেন। প্রশ্ন, এই টাকার উৎস কী? বলা বড়ই মুশকিল। তবে এসব টাকা যে ‘কর পরিশোধিত’ নয় তা নিশ্চিত করে বলা যায়। কিছু টাকা বিদেশ থেকে আসবে। কারণ প্রার্থীদের বেশিরভাগই হবেন বড় বড় ব্যবসায়ী। তাদের অনেকেরই বিদেশে টাকা আছে। তাদের দেশের ভেতর ‘বিজনেস এ্যাকাউন্ট’ আছে। এর মাধ্যমেও সংঘটিত হবে অনেক লেনদেন। ‘ধরার’ কোন কায়দা নেই। বিভিন্ন দল খরচ করবে কোটি কোটি টাকা। সব মিলিয়ে টাকার ‘মচ্ছব’ হবে নির্বাচনের বছরে, বিশেষ করে ২০১৮ সালের শেষের দুই-তিন মাসে। এই ‘ক্যাশ স্পেন্ডিং’-এর ফলে গ্রামের অর্থনীতি উজ্জীবিত হবে। হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীর দিন চলবে ভাল। হোটেল-রেস্তরাঁর ব্যবসা হবে রমরমা। জামা-কাপড়ের ব্যবসা হবে, গেঞ্জির ব্যবসা হবে। গরিবের মধ্যে বেশ কিছু ক্যাশ টাকা বিতরণ হবে। খাওয়া-দাওয়া, শাহী ভোজ হবে। ভোটারদের অনেকেই প্রার্থীর দেয়া ভোজে অংশগ্রহণ করবেন। মাইকের ব্যবসা হবে। কাগজ, কলম, প্রিন্টিং, পোস্টার, লিফলেটের ব্যবসা হবে। গ্রামীণ পরিবহনে জোয়ার আসবে। শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ হবে। ক্যাশ আদান-প্রদান বাড়বে। এক কথায় নির্বাচনের অর্থনীতি হবে জমজমাট। লক্ষণীয়, আমাদের দেশে নির্বাচন একটা উৎসব। গ্রামের মানুষ নির্বাচনের সময় জেগে ওঠে। তার ‘দাম’ বাড়ে। বাড়ে পাঁচ বছর পর। ‘দাম’ অর্থমূল্যেও হয়। এসব খরচও কিন্তু মূল্যস্ফীতির কারণ হতে পারে। যারা খরচ করবেন পরবর্তী সময়ে তারা সুদে-আসলে আদায় করবেন। এর আর্থিক মূল্য ‘বিলিয়ন বিলিয়ন’ টাকা। তাই নয় কী? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×