ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আজ ঢাকায় দুদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক

রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদে তোপের মুখে মিয়ানমার

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদে তোপের মুখে মিয়ানমার

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি এখনও অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে। এ অবস্থায়ও মানবাধিকার কাউন্সিলের তদন্ত দলকে রাখাইন রাজ্যে প্রবেশের অনুমতি না দেয়ায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সফর করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। অপরদিকে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় নিরাপত্তা পরিষদকে দুষছে যুক্তরাষ্ট্র। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে আজ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ বৈঠকে যোগ দিতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছেছেন মিয়ানমারের ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। বাংলাদেশের পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং মিয়ানমারের পক্ষে সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কৈ শোয়ে নেতৃত্ব দেবেন বলে সরকারী সূত্রে জানানো হয়েছে। সূত্র জানায়, এ বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, ইয়াবা চোরাচালান বন্ধ ও দুদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়টিও প্রাধান্য পাবে বলে সূত্রে জানানো হয়েছে। এদিকে পার্বত্য বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্তের ওপারে জিরো লাইনে আশ্রিত রোহিঙ্গারা প্রাণবয়ে রাতের আঁধারে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেছে। বুধবার ভোর রাতে অনুপ্রবেশ করেছে ২২ রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশু। এরা উখিয়ার বালুখালী কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষীদের নজর ফাঁকি দিয়ে এরা ন্যোমনসল্যান্ড থেকে বাংলাদেশ সীমানায় অনুপ্রবেশ করে। বর্তমানে তমব্রু সীমান্তের ওপারে এখনও ৬ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা আতঙ্কিত অবস্থায় রয়েছে। এদের মিয়ানমার সেনা ও পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করে পরবর্তীতে ফাঁকা গুলি ছোড়ে এলাকা ছাড়ার হুমকি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গা বিষয়ক আলোচনায় মিয়ানমারের কঠোর সমালোচনা করেছে সদস্য দেশগুলো। একই সঙ্গে নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়েছে। সাড়ে তিন ঘণ্টার এই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, বলিভিয়াসহ ১২টি দেশের স্থায়ী প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন। সভাপতিত্ব করেন কুয়েতের রাষ্ট্রদূত শেখ সাবাহ খালিদ আল হামাদ। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব মিরোস্ল্যাভ জেনকা বলেন, রাখাইন প্রদেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে। সেখানে জাতিসংঘ কর্মকর্তাসহ অন্যদের প্রবেশাধিকার দিতে হবে এবং রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে মিয়ানমার সরকারকে। মিরোস্ল্যাভ বলেন, ইতোমধ্যেই ঘটে যাওয়া নৃশংসতার অনেক ঘটনাই ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। এখনও যারা পৈত্রিক ভিটেমাটি আঁকড়ে রাখার চেষ্টায় রয়েছে, সেই রোহিঙ্গারা কী ধরনের হুমকি-ধমকি সহ্য করছেন, সেটিও খতিয়ে দেখার অবকাশ রয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে ভিডিও কনফারেন্সে বৈঠকে যোগ দিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটান। তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে সৃষ্ট এ সঙ্কটের সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। গত ৬ মাসে ৬ লাখ ৮৮ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গার বাংলাদেশ আশ্রয় পাওয়ার তথ্য জানিয়ে গ্রান্ডি বলেন, শরণার্থীদের নিরাপদে নিজ আবাস ভূমিতে প্রত্যাবর্তনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আন্তরিক অর্থে সোচ্চার হওয়া দরকার। এই দফায় আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও প্রত্যাবাসন এখনও শুরু হয়নি। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আগে তাদের ফেরানোর ক্ষেত্রে আপত্তি রয়েছে জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর। যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি নিকি হ্যালি মিয়ানমারে গ্রেফতার দুই সাংবাদিকের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার আহ্বানও জানিয়েছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা অব্যাহত রাখার তাগিদ দিয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আশা করে, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা পরিষদ অব্যাহত ভূমিকা পালন করবে। রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করার কৌশল ॥ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেও এখনও দেশটির রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করার কৌশল প্রত্যাহার করেনি বলে জানা গেছে। উত্তর রাখাইনে যেসব গ্রামে এখনও রোহিঙ্গারা রয়ে গেছে, সেসব গ্রাম অবরোধ করে রেখে সেনা সদস্যরা নানান ধরনের হুমকি দিচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে সীমান্তের ওপার থেকে। গ্রামগুলো থেকে কোন রোহিঙ্গাকে বাইরে যেতে দিচ্ছে না। পাশাপাশি কোন হকার, খরিদদার বা ফারিয়াকেও রোহিঙ্গা গ্রামে ঢুকতে দিচ্ছে না। গত এক সপ্তাহে সহস্রাধিক রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার চুক্তি সইয়ের পর রোহিঙ্গাদের যখন স্বদেশে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছিল, ঠিক সে মুহূর্তে দেশটির স্থানীয় প্রশাসন ও রাখাইন যুবকরা সেখানকার রোহিঙ্গাদের দেশ ত্যাগে চাপ সৃষ্টি করে। মিয়ানমারে সক্রিয় ১০ সশস্ত্র সংগঠন ॥ মিয়ানমার সরকারের প্রস্তাবিত শান্তি প্রক্রিয়ায় দুটি সশস্ত্র সংগঠন যোগ দিলেও সেখানে আরও ১০টি সশস্ত্র সংগঠন শান্তি প্রক্রিয়ার বাইরে রয়েছে বলে জানা গেছে। তারা এখনও বিভিন্নভাবে সক্রিয়। গত মঙ্গলবার ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে শান্তি প্রক্রিয়ায় যোগদানের ঘোষণার কথা। জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা আউং সান সুচি এবং সেনাপ্রধান মিন অং লাইং- এর সঙ্গে সাক্ষাতের পর জাতীয় অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে দি নিউ মন স্টেট পার্টি এবং লাহু ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন। মঙ্গলবার অস্ত্রবিরতিতে রাজি হয় দি নিউ মন স্টেট পার্টি এবং লাহু ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন নামে নৃগোষ্ঠী। কয়েক দশকের সংঘাত থামাতে গেল বছরই শান্তি প্রক্রিয়ার কার্যক্রম শুরু করে স্টে কাউন্সেলর আউং সান সুচি প্রশাসন। প্রাণ ভয়ে চলে আসছে জিরো পয়েন্টের রোহিঙ্গারা ॥ পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের জিরো লাইনে তাঁবুতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে থেকে রাতের আঁধারে পাঁচ পরিবারের ২২ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালং ক্যাম্পে ঢুকে পড়েছে বলে জানা গেছে। বুধবার ভোর রাতে তারা সীমান্তরক্ষীদের চোখে ফাঁকি দিয়ে সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। সেখানে আরও ৬ হাজার ৯১৭ জন রোহিঙ্গা আতঙ্কিত অবস্থায় দিনাতিপাত করছে বলে জানা গেছে। গত বছরের ২৫ আগস্টের পর নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়ি সদর, সাপমারা ঝিরি, বড় ছনখোলা, দোছড়ি বাহির মাঠ এলাকায় প্রায় দশ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা শূন্যরেখায় (বাংলাদেশ অংশে) আশ্রয় নেয়। এসব রোহিঙ্গাদের রেডক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন এনজিও ত্রাণসামগ্রীর পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা প্রদান শেষে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু তুমব্রু সীমান্তের (মিয়ানমার অংশে) ৬ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা অবস্থান করায় তাদের কোথাও সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি।
×