ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাসে গচ্চা ২০ লাখ টাকা

বিমানে ক্যাডেট পাইলট প্রশিক্ষণ শেষ হয়নি, বাইরে থেকে নিয়োগ

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বিমানে ক্যাডেট পাইলট প্রশিক্ষণ শেষ হয়নি, বাইরে থেকে নিয়োগ

আজাদ সুলায়মান ॥ এক বছর আগে ড্যাশ-৮ এর জন্য ২৪জন ক্যাডেট পাইলট নিয়োগ করেও সঠিক সময়ে তাদের প্রশিক্ষণ শেষ করতে পারেনি বিমান। অথচ এ প্রশিক্ষণ শেষ করতে সর্বোচ্চ ৭ মাস সময় লাগে। সঠিক সময়ে পাইলট তৈরি না করে বিমান জরুরী ভিত্তিতে চড়া মূল্যে ইউএস বাংলা থেকে পাইলট ভাড়া নিয়েছে। বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদও এই সময়ের মধ্যে একজনেরও প্রশিক্ষণ শেষ করতে না পারায় কিছুটা বিব্রতকর। জানতে চাইলে তিনি এই ব্যর্থতার সঠিক ব্যাখ্যাও দাঁড় করাতে পারেননি। বলেছেন- হয়ে যাবে খুব শিগগির। বিমান সূত্র জানিয়েছে-সঠিক সময়ে পাইলট তৈরি করতে না পারায় বিমানকে জরুরীভাবে বেসরকারী এয়ারলাইন্স ইউএস বাংলা থেকে পাইলট ভাড়া নিতে হয়েছে চড়া দামে। এটা বিমানের ফ্লাইট অপারেশন শাখার চূড়ান্ত ব্যর্থতা। কারণ একজন ক্যাডেট পাইলটকে গ্রাউন্ড ট্রেনিং, সিমুলেটর ট্রেনিং ও রুট চেক করতে কিছুতেই ৭ মাসের বেশি সময় লাগে না। যা বিমান গত এক বছরেও শেষ করতে পারেনি। এই না পারার দায়ভার সম্পর্কে জানতে চাইলে অভিযুক্ত পরিচালক ক্যাপ্টেন জামিল কোন কথা বলেননি। জানা যায়, গত বছরের শুরুতেই বিমান ২টি ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজের জন্য দু দফায় ২৪জন ক্যাডেট পাইলট নিয়োগ দেয়। সাধারণত নিয়োগের পর পরই তাদের সবাইকে একত্রে গ্রাউন্ড প্রশিক্ষণ দিতে সাড়ে ৩ মাস, দুভাগে ভাগ করে সিমুলেটরের ট্রেনিং করাতে ৩০ দিন, তারপর রুট ট্রেনিং করাতে লাগে আরও ১৫ দিন। তারপর সরাসরি ফ্লাইট অফিসার হিসেবে কাজে যোগ দেয়ার মতো প্রস্তুতি। মূলত ছয় থেকে ৭ মাসের মধ্যেই প্রশিক্ষণের সবগুলো ধাপ সম্পন্ন করা সম্ভব এবং বিমানে অতীতের সব ক্যাডেট পাইলটের প্রশিক্ষণ এ গতিতেই হয়েছে। ব্যত্যয় ঘটেছে শুধু এবারই। গত এক বছরেও এদের একজনেরও সব প্রশিক্ষণ শেষ হয়নি। বিমানের ফ্লাইট অপারেশন শাখা জানিয়েছে, সর্বশেষ বুধবার পর্যন্ত এদের মধ্যে মাত্র ৪জন সিমুলেটর প্রশিক্ষণ শেষ করে এখন রুট ট্রেনিংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার মানে তাদের বাকি প্রশিক্ষণ শেষ করে ফ্লাইটে ফার্স্ট অফিসার হিসেবে কাজে লাগাতে আরও দরকার কমপক্ষে মাস খানেক। তারপর বাকিদের সব প্রশিক্ষণ শেষ করতে কতদিন সময় লাগতে পারে তা নিশ্চিত করতে পারেনি বিমানের ডিএফও ক্যাপ্টেন ফারাহাত জামিল। এ দিকে দুটো ড্যাশ-৮ এর জন্য জরুরী প্রয়োজন দেখিয়ে বেসরকারী ইউএস বাংলা থেকে ৫জন পাইলটকে ফার্স্ট অফিসার হিসেবে সাড়ে ৩ লাখ টাকায় ভাড়া নেয়া হয়। তারা এখন বিমানে ডিউটি করছেন। প্রতি মাসে এদের বিমানকে অতিরিক্ত ২০ লাখ টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় বিমানের নিজস্ব পাইলট, সাধারণ কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের মাঝে চরম ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এ বিষয়ে এক পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, মূলত জরুরী ভিত্তিতে পাইলট নিয়োগ দিয়ে কমিশন হাতিয়ে নেয়ার জন্যই গত এক বছরেও বিমানের নিজস্ব ১০জন ক্যাডেট পাইলটের প্রশিক্ষণ শেষ করা হয়নি। এ বিষয়ে বিমানের প্রশাসন থেকে ডিএফও ক্যাপ্টেন ফারাহাত জামিলের কাছে জানতে চেয়েও কোন সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এ সম্পর্কে বিমানের একজন ডিজিএম অভিযোগ করেন- ডিএফও সঠিক সময়েও এক জনেরও গ্রাউন্ড, সিমুলেটর ও রুট প্রশিক্ষণ করায়নি। যেটা মাত্র ৭ মাসে সম্ভব- সেটা এক বছরেও কেন করা হয়নি তা দেখার মতোও কেউ নেই বিমানে। সবাই চলছে গড্ডালিকা প্রবাহে। এ বিষয়ে ফ্লাইট অপারেশন শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত সিমুলেটরের স্লøট পেতে কিছুটা সময় লাগে। ড্যাশ-৮ এর সিমুলেটর সাধারণত সুইডেন, লন্ডন ও ইথিওপিয়াতে হয়। সেখানে স্লøট পেতে কিছুটা সময় লাগে। তবে তার জন্য কিছুতেই ৭ মাসের বেশি লাগার মতো নয়। আসলে এ বিলম্বটা এখন ওপেন সিক্রেট। কারণ এর আগেও গত বছর প্রয়োজন ছাড়াই ২জন পাইলটকে ভাড়ায় এনে বিমানের পাইলট বসিয়ে রেখে তাদেরকে দিয়ে ডিউটি করানো হয়। পরে তাদেরকে ইউএস বাংলা নিজের প্রয়োজনেই প্রত্যাহার করে নেয়। তখনও এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল, ওই ২জন পাইলট ছাড়াও বিমানের কাজের কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। তাদেরকে প্রত্যাহারের পরেও কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। তাহলে কী শুধুই কমিশন বাণিজ্যের প্রয়োজনেই চড়া দামে এই পাইলট ভাড়া নেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে অপর কর্মকর্তা জানান, ২০১৫ সালে ১৬জন ক্যাডেট পাইলটকে মাত্র ৫ মাসে সব প্রশিক্ষণ শেষ করে ফার্স্ট অফিসার হিসেবে কাজে লাগানোর মতো নজির রয়েছে। তার ৩ বছর পর এখন ৫ জনকে ইউএস বাংলা থেকে ভাড়া করতে হয়েছে। বিমান কেন এ সময়ে ৫/৭জন ফার্স্ট অফিসার তৈরি করতে পারেনি সেটার সঠিক তদন্ত হওয়া উচিত। এ বিষয়ে ফ্লাইট অপারেশন শাখা সূত্র জানায়, সাধারণত পাইলট বাহির থেকে ভাড়া বা সাময়িক চুক্তিতে নিতে হলেও তার ফ্লাইং অভিজ্ঞতা থাকতে হয় কমপক্ষে ৫শ’ ঘণ্টা। সেখানে এবার যাদেরকে নেয়া হয়েছে তাদের অভিজ্ঞতা মাত্র দু শ’ থেকে দু শ’ ৩০। বার বার কেন ফ্লাইট অপারেশন শাখা এ ধরনের ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে জানতে চাইলে বিমানের পার্সোনাল শাখা থেকে জানানো হয়-যতোটা পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা প্রয়োজন সেটার পরিচয় দিতে ব্যর্থ বর্তমান ডিএফও ক্যাপ্টেন ফারহাত জামিল। তিনি প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে থাকাবস্থায় বছর দুয়েক আগে বুদাপেস্ট যাবার পথে প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে বড় ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। সে ঘটনায় দেশ বিদেশে তোলপাড় দেখা দেয়ায় তদন্ত কমিটির সুপারিশ ছিল- এ পদে দক্ষ ও অভিজ্ঞ একজনকে দায়িত্ব দেয়া। ওই ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তদন্তকারীরা জানতে পারেন, পোকা মারার পাইলট হিসেবে পরিচিত ডিএফও জামিল আশির দশকে সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় আকাশ থেকে ফ্লেসারের মাধ্যমে শস্যক্ষেতে পোকামাকড় নিধনের স্প্রে ছিটানোর কাজ করতেন। পরে বিনা পরীক্ষায় বিশেষ তদবিরে হঠাৎ তাকে বিমানে নিয়োগ দেয়া হয়। তারপর থেকে বিমানের প্রতিটি পাইলট প্রশিক্ষণের শুরুতে তিনি প্রথমবার ফেল করায় দ্বিতীয়বারের সুযোগে উত্তীর্ণ হন। এমনকী সর্বশেষ বোয়িং ৭৭৭ এর ইনিশিয়াল ট্রেনিংয়েও ফেল করেন। ফেল করার এমন রেকর্ড থাকা পাইলটকেই বিমানের ডিএফও ও ফ্লিট চীফের মতো গুরুত্ব দেয়ায় তদন্তকারীরাও বিস্ময় প্রকাশ করেন। সেই থেকে পোকামারার পাইলট হিসেবে পরিচিত ক্যাপ্টেন জামিল কেন এসব ক্যাডেট পাইলটের প্রশিক্ষণ সঠিক সময়ে শেষ করতে পারেননি প্রশ্ন করা হলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ কোন মন্তব্য করেননি। বলেছেন, সেটা উনাকেই জিজ্ঞাসা করুন।
×