ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভালবাসার রং মাখা বই উৎসব, উচ্ছল তারুণ্য

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ভালবাসার রং মাখা বই উৎসব, উচ্ছল তারুণ্য

মোরসালিন মিজান ॥ বসন্তের প্রথম দিনে মেলার যে রং, একদিন পর তা বেশ বদলে গেল! ফাল্গুনের প্রথম দিন মঙ্গলবার বাসন্তী রঙের পোশাক পরে এসেছিলেন সবাই। পরদিন বুধবার মেলার ১৪তম দিনে দেখা গেল অন্য চেহারা। এবার গাঢ় লাল রঙের উৎসব। কারণটি যে ভালবাসা দিবস, বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালবাসার বিশেষ দিবস ভ্যালেন্টাইনস ডে। সারা বিশ্বেই দিবসটি উদযাপিত হয়। বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরাও বেশ লুফে নিয়েছেন। অন্যান্যবারের মতো এবারও ভালবাসার উৎসবে মুখর ছিল রাজধানী ঢাকা। আর বিকেল হতেই সেই ঢেউ এসে লাগে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। হৃদয়ে ভরপুর আবেগ, বুকের ভীরু কাঁপন নিয়ে মেলায় প্রবেশ করেন অপেক্ষাকৃত তরুণ-তরুণীরা। এদিন যুগল পথ চলাই বেশি চোখে পড়েছে। একহাতে গোলাপ। অন্যহাতে বই। একটু পর পরই দেখা যাচ্ছিল এমন অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। ভালবাসা দিবসের খবর জানেন প্রকাশকরাও। বিভিন্ন স্টলের সামনের অংশটি তাই কবিতার বই দিয়ে সাজানো হয়েছিল। প্রেমের উপন্যাস, সঙ্গে প্রিয় কবিতার উপস্থাপনা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম কবি। এখানে আর কোন বই দেখা গেল না। শুধু কাব্যগ্রন্থ। একসঙ্গে অনেক কবির লেখা। নির্মলেন্দু গুণের কয়েকটি বই চোখে পড়ল। ‘প্রথম তিন’ নামে এসেছে নতুন একটি বইও। নতুন মানে, কবির উত্থানের কালে প্রকাশিত তিনটি বইয়ের সংকলন। পাতা ওল্টাতেই বহুকালের চেনা কাব্য ভাষা। কবি লিখেছেন, ‘কি দেখো অমন করে আমার ভিতরে/আমি দেখি, আমি কি কেবলই দেখি? নীহারিকা/শুধু পটে লিখা তুমি কি কেবলই ছবি...।’ পাশেই ছিলেন বিনয় মজুমদার। পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কবির ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশিত হয়েছে এখান থেকে। বইটি হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতেই পড়ে ফেলা হলো কয়েক পঙক্তি। কবি লিখছেনÑ ‘এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে/অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ পড়ে আছে...।’ রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শ্রেষ্ঠ কবিতা পাওয়া গেল একাধিক স্টলে। বইয়ের একটি কবিতায় এ রকমÑ ‘নরম আলোর চাঁদ মরে যায় অঘ্রাণের রাতে,/বেঁচে থাকে ভালবাসা, নক্ষত্রের আলোকিত স্মৃতি। তোমার শূন্যতা ঘিরে দীর্ঘশ্বাস, বেদনার ঘ্রাণ,/তোমার না-থাকা জুড়ে জেগে থাকে সহস্র শ্মশান।’ রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতাও যথারীতি আছে। সংকলন গ্রন্থের পাতা ওল্টাতেই সেই কালজয়ী কবিতাÑ ‘কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আঁধারে/যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/মরিবার হল তার সাধ...।’এভাবে ভালবাসার দিনে হৃদয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আবেগ জাগিয়ে দিয়ে যায় কবিতা। অবশ্য এবার ১৪ ফেব্রুয়ারি শুধু ভালবাসা দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়নি, ভুলতে বসা স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসটিও জোরেশোরে সামনে এসেছিল। ফেসবুকে প্রেসিডেন্ট এরশাদের মানুষ খুনের ইতিহাসটি অনেকেই তুলে ধরেন। সেই ধারাবাহিকতায় আসে বইমেলাতেও। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের কর্মী কবি তারিক সুজাত। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল ফেব্রুয়ারি কথা বলে তার কবিতায়। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বেঙ্গলের স্টলে গিয়ে পাওয়া যায় তার কবিতাসংগ্রহ। দুটি বইয়ের সংকলন। মেলায় নতুন এসেছে। বই দুটিতে কবির নিজের সময়কে ধরে রাখার চেষ্টা। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কিছুটা যেন ব্যথিত তিনি। পুরনো সেই প্রতিবাদ নতুন করে কথা বলে তার কবিতায়। ১৪ ফেব্রুয়ারির হত্যাকা-ের কথা উল্লেখ করে কবি লেখেন, নিজেকেই যেন প্রশ্ন করেন, ‘তবে কি মিলনের মৃত্যুও ছিল/কেবলই প্রাণের অপচয়?/ঘাতক ট্রাকের নিচে সেলিম, দেলোয়ারের ছিন্নভিন্ন দেহ, কী অসহায় কাঁদে...। পাঠকও প্রেম এবং দ্রোহের কবিতায় নিজেকে খুঁজেছেন। হৃদয়ের যে বলা বাকি ছিল, কবিতা বলবে। সেই কবিতার বই কিনে প্রিয়জনকে উপহার দিয়েছেন। শেষ বিকেলে সুমনা নামের এক তরুণীর হাতে দেখা গেল সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা। অন্য প্রকাশ থেকে কেনা। নিজেই কিনেছেন? জানতে চাইলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের দিকে অঙ্গুলি প্রদর্শন করেন। বলেন, ‘ও কিনে দিল।’ প্রেমিক পুরুষটিও স্বীকার করে নিয়ে বললেন, মনের গভীর বোধ থেকে যে কথাটি তিনি বলতে চান, তা কবিতায় অনেক আগেই কোন না কোন কবি বলে গিয়েছেন! তবে সাধারণ পাঠক এদিনও নানা বিষয়ের বই খুঁজে বেড়িয়েছেন। কিনেছেন। প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিক্রিও হয়েছে ভাল। আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন তারা। প্রচুর বই মেলায় এনেছিলেন। বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী, গত দুই সপ্তাহে নতুন বই এসেছে ১ হাজার ৯৩২টি। মুনতাসীর মামুনের চারটি নতুন বই ॥ মেলায় এসেছে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের চারটি নতুন বই। বইগুলো প্রকাশ করেছে জার্নিম্যান। লেখকের একটি খুব উল্লেখযোগ্য কাজ ‘উনিশ শতকের পূর্ববঙ্গ : সেইসব মানুষ।’ বইটিতে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের কথা বলা হয়েছে। চমৎকার গবেষণা। তবে শুধু লেখা নয়, দুর্লভ ছবির বড় সংগ্রহ। প্রকাশনায় ব্যবহার করা সাদাকালো ছবিগুলো নিয়ে প্রচুর কাজ করা হয়েছে। উৎকর্ষ সাধনের সফল চেষ্টায় নতুন প্রাণ পেয়েছে ছবিগুলো। দেখে মনেই হয় না এত এত কাল আগের ছবি! অপর বইটি ‘ওয়েন লিওনার্দ যখন ঢাকায়।’ তিন দশক ঢাকায় থাকা ভিনদেশী ওয়েন লিওনার্দ শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। তার লেখা চিঠিতে এসব তথ্য পাওয়া যায়। বইতে এমন বেশি কিছু চিঠি সংযুক্ত করা হয়েছে। দুটি বই তিনি ইংরেজীতে লিখেছেন। ‘১৯৭১ ঙটজ ডঅজ ঙঋ খওইঊজঅঞওঙঘ’ বইটি এইটুকুন দেখতে। তবে ইংরেজী মাধ্যমে বিশেষ মনোযোগী ছোট ছোট ছেলেমেয়ে চট করে পড়ে ফেলতে পারবে। ‘ইওজঅঘএঙঘঅ ৭১’ বইটিতে আছে মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত নারীর কথা। বিকেলে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জার্নিম্যাানের স্টলে বইগুলোর মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এ সময় মুনতাসীর মামুন নিজের লেখা বইগুলোর পরিচিতি তুলে ধরেন। প্রথমেই আসে ‘উনিশ শতকের পূর্ববঙ্গ : সেইসব মানুষ’ প্রসঙ্গ। লেখক বলেন, বইটির মসলা আমি ৩৫ বছর ধরে জমা করে রেখেছিলাম। এতদিন ব্যবহার করিনি। এ পর্যায়ে এসে মনে হলো, বইটি যতœ করে প্রকাশ করার মতো একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আমি পেয়েছি। তাই আজ প্রকাশিত হলো। ইংরেজীতে প্রকাশিত বইটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের ইংরেজী মাধ্যমে পড়া ছেলেমেয়েরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটি ভাল করে জানে না। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান নেই। তাই তাদের উপযোগী করে বইটি রচনা করেছেন বলে জানান তিনি। তবে কিছুটা হতাশা প্রকাশ করেন বড়দের বইপড়া নিয়েও। বলেন, তারা সবাই আমার বই সংগ্রহ করেন। প্রশংসা করেন। তবে আমার কি কি বই আছে, কি কি বিষয়ে বই আছে; সে সম্পর্কে তাদের ধারণা আছে বলে মনে হয় না। দেখেন। পাতা ওল্টান। কতটুকু পড়েন, আমার সন্দেহ আছে। ইতিহাস জানার প্রয়োজনেই বইগুলো পড়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি। কবি আসাদ মান্নান বলেন, মুনতাসীর মামুনের গ্রন্থের মধ্য দিয়ে অন্য এক বাংলাদেশকে পাচ্ছি আমরা। এই বাংলাদেশকে নিরন্তর তার কলমের কথায় সবার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। যারা বাঙালিত্বকে, বাংলাদেশকে ভেতরে লালন করেন, মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনাকে ধারন করেন; বইগুলোর মধ্য দিয়ে তারা তাই পাবেন। কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার বলেন, আমাদের উনিশ শতক আমাদের প্রাচীন বাংলা এই ঢাকা শহর কেমন ছিল মুনতাসীর মামুনের লেখা পড়ে জানতে পারি আমরা। তিনি এসব বিষয় এবং বিবরণ মননশীলতার মধ্য দিয়ে, সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। এর আগে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বইগুলোর প্রকাশক কবি তারিক সুজাত। ১৯২ নতুন বই ॥ মেলার ১৪তম দিনে নতুন বই এসেছে ১৯২টি। নির্বাচিত বই ॥ মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশ করেছে সৈয়দ শামসুল হকের কবিতাগ্রন্থ ‘তাস।’ একেবারে প্রথম দিকে কবির লেখা বই। নতুন করে মেলায় এসেছে। ঐতিহ্য থেকে এসেছে ‘পূর্ব বাংলার সাত দশকের কমিউনিস্ট রাজনীতি।’ লিখেছেন মনজুরুল হক। একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে ‘বাংলা কথাসাহিত্যে শহর পরিবেশ ও প্রকৃতি।’ অনুপম থেকে মেলায় এসেছে রবার্ট পেইনের বইয়ের বাংলা অনুবাদ ‘সেই দুঃসময়।’ অনুবাদ করেছেন সিদ্দিকুর রহমান। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ এদিন গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘শিশু সংগঠন নিষ্ক্রিয়তা ও শিশুর সাংস্কৃতিক বিকাশ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মোহিত কামাল। আলোচনা করেন সুব্রত বড়–য়া, দিলারা হাফিজ এবং হাসান শাহরিয়ার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী খুরশিদ আলম, মুর্শিদুদ্দিন আহম্মদ, কমলিকা চক্রবর্তী এবং চম্পা বণিক।
×